বড় ভুলো মন আমাদের। নানা বায়নাক্কায় এড়িয়ে চলি ভালবাসাকে। ভুলে যাই পুরনো দিনের স্মৃতির আখর। আসলে প্রতিদিনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা এই জীবনকে নিয়ে আমাদের নানা অভিযোগ, নানা ক্ষয়ক্ষতির হিসেব।
সেসব থেকে একটু চোখ ফিরিয়ে অন্য জগতে প্রবেশ করলেই দেখা যাবে এখনও দিয়েগো ফোরলান ফুটবল খেলছেন। সেই এক লুকে। সোনালী ঝাঁকড়া চুলটা হেয়ারব্যান্ড দিয়ে আটকানো। ১০ নম্বর জার্সি, দু’হাত ছড়িয়ে পৃথিবীকে স্বাগত।
ডিয়েগো ফোরলান আসলে অনেকদিনের জমে থাকা একটা খিদে। টাফ ট্যাকলেও যাকে টলানো যাচ্ছে না। অসীম শক্তিধর ডিফেন্ডাররাও যার কাছে শিশুর সারল্যমাখা হাসি হেসে যায়। আসে কেউ কেউ, হঠাৎ করে আগমন হয় তাদের।
অথচ, এ সেই ডিয়েগো ফোরলান, যার ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড যাত্রা ছিল দুর্গম, কণ্টকাকীর্ণ। শুনতে হয়েছিল ‘ফর লোন’। প্রথম গোল পেতে লেগে গেল নটা মাস।
আজ যেমন ওউট ওয়েঘর্স্টকে নিয়ে আমরা ফলাও করে বলি, ওর দ্বারা কিছুই হবে না। তেমনি বলেছিলাম ফোরলানকে নিয়েও। ইন্ডিপেন্ডিয়েন্থে গোলের পর গোল করেও লাল জার্সি গায়ে যার ফুটবল যেন কার্যত থমকে গেল।
অথচ, থমকাননি ফোরলান। যোগ দিলেন অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদে। তারপর উত্থান। শুধুই উত্থান। বিশ্ব পেল ফোরলানকে, আর আমরা থেকে গেলাম এক দিশেহারা শিল্পীর ভয়ংকর হয়ে ওঠার গল্পের সাক্ষী হয়ে।
বাঁ পা, ডান পা – দুটোই সমান। কখনও কোনও অবস্থায় টলমল করে না। ২০১০ বিশ্বকাপ। চার-চারটে গোল। এবং একটা পেনাল্টি বাদে বাকি তিনটে গোল বিশ্বমানের। তার মধ্যে একটা গোলকে ঐশ্বরিক বললেও খুব ভুল হয় না। সেবার দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে খেলা হয়েছিল জাবুলানি বল দিয়ে।
অধিকাংশ প্লেয়ারের প্রবলেম। ফ্রান্স টিমে তো রীতিমতো গৃহযুদ্ধ। তবু একজন তাকে বশ করে নিজের করে নিলেন। কী করে ভুলি ঐ ডান পায়ের ভলি। কী করে ভুলি ডি বক্সে বাইরে অনেকটা দূর থেকে সেই জোরালো শটের দিনগুলো।
ইনস্টেপ, আউটস্টেপ ডজ করে সোলা রানে অপোনেন্টের ডিফেন্স ফালাফালা করে দেওয়া স্মৃতিগুলো। ডিয়েগো ফোরলান যে। সোনালী ঝাঁকড়া চুল, মাথায় হেয়ারব্যান্ড।
জার্মানির এগেন্সটে হেরে ফোর্থ হল উরুগুয়ে। তবু মাঠ থেকে ফেরার সময় ক্লোসে, পোডলস্কি, মুলার, খেদিরারা হাততালি দিল একজনকে উদ্দেশ্য করে।
সেমিফাইনালে হারল নেদারল্যান্ডসের কাছে। জিওভান্নি ব্রঙ্কহর্স্টের সেই অবিশ্বাস্য গোল। তবু ম্যাচ শেষে স্নেইডার এসে পিঠ চাপড়ে গেল একজনের।
ঘানা ম্যাচে সমতা ফেরাতে লাগল শুধু একটা ফ্রিকিক। শুধুই গোল করা নয়, টিমকে জেতাতে ক্যাপ্টেন ড্রেসিংরুমে মনোবল বাড়িয়ে দিলেন ষোলো আনা। না হলে সেমি অব্দি আসেই না টিমটা। ম্যাক্সি রড্রিগেজ, অভিজ্ঞ দিয়েগো লোগানো, দিয়েগো গোদিন, মার্টিন ক্যাসেরাস, সুয়ারেজ-কাভানি এবং তিনি। দিয়েগো ফোরলান। সোনালী ঝাঁকড়া চুলের সামনে যত্ন করে থাকা হেয়ারব্যান্ডটা!
তারপর, তারপর ২০১১। কোপা আমেরিকা। কট্টর ব্রাজিল সমর্থক হয়েও রাত জেগে টিভির সামনে ঠায় বসে শুধু উরুগুয়ের খেলা দেখা বছর বারোর এক কিশোর। ব্রাজিল সেবার বিশ্রী খেলেছিল টুর্নামেন্টটা। কোয়ার্টারে প্যারাগুয়ের বিরুদ্ধে প্রায় সবাই পেনাল্টি মিস করল।
ফ্রেড, মাইকন, এলানো, তরুণ স্টার নেইমার। ডিফেন্সে লুসিও ছিল। থিয়াগো সিলভা তখন তরুণ। বোধহয় তখন এসি মিলানে। আর এদিকে সাড়ে তিনটে, কলকাতা টিভি, সামনে সার্জিও বাতিস্তার আর্জেন্টিনা।
পেনাল্টি মিস করল একা তেভেজ আর তার সাথে হেরে গেল তেভেজ, আগুয়েরো, মেসির আর্জেন্টিনা। কলম্বিয়াকে হারিয়ে সেমিফাইনালে ওঠা পেরু পর্যুদস্ত হল।
ফাইনালে তিন গোলে মাথা নোয়ালো প্যারাগুয়ে। টুর্নামেন্ট শ্রেষ্ঠ প্লেয়ার হল সুয়ারেজ। তবু সবকিছুর পেছনে এই একজন সব্যসাচী হয়ে থেকে গেল। যারা সে টুর্নামেন্ট দেখেছে, তারা জানে। জানবে চিরকাল। ডিয়েগো ফোরলান। সেই যে ঝাঁকড়া চুলটা।
হ্যাঁ, ফোরলান আমাদের মনে চিরস্থায়ী। সে আসনে বসার অধিকার আর কারোর নেই। কখনও নেই। ডিয়েগো ফোরলান আসলে এক জীবন্ত কবিতার নাম যে!