ক্যারিবিয়ান দানবের হৃদয়ে বাংলাদেশ

১.

তিন জুলাই, ১৯৮৩। ওয়েস্ট ইন্ডিজ বনাম ইংল্যান্ড পাঁচ ম্যাচ সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টের শেষদিন। আগের টেস্ট হারায় এই ম্যাচ জিতে সিরিজে সমতা ফিরিয়ে আনতে মরিয়া ডেভিড গাওয়ার, টেস্ট জিততে শেষদিনে ৩৪৪ রানের বিশাল টার্গেট দিয়ে ব্যাটিংয়ে পাঠান প্রতিপক্ষকে।

এই টেস্টে তখন দুটো ফলাফলই সম্ভব ছিল;এক ইংল্যান্ডের জয় অথবা অসাধারণ ব্যাটিং করে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ড্র। কিন্তু প্রতিপক্ষ দলে যখন বব উইলিস, ইয়ান বোথাম, ডেরেক প্রিঙ্গেল, জিওফ মিলারদের মতো বোলার থাকেন তখন ড্র করার চিন্তাও দুরাশা।

কিন্তু একজন ভেবে রেখেছিলেন অন্য এক চিত্রনাট্য। আগের ইনিংসেই মাত্র এক রান করে আউট হয়েছেন। এবার রানের খাতা খুললেন স্কয়ার কাট করে বাউন্ডারির মাধ্যমে। দিনশেষে ১১ ওভার হাতে রেখে ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিতলো ৯ উইকেটে!

তিনি অপরাজিত রইলেন ২৪২ বলে ২১৪ রান করে যাতে ছিল ২৯টি চার আর ২টি ছয়ের মার!! ব্যাটসম্যানটি হলেন স্যার কুথবার্ট গর্ডন গ্রিনিজ – তর্কসাপেক্ষে সর্বকালের সেরা বিধ্বংসী ওপেনার।

২.

সত্তর দশক থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত রাজত্ব করা ওয়েস্ট ইন্ডিজের সর্বজয়ী দলের অন্যতম সদস্য তিনি। ক্যারিশমাটিক ভিভ রিচার্ডস, ক্লাইভ লয়েডের লিডারশিপ কিংবা অনবদ্য পেস বোলিংয়ের কারণে লাইমলাইটে ছিলেন না সেভাবে কখনোই। কিন্তু নিজের কাজটা করে গেছেন আড়ালেই, ডেসমন্ড হেইন্সকে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন অপ্রতিরোধ্য এক উদ্বোধনী জুটি; ৮৯ টেস্টের ১৪৮ ইনিংসে উদ্বোধন করতে নেমে দুজনে মিলে সংগ্রহ করেছেন ৬৪৮২ রান যা টেস্ট ক্রিকেটে যেকোন ওপেনিং জুটিতে সর্বোচ্চ রানের বিশ্বরেকর্ড।

গর্ডন গ্রিনিজ ছিলেন টেকনিক্যালি অত্যন্ত সলিড একজন ব্যাটসম্যান। ছোটবেলায় ক্রিকেট ক্যারিয়ার ইংল্যান্ডে শুরু করার কারণে তাঁর ব্যাটিংয়ে দেখা যায় ইংরেজ রক্ষণের পাশাপাশি ক্যারিবিয়ান আগ্রাসনের অদ্ভুত সংমিশ্রণ।

তার ট্রেডমার্ক শট ছিল পাওয়ারফুল স্কয়ার কাট। বিশেষত পয়েন্ট আর গালির মাঝে দিয়ে স্কয়ার কাট মারায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তাঁর টাইমিং ছিল দুর্দান্ত;প্লেসমেন্ট ছিল নিখুঁত। পেসারদের বিপক্ষে হুক ও পুল খেলায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার।

৩.

প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে গ্রিনিজের অভিষেক ১৯৭০ সালে কাউন্টির দল হ্যাম্পশায়ারের হয়ে। সেখানে প্রোটিয়া কিংবদন্তি ব্যারি রিচার্ডসকে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন কাউন্টির ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম সেরা ওপেনিং জুটি।

ইংল্যান্ডের হয়ে খেলার সু্যোগ থাকলেও ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটকে প্রতিনিধিত্ব করার আশায় ১৯৭৪ সালে ফিরে আসেন বার্বাডোজে। দলে ডাক পেতেও খুব বেশি সময় নেননি, পাকিস্তানের সাথে প্রস্তুতি ম্যাচে ২৭৩ রানের ইনিংস খেলে জায়গা করে নেন ভারতগামী ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে। সেই সফরেই প্রথমবারের মতো দলে জায়গা পান আরেক কিংবদন্তি স্যার ভিভ রিচার্ডস।

চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে ভারতের বিপক্ষে একই সাথে টেস্ট ক্যাপ পান এই দুই কিংবদন্তি। অভিষেক টেস্টে ভিভ রিচার্ডস ব্যর্থ হলেও প্রথম ইনিংসে ৯৩ এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ১০৩ রান করে অভিষেকলগ্নেই রাজত্ব শুরুর জানান দেন গ্রিনিজ।

১৯৭৬ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত সময়টা ছিল গ্রিনিজের ক্যারিয়ারের উজ্জ্বলতম অধ্যায়। এই ৮ বছরে খেলা ৫৪ টেস্টে ১০ সেঞ্চুরি আর ২৩ ফিফটিতে ৫৩.৭ গড়ে৪১৪০ রান সংগ্রহ করেন। ১৯৭৭ সালে উইজডেন মনোনীত বর্ষসেরা ক্রিকেটারের পুরস্কারও জিতেছিলেন গ্রিনিজ।

’৭৬ সালে ইংল্যান্ডকে তাঁদেরই ঘরের মাটিতে ৩-০ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজ হারানোয় বড় অবদান ছিল গ্রিনিজের। পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজে ৩ সেঞ্চুরি ও ২ ফিফটিসহ ৬৫.৭৭ গড়ে গ্রিনিজের সংগ্রহ ছিল ৫৯২ রান।

ইংল্যান্ড সিরিজ থেকে পাওয়া দুর্দান্ত ফর্মটা গ্রিনিজ ধরে রেখেছিলেন ১৯৭৬-৭৭ মৌসুমে দেশের মাটিতে আয়োজিত পাকিস্তান সিরিজেও। ৫ টেস্টে ৫৩.৬০ গড়ে ৫৩৬ রান করে ক্যারিবিয়ানদের ২-১ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজ জয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। এক সেঞ্চুরির সাথে হাঁকিয়েছিলেন ৪ হাফ সেঞ্চুরি।

১৯৮৩-৮৪ সালের বিখ্যাত ‘রিভেঞ্জ’ সিরিজে ভারতকে টেস্টে ৩-০ এবং ওয়ানডেতে ৫-০ ব্যবধানে হারায় ক্যারিবীয়রা। ৬ টেস্টের সিরিজে গ্রিনিজের সংগ্রহ ছিল ৫৭.৩৭ গড়ে ৪১১ রান। কানপুরের টার্নিং উইকেটে খেলেছিলেন ১৯৪ রানের অনবদ্য ম্যাচ উইনিং এক ইনিংস।

১৯৮৩ সালের ভারতের বিপক্ষে অ্যান্টিগা টেস্টে অপরাজিত ১৫৩ রানে ব্যাটিং করা অবস্থায় ‘মৃত্যুপথযাত্রী’ অসুস্থ মেয়েকে দেখতে মাঠ থেকে হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাবেক ওপেনার গর্ডন গ্রিনিজ।

সেই ম্যাচের স্কোরকার্ডে গর্ডন গ্রিনিজের নামের পাশে প্রথমে ‘রিটায়ার্ড আউট’ লেখা হলেও মানবিকতার খাতিরে পরে সেটা পরিবর্তন করে লেখা হয় ‘রিটায়ার্ড নট আউট’। ক্রিকেট ইতিহাসে ‘রিটায়ার্ড নট আউট’ হওয়া একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে অমর হয়ে আছে তাঁর নাম।

১৯৮৪ সালের বিখ্যাত ‘ব্ল্যাকওয়াশ’ সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে ম্যাচজয়ী ডাবল সেঞ্চুরির পর চতুর্থ টেস্টেও খেলেন ২২৩ রানের অনবদ্য এক ইনিংস। ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বেলায় এসেও রান করে গেছেন নিয়মিত। ১৯৯১ সালে ব্রিজটাউনে অ্যালান বোর্ডারের অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলেন ক্যারিয়ার সেরা ২২৬ রানের ইনিংস।

প্রায় ১৭ বছরের ক্যারিয়ারে গ্রিনিজ খেলেছেন ১০৮ টি টেস্ট ও ১২৮টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ।১০৮ টেস্টে ৪৪.৭২ গড়ে তিনি রান করেছেন ৭৫৫৮। সেঞ্চুরি করেছেন ১৯টি।

টেস্টের সাফল্যের ধারা বজায় রেখেছিলেন এক দিনের ক্রিকেটেও। ৭৫ আর ‘৭৯ বিশ্বকাপ জয়ী ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের অপরিহার্য সদস্য গ্রিনিজ ১২৮ ওয়ানডেতে ৪৫ গড়ে রান করেছেন ৫১৩৪। ১১ টি সেঞ্চুরির সাথে ফিফটি আছে ৩১টি। সর্বোচ্চ ইনিংস অপরাজিত ১৩৩ রানের।

ক্যারিবিয়ানদের হয়ে ’৭৫ থেকে ’৮৩ পর্যন্ত মোট তিনটি বিশ্বকাপ খেলেছেন গ্রিনিজ। বিশ্বকাপের ১৫ ম্যাচে গ্রিনিজের সংগ্রহ ৪৫.৫৬ গড়ে ৫৯১ রান। চারটি ফিফটির সাথে আছে দুটি সেঞ্চুরিও। প্রথমটা ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের অভিষেক সেঞ্চুরি; ১৯৭৫ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে এজবাস্টনে। আর দ্বিতীয় শতরানটি এসেছিল ১৯৮৩ বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে।

গর্ডন গ্রিনিজের ম্যাচ ইমপ্যাক্ট? গ্রিনিজের ১১ ওয়ানডে সেঞ্চুরির নয়টিতেই জিতেছে তাঁর দল। আর টেস্টে? গ্রিনিজ সেঞ্চুরি করেছেন এমন একটি টেস্টও হারে নি এমনকি ড্র পর্যন্ত করেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ! অর্থাৎ তাঁর ১৯ সেঞ্চুরির সবকটিতে জয় পেয়েছে ক্যারিবিয়ানরা! তিনি টেস্টে ৬ বার আর সীমিত ওভারের ম্যাচে ২০ বার জিতেছেন ম্যাচসেরার পুরস্কার।

৪.

১৯৯১ সালে ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়া গ্রিনিজ সফলতা পান কোচ হিসেবেও। ১৯৯৭ সালে যখন বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব নেন তখন প্রত্যাশার পারদ ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও সফলতার হার ছিল নিম্নগামী। ১৯৯৭-এর আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশ দলের বড় শক্তি ছিল ড্রেসিংরুমে তার মতো ক্যারিশমাটিক চরিত্রের উপস্থিতি।

সেমিফাইনালে হল্যান্ডের বিপক্ষে বৃষ্টি বিভ্রাটে পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা ম্যাচে আকরাম খানের অনবদ্য ৬৭ রানের ইনিংসে জয় পায় বাংলাদেশ, যে ইনিংস পাল্টে দেয় বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ।

হল্যান্ডের বিপক্ষে শ্বাসরুদ্ধকর সেই জয়ের ওপর ক্রিকইনফোর ম্যাচ রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ‘Gordon Greenidge crying. Just imagine a win that makes Greenidge cry; a man who had come from a different country, a different culture. The owner of one of the fiercest square-cuts ever seen, the man with the double-century on one leg, the man whose image first comes to mind when the words “beware the wounded batsman” are said; Greenidge cried after that win. That’s how much it meant to the team.’

সেই ম্যাচটা না জিতলে বিশ্বকাপ খেলা হয়না বাংলাদেশের। পরবর্তীতে ফাইনাল জিতে বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতায় নতুন রঙ লাগায় বাংলাদেশ দল। আইসিসি ট্রফি জয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ গ্রিনিজকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেয়া হয়েছিল। যদিও তার বাংলাদেশ থেকে বিদায় সুখকর ছিল নাহ।। ‘৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্থানের বিপক্ষে ম্যাচ চলাকালীন সময়ে বরখাস্ত করা হয় তাকে।

বিশ্বকাপে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ, টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তি অথচ গর্ডন বিদায় নিলেন নীরবে, একাকী, মাথা নিচু করে। সেই ঘটনা আজও লজ্জাজনক এক ইতিহাস এদেশের ক্রিকেটে। তবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রতি তার আবেগ ছিল সবসময়।

এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের দায়িত্বটা ছিল কোচ হিসেবে আমার ক্যারিয়ারের প্রথম বড় দায়িত্ব। আমার সময়ে বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি জিতেছিল, যা তাদের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে সুযোগ করে দেয়। বাংলাদেশের কোচ হিসেবে আমার রয়েছে অনেক স্মৃতি। আমরা সবাই মিলে যা যা অর্জন করেছিলাম, তার জন্য আমি আজও গর্ববোধ করি। বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ আমার হৃদয়ের অনেকটা জায়গাজুড়েই আছে।’

এদেশের ক্রিকেটের উত্থানের পেছনে গর্ডন গ্রিনিজের অবদানকে খাটো করার সুযোগ নেই কোনোভাবেই। তাঁর হৃদয়ে যেমন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ক্রিকেটের হৃদয়েও আছেন তিনিই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link