সত্তরের দশকের কথা।
সেটা ভারতীয় ক্রিকেটের প্রথম জাগরণের যুগ বলা চলে। দেশ রেখে এই প্রথম নিয়মিত ইংল্যান্ড বা ওয়েস্ট ইন্ডিজে সিরিজ জিতছে ভারত। তখনকার ভারতীয় ক্রিকেটের প্রতীক হলো সুনীল গাভাস্কারের স্ট্রেট ড্রাইভ, স্পিন চতুষ্টয় এবং একটি বাজপাখি।
হ্যাঁ, তাঁকে বাজপাখি বলাই শ্রেয়।
তিনি সর্বকালের অন্যতম সেরা ফিল্ডার। পরিসংখ্যানের বিবেচনায় তিনি এখনও টেস্ট ইতিহাসের সবচেয়ে সফল ফিল্ডার। নি:সন্দেহে ইতিহাসের সেরা শর্ট লেগ ফিল্ডার। আবার কারো কারো মতে, তিনি গরিবের গ্যারি সোবার্স। তবে এই সবকিছু ছাপিয়ে সেরা বিশেষণটা হলো বাজপাখি – একনাথ সোলকার।
পুরো নাম একনাথ ঢোন্ডু সোলকার।
সোলকার উঠে এসেছেন একেবারে দরিদ্র, অথচ ক্রিকেটীয় একটা পরিবার থেকে। তার বাবা বোম্বের হিন্দু জিমখানা স্টেডিয়ামের একজন সাধারণ গ্রাউন্ডসম্যান। বাবার একটু কুঁড়েঘরের মতো ছিল। এক রুমের সেই ঘরে বাবা-মা আর পাঁচ ভাই রাত কাটাতেন। বাবার সুবাদে ক্রিকেটের সাথে সম্পর্ক তো ছিলই। সেই সাথে তারা কয়েকটা ভাই একসাথে ক্রিকেট খেলতেন। এক ভাই অনন্ত সোলকার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটও খেলেছেন।
সোলকার বোম্বে ক্রিকেটের দৃষ্টি আকর্ষন করেছিলেন মূলত বোলিং দিয়ে। নেটে বাঁ-হাতি স্পিন করতেন। কিছুদিন পর বোম্বের তারকা ক্রিকেটাররা দেখলেন, তিনি দারুন বাঁ-হাতি মিডিয়াম পেস করতে পারেন। আরও পরে আবিষ্কার হলো, সোলকার বিভিন্ন পজিশনে দারুন ব্যাট করতে পারেন। বুঝতে পারছেন, কেনো তাকে লোকেরা তখন গরীবের সোবার্স বলতো!
তাকে প্রথম অফিশিয়াল ক্রিকেটে উৎসাহী করে তোলেন ভিনু মানকড়।
১৯৬৬-৬৭ মৌসুমে রঞ্জি অভিষেক ইনিংসেই ৩৮ রানে ৬ উইকেট নিয়েছিলেন। পাশাপাশি ব্যাটে তার দারুন রান ছিল। তবে একটা জায়গায় সোলকার ছাড়িয়ে গেলেন সোবার্সকেও। সেটা হলো অবিশ্বাস্য ক্যাচিং দক্ষতা।
ঘরোয়া ক্রিকেটে তার লম্বা সময় উইকেটে পড়ে থাকার দক্ষতার কারণে লোকে তাকে সেই আমলে ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’ বলা হতো। প্রথম টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৭৫ রানে ৫ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর ৬১ রানের ইনিংস খেলে ধ্বস সামাল দিয়ে নামটার প্রতি সুবিচার করেছিলেন। সেকালের দ্রাবিড় আর কী!
সোলকার মূলত ফিল্ডিং দিয়েই ভারতীয় দলে একটা জায়গা নিজের করে নিয়েছিলেন। বিষান সিং বেদি বলছিলেন, ‘আমরা (স্পিন চতুষ্টয়) কখনোই অতোটা কার্যকর হতে পারতাম না, যদি শর্ট লেগে সোলকার না থাকতো। ওর এই অসামান্য ফিল্ডিং ছাড়া আমরা এই একই পরিসংখ্যানের মালিক থাকতাম না।’
একটু পরিসংখ্যানে চোখ বোলানো যাক।
সোলকার তার ক্যারিয়রে ২৭ ম্যাচে ৫৩ ক্যাচ নিয়েছিলেন। মানে ম্যাচ প্রতি তার ক্যাচ ছিল ১.৯৬। কমপক্ষে ১০ টেস্ট খেলা খেলোয়াড়দের মধ্যে এটা সেরা রেশিও। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী বব সিম্পসনের রেশিও ১.৭৭। বুঝতেই পারছেন, কতোটা এগোনো সোলকার।
১৯৭০-৭১ মৌসুমে পোর্ট অব স্পেনে এক ইনিংসে ৬ ক্যাচ নিয়ে তখনকার বিশ্বরেকর্ড করেছিলেন। টনি গ্রেগ বলেছে, ‘আমার জীবনে দেখা সেরা শর্ট লেগ ফিল্ডার এক্কি।’
আর এটাই সোলকারকে নিয়ে সবচেয়ে বড় বিস্ময়।
সারা দুনিয়ার রীতি হলো সেরা ফিল্ডাররা স্লিপ কর্ডন বা পয়েন্টে ফিল্ডিং করেন। সোলকার ফিল্ডিং করতেন শর্ট লেগে। শর্ট লেগে ফিল্ডিং করতেন, বললে সোলকারের ব্যাপারটা আপনি ঠিক বুঝতে পারবেন না। তিনি আসলে পারলে ব্যাটসম্যানের শরীরের ওপরে উঠে দাঁড়াতেন।
কল্পনা করুন, মাথায় হেলমেট নেই, শিন গার্ড নেই, অ্যাবডুমেন গার্ড নেই; একটা লোক খালি হাতপায়ে ব্যাটসম্যানের শরীর থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরে দাড়িয়ে আছে ক্যাচ নেওয়ার জন্য। সোলকারকে বলা হয় ইতিহাসে সবচেয়ে বেশী ঝুঁকি নেওয়া ফিল্ডার।
ভগবত চন্দ্রশেখর সোলকারের এই ফিল্ডিংয়ের বর্ননা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘একনাথ আজকের দিনের গেলমেট পড়া শর্ট লেগ ফিল্ডারদের চেয়ে আরও দু ধাপ এগিয়ে দাঁড়াত। সে ব্যাটসম্যানের শরীরের ওপর দাঁড়াত বলতে পারেন। ওখানে দাড়িয়ে বলটা ব্যাট পার হয়ে না যাওয়া অবধি অনুসরণ করতো। একবারও বলের ওপর থেকে চোখ সরাতো না।’
আচ্ছা, ফিল্ডার সোলকারের কথা তো গেল। এবার একটু ‘সোবার্স’ বিষয়ক আলোচনা হোক।
রেকর্ড আপনাকে ঠিক বোঝাতে পারবে না যে, সোলকার ব্যাটে ও বলে কতোটা কার্যকর ছিলেন। ২৭ টেস্টে ২৫৪২ গড়ে ১০৬৮ রান করেছেন; একটি সেঞ্চুরি আছে। আর এই সময়ে ১৮টি উইকেট নিয়েছেন। আজকের অলরাউন্ডারদের তুলনাতেও বেশ সাদামাটা। কিন্তু ভারতের অন্তত দুটি ঐতিহাসিক জয়ের নায়ক ছিলেন সোলকার।
১৯৭০-৭১ সালের ওই পোর্ট অব স্পেনেই সিরিজের একমাত্র টেস্টে রেজাল্ট হয়েছিল। আর ওটা জেতাতেই ফিফটি করার পাশাপাশি ৬ ক্যাচ নিয়ে অসামান্য ভূমিকা রেখেছিলেন সোলকার। এরপর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওই বছরই ওভালে ম্যাচ জেতানোর অন্যতম নায়ক ছিলেন সোলকার। ৪৪ রান করেছিলেন, ৩ উইকেট নিয়েছিলেন এবং ৩টি ক্যাচ নিয়েছিলেন।
সোলকার বোলার হিসেবে যতটা যোগ্য ছিলেন, তার বহি:প্রকাশ ঠিক ঘটাতে পারেননি। চার স্পিনারের কথা বলা হলেও ভারত তখন নিয়মিত খেলতো তিন স্পিনার নিয়ে। বেদীদের টপকে শেষ অবধি সোলকারের হাতে বল খুব একটা আসতো না। আবার ব্যাটেও পছন্দের পজিশন খুব একটা পেতেন না। ফলে দুর্দান্ত একজন অলরাউন্ডার হলেও তার সেরাটা ভারত পেয়েছে, এমন দাবি করা যাবে না।
আচ্ছা, ‘অলরাউন্ডার’ সোলকারের আরেকটা গুনের কথা বলা হয়নি।
সেই যুগে তিনি ভারতের সেরা ছিলেন স্লেজিং করার জন্য। ওই ব্যাটসম্যানের শরীরের ওপর দাড়িয়ে তাকে সমানে উত্যক্ত করে যাওয়া এবং ব্যক্তিগত সব আলাপ জুড়ে দেওয়ায় তার জুড়ি ছিল না। ওরকম গায়ের ওপর দাড়িয়ে একবার বয়কটকে বলছিলেন, ‘বোলাররা না, তোমাকে আমিই নেব।’
বুঝতে পারছেন, কেনো তাকে বাজপাখি বললাম!