পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম সেরা দু’জন খেলোয়াড়দের জন্মভূমি আর্জেন্টিনা। একজন ডিয়েগো ম্যারাডোনা আরেকজন লিওনেল মেসি। যাদের দু’জনের পায়েই ছিল অসাধারণ জাদু, ত্রিশের কোটা পেরোনো মেসির সে জাদু এখনো কমেনি বিন্দুমাত্র।
দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনা, ফুটবল অঙ্গনে বরাবরই প্রভাবশালী। তাঁদের খেলার মান, খেলোয়াড়দের ফুটবলীয় শৈলীতে মুগ্ধ ইউরোপের বাঘা বাঘা দলগুলো সমীহ করে আসছে শুরু থেকেই।
চলুন আজ মেসি, ম্যারাডোনার মত দুই কিংবদন্তির দেশ, তিন বারের বিশ্বকাপ জয়ী দলের সর্বকালের সেরা একাদশ সাজানোর প্রচেষ্টা করা যাক। আজকের ফরমেশন ৪-৩-৩। পৃথিবী বিখ্যাত অধিকাংশ কোচদের পছন্দের এই ফরমেশনকে মাথায় রেখেই একাদশ সাজাতে চলেছি।
- গোলরক্ষক: উবালদো ফিলোল
একটি দলের জয়ে একজন গোলরক্ষকের দায়িত্ব বা গুরুত্ব অপরিসীম। আলবেসেলেস্তাদের সর্বকালের সেরা একাদশে গোলরক্ষকের দায়িত্বের গ্লাভস তুলে দেওয়া যায় উবালদো ফিলোলের হাতে। তিনি আর্জেন্টিনার হয়ে তিনটি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
তিনি তাঁর অনবদ্য পারফর্মেন্স দিয়ে দলকে ১৯৭৮ এর বিশ্বকাপ জয়ে সহয়তা করেন এবং নিজে জিতে নেন টুর্নামেন্টের সেরা গোলকিপারের খেতাব। তিনি তাঁর ক্যারিয়ারে ৫৮ ম্যাচ আর্জেন্টিনার গোলবারের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁকে ল্যাতিন আমেরিকার ইতিহাস সেরা গোলরক্ষক বলে গণ্য করা হয়।
- রক্ষণ: সিলভিও মারজোলিনি – ড্যানিয়েন পাসারেল্লা – অস্কার রুগেরি – হ্যাভিয়ের জ্যানেত্তি
চার জন ডিফেন্ডার নিয়ে গড়া এই রক্ষণ দূর্গের বাম পাশের ফুলব্যাক সিলভিও মারজোলিনিকে রক্ষণ সামলানোর পাশাপাশি আক্রমণের সহয়তা করবার দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। তিনি ১৯৬২ এবং ১৯৬৬ বিশ্বকাপে নিজের নাম লিখিয়েছিলেন সেরা টুর্নামেন্ট সেরা একাদশের লেফটব্যাক হিসেবে। তিনি আর্জেন্টিনার আকাশী নীল জার্সিতে ২৮ ম্যাচে অংশগ্রহণ করে একটি গোল করেছেন।
তাঁকে সর্বকালের সেরা একাদশে জায়গা দিতে গিয়ে আড়াল থেকে চোখ রাঙানি হজম করতে হয়েছে ১৯৭৮ এর বিশ্বকাপ জয়ী লেফটব্যাক আলবের্তো তারানতিনির। খেলোয়াড় হিসেবে এরা দু’জনই বিশ্বমানের তাঁদের দু’জনকেই রাখা গেলে ভাল হত। কিন্তু তা আর করা গেল না।
আর্জেন্টিনা দলের এই একাদশে অধিনায়কের দায়িত্বের পাশাপাশি রক্ষণ দূর্গ আগলে রাখার জন্য ড্যানিয়েল পাসারেল্লার বিকল্প খুঁজে পাওয়া বেশ দুষ্কর। তাঁর নেতৃত্ব গুণের পাশাপাশি তাঁর খেলোয়াড়ি নৈপুণ্য তাঁকে এই দলে জায়গা দেবে কোন প্রকার টালবাহানা ছাড়াই।
তিনি ১৯৭৮ বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সেবার আর্জেন্টিনা জিতেছিল বিশ্বকাপ। তিনি ছিলেন অদম্য এবং সত্যিকার অর্থেই একজন নেতা, যিনি মাঠ ও মাঠের বাইরে সব সময় চেষ্টা করেছেন খেলোয়াড়দের উজ্জীবিত রাখতে।
তাছড়া একজন সেন্ট্রাল ব্যাক হিসেবেও তিনি আক্রমণে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতেন। তিনি ছিলেন ডিফেন্ডার হিসেবে ক্লাব ফুটবলে গোলদাতাদের তালিকার শীর্ষে। এছাড়াও তিনি আর্জেন্টিনার হয়ে ৭০ ম্যাচে ২২ গোল করেছেন।
পাসারেল্লার যোগ্য সঙ্গী হতে পারেন অস্কার রুগেরি। ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জয়ে রক্ষণকে নিজের ছোট্ট ছেলে হিসেবে বুকে করে আগলে রেখেছিলান অস্কার রুগেরি। ১৯৯১ এবং ১৯৯৩ কোপা আমেরিকা জেতার পেছনে রুগেরির অবদান অনস্বীকার্য। তিনি রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে এক মৌসুম অংশ নিয়ে জিতেছিলেন সেরা বিদেশী খেলোয়াড়ের খেতাব। আকাশী নীল জার্সিতে তাঁর গোল সংখ্যা সাত অংশ নিয়েছিলেন ৯৭ ম্যাচে।
রাটব্যাক হাভিয়ের জানেত্তি। ইন্টার মিলান ক্লাবের কিংবদন্তি জানেত্তি ছিলেন ইতালিয়ান ক্লাবটির অধিনায়কও। দু:খের বিষয় আর্জেন্টিনার হয়ে ১৪৫ ম্যাচে অংশগ্রহন করা এই অসাধারণ খেলোয়াড় জেতেননি কোন আন্তর্জাতিক ট্রফি। কিন্তু ইন্টার মিলান ক্যারিয়ার সুসজ্জিত বিভিন্ন শিরোপা দিয়ে।
শিরোপার বিচারে নয়, জানেত্তি সর্বকালের সেরা একাদশে জায়গা করে নিয়েছেন তাঁর খেলা দিয়ে, পাশাপাশি তাঁর নেতৃত্ব গুণ তাঁকে ভাইস-ক্যাপ্টেন ভূমিকাতেও দিব্যি জায়গা করে দেবে।
- মধ্যমাঠ: ডিয়েগো সিমিওনে – হ্যাভিয়ের মাশ্চেরানো – ডিয়েগো ম্যারাডোনা
একজন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার রেখে দুইজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার সংবলিত এই একাদশের দুইজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে ডিয়েগো সিমিওনে ও হ্যাভিয়ের মাশ্চেরানো এর বিকল্প আর্জেনটিনা ইতিহাসে খুব একটা নেই।
স্প্যানিশ লিগের জায়েন্ট দল আতলেটিকো মাদ্রিদের সফলতার পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন ডিয়েগো সিমিওনে। তাঁর খেলোয়াড়ি জীবনে তিনি ছিলেন অনবদ্য। তাঁর পজিশনিং স্কিল, তাঁর দৃড় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মনোভাব তার পাশাপাশি সুশৃঙ্খল স্বভাব তাঁকে সর্বকালের সেরা একাদশে জায়গা করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
এছাড়াও তাঁর অর্জনের ঝুলিতে দুইটি কোপা আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপার পাশাপাশি রয়েছে আলবিসেলেস্তাদের হয়ে এগারো গোলের সুখস্মৃতি। অন্যদিকে, হ্যাভিয়ের মাশ্চেরানোকে বাদ দিয়ে আর্জেন্টিনার সর্বকালের সেরা একাদশ সাজানোটা একটা দুরূহ বিষয়।
তাছাড়া তাঁর মত একজন নিবেদিত প্রাণ খেলোয়াড়কে বাদ দেওয়া তাঁকে অপমান করা ব্যতীত আর কিছুই নয়। তিনি আর্জেন্টিনার হয়ে ম্যাচে কতবার রক্তাক্ত হয়েও মাঠ ছেড়ে যাননি তাঁর হিসেব করা দায়।
দীর্ঘ ১৫ বছরের আর্জেন্টিনা ক্যারিয়ারে এই খেলোয়াড় দু’টো অলিম্পিক গোল্ড মেডেল জিতেছেন আর রয়েছে ২০১৪ বিশ্বকাপ হারের মত বেশ কিছু অধরা শিরোপার আক্ষেপ। তিনি আর্জেন্টিনার হয়ে ১৪৭ ম্যাচে অংশ নিয়ে করেছেন তিন গোল। কিন্তু সাধারণত গোল করানো এবং আক্রমণ সাজানোতেই ছিল তাঁর মন।
এটাকিং মিডফিল্ডে থাকবেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। বিশ্ব ফুটবলে আর্জেন্টিনা যাদু ছড়িয়ে দিয়েছিলেন যিনি তিনিই ‘দ্য ম্যাজিকাল ম্যারাডোনা।’ তাঁর একক নৈপুণ্যে আর্জেন্টিনা জিতেছিল ১৯৮৬ এর বিশ্বকাপ। তাঁর ড্রিবলিং যেন কোন এক কবিতার মত নান্দনিক, ছন্দময়। তিনি খেলা সাজানোর কারিগর। অনায়াসে জায়গা করে নেবেন যেকোন সেরা একাদশে নিঃসন্দেহে। তাঁর কাঁধেই আর্জেন্টিনার সর্বকালের সেরা একাদশে আক্রমণ সাজানোর দায়িত্বভার দেওয়াই শ্রেয়।
- আক্রমণভাগ: মারিও কেম্পেস- গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা- লিওনেল মেসি
৪-৩-৩ ফরমেশনে লেফট উইং এ জায়গা পাবেন মারিও কেম্পেস। যদিও তিনি খেলেছেন স্ট্রাইকার হিসেবে। তবে বাতিস্তুতাকে সেন্ট্রাল ফরোয়ার্ড থেকে সড়িয়ে নেওয়াটা কঠিন কাজ। তাই একাধারে একটি টুর্নামেন্টে গোল্ডেন বল, গোল্ডেন বুট জেতা কেম্পেসকে লেফট উইং থেকে আক্রমণ শানিত করবার দায়িত্ব নিতে হচ্ছে।
লেফট উইঙ্গারের পাশাপাশি তিনি ‘ফলস নাইন’ রুপেও বেশ কার্যকরী হতে পারেন এই একাদশে। ১৯৭৮ এর বিশ্বকাপের ফাইনালে দুই গোল করে শিরোপা জয়ের মূল কারিগর কেম্পেস ছিলেন সোজাসাপ্টা একজন স্ট্রাইকার, যিনি তাঁর গোল করার দায়িত্বে ছিলেন অনড়। তিনি তাঁর গতি দিয়ে বহুবার ভেদ করেছেন প্রতিপক্ষের রক্ষণ।
সেন্ট্রাল স্ট্রাইকারের দায়িত্বে এই একাদশে থাকবেন আর্জেন্টিনার সর্বকালের সেরা স্ট্রাইকার গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা। যিনি খুব বেশি পরিচিত ছিলেন ‘বাতিগোল’ নামে। আকাশী নীল জার্সিধারীদের হয়ে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ডটা এখনও তাঁর দখলেই রয়েছে।
৫৬ গোল করা এই স্ট্রাইকার তিনিটি বিশ্বকাপ খেলে করেছেন দুইটি হ্যাট্রিক। তাঁর ফিনিশিং পারদর্শীতা ছিল সত্যিকার অর্থেই প্রসংশনীয়, তাঁর শক্তিশালী হেড করবার ক্ষমতা এবং নির্ভুল ফ্রি-কিক গুলো ছিল দেখার মত। তাই তিনিই আর্জেন্টিনার সর্বকালের সেরা একাদশের স্ট্রাইকার।
রেকর্ড ছয় বার ব্যালন ডি অর জেতা লিওনেল মেসিকে ভাষায় সংজ্ঞায়িত করতে গেলে শব্দের ভাণ্ডারে অভাব দেখা দেবে। আর্জেন্টিনা তথা ফুটবলের ইতিহাসের মহারাজা লিওনেল মেসি নিতে পারেন এই একাদশের রাইট উইংগারের দায়িত্ব। ক্যারিয়ারের একটা বড় সময় জুড়ে এই পজিশনে খেলেছেন মেসি।
বার্সেলোনাতে থাকাকালীন মেসি-সুয়ারেজ-নেইমার ত্রয়ীর সময়ে মেসি খেলেছিলেন রাইট উইং পজিশনে। তাই তাঁর উপর আক্রমণের এই দায়টুকু ছেড়ে দিয়ে ইতি টেনে নিলাম আর্জেন্টিনার সর্বকালের সেরা একাদশ তালিকার।
তর্কের বিশেষ জায়গা তেমন নেই। তবুও সকল তর্কের ঊর্ধ্বে গিয়ে এমনটাই হয়ত হত অধিকাংশ আর্জেন্টাইন সমর্থকদের সর্বকালের সেরা একাদশ। এই বাইরে হয়ত অদূর ভবিষ্যতে কেও একজন জায়গা করে নেবেন এই একাদশে। সেই প্রত্যাশা করতেই পারেন অনেকে।