সে এক রূপকথারই দেশ

ক্লাব ফুটবলের কারণে ফুটবলারদের পুরো মৌসুম কাটাতে হয় ব্যস্ততা মাঝে। নিজেকে কিংবা পরিবারকে সময় দেবার ফুসরত পান না তারা। কখনো কখনো পরিবারকে ছেড়ে থাকতে হয় দূর পরবাসে।

গ্রিসের ফুটবলার তাকিস ফাইসাসের অবস্থাটাও এরকম। পতুর্গিজ ক্লাব বেনফিকায় খেলার সুবাদে থাকতে হয় পরিবার থেকে অনেক দূরে; লিসবনে। অবশেষে ২০০৩ মৌসুমের শেষের দিকে ভাবলেন আর নয়, মৌসুম শেষে পাওয়া ছুটি কাজে লাগিয়ে মিসেস ফাইসাস বানাবেন দীর্ঘদিনের বান্ধবী ক্রিস্টিনাকে। যেই ভাবা সেই কাজ, ক্রিস্টিনাকে বলতেই রাজি হয়ে গেলেন। বিয়ের তারিখ নির্ধারিত হল ৯ জুলাই, ২০০৩।

হঠাৎ বেঁকে বসলেন ক্রিস্টিনা। সেবারের ইউরোর ফাইনাল যে ৫ জুলাই। যদি ফাইসাসের খেলতে হয় সেখানে। শুনে হেসেই উড়িয়ে দিলেন ফাইসাস। বললেন গ্রুপপর্বের তিন ম্যাচ খেলেই ধরবেন বাড়ি ফেরার টিকিট। তাতে আশ্বস্ত হলেও মনের খুঁতখুঁতানি ভাবটা রয়েই গেল ক্রিস্টিনার।

কথা রাখতে পারেননি ফাইসাস; ফিরতে পারেননি ২০ তারিখে। তাকে খেলতে হয়েছিল সেবারের ফাইনালটা। বাড়ি ফিরেছিলেন বিয়ের ঠিক একদিন আগে। তাতে অবশ্য ক্রিস্টিনা একটুও রাগ করেননি। ফাইসাস আর তার সতীর্থরা যে বিয়ের উপহার হিসেবে যে নিয়ে এসেছিলেন ইউরোর ট্রফিটা।

গ্রিসের নাম শুনলে প্রথমেই মাথায় আসে আফ্রোদিতি, হেরাক্লিস, অ্যাথেনার কথা কিংবা প্লেটো – অ্যারিস্টটলের বিখ্যাত দ্য অ্যাকাডেমির কথা। ক্রীড়ামোদীরা মনে রাখেন অলিম্পিকের জন্মস্থল হিসেবে। কিন্তু ফুটবলের জন্য? সবাই চমকে উঠবেন। না না, গ্রিস আর ফুটবল দুটো যে একসাথে কখনোই যায় না। গ্রিস ফুটবলে দারুণ দল একথা গ্রিসের সবচেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষীও বোধহয় কখনো বলবেন না। অথচ এই গ্রিসের হাত ধরেই রচিত হয়েছিল ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় রূপকথার।

১৯৯৪ বিশ্বকাপে খেলা ছাড়া তখনো পর্যন্ত গ্রিসের আর কোনো সাফল্য ছিল না ফুটবলে। এমনকি বিশ্বকাপে জয় তো দূরে থাক, প্রতিপক্ষের জালে কোনো গোলও দিতে পারেনি তারা। ২০০১ সালে অটো রেহাগেল যখন কোচ হিসেবে নিয়োগ পেলেন তার উপরে তাই প্রত্যাশার কোনো চাপ ছিল না।

রেহাগেল দায়িত্ব নিয়েই খেয়াল করলেন গ্রিসের ফুটবলাররা শারীরিকভাবে বেশ লম্বা-চওড়া এবং শক্তিশালী। তাই তিনি প্রথাগত পাসিং কিংবা কাউন্টার অ্যাটাকিং ফুটবল না খেলিয়ে দলকে খেলাতে শুরু করলেন ক্রসনির্ভর ফুটবল। দলে দুজন ওয়াইড মিডফিল্ডার থাকবেন যারা কিনা ক্রসের পর ক্রস ফেলবেন আর সেগুলো কাজে লাগানোর জন্য আছেন দীর্ঘদেহী ফরোয়ার্ড। টোটকাটা কাজে লেগে গেল, ২১ বছর পর ইউরো খেলার সুযোগ পেল গ্রিস।

কিন্তু ইউরো শুরুর আগে পরের রাউন্ডে যাবার আশা মিইয়ে গেল গ্রিসের, স্পেন এবং পর্তুগালের সাথে একই গ্রুপে পড়েছে তারা। দুরুদুরু বুকে প্রথম ম্যাচে লুই ফেলিপে স্কলারির পর্তুগালের মুখোমুখি হয় তাঁরা। সদ্যই ব্রাজিলের হয়ে বিশ্বকাপ জেতা স্কলারি তখন পর্তুগালের দায়িত্বে।

রোমারিওকে ছাড়াই বিশ্বকাপ জিতে দেখিয়েছেন নিজের ক্যারিশমা। এছাড়া পর্তুগাল দলেও তখন তারকার ছড়াছড়ি। অভিজ্ঞ লুইস ফিগো, রুই কস্তা, ডেকো, নুনো গোমেজের পাশাপাশি ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, হেল্ডার পোশ্চিগাদের মতো তরুণ প্রতিভা।

কিন্তু সবাইকে অবাক করে প্রথম ম্যাচেই কারাগোনিস এবং বাসিনাসের গোলে পর্তুগালকে ২-১ গোলে হারায় গ্রীস। চমক অব্যাহত থাকে দ্বিতীয় ম্যাচেও। স্পেনের বিপক্ষে ফার্নান্দো মরিয়েন্তেসের গোলে পিছিয়ে পড়লেও চ্যারিস্তিয়াসের গোলে ১-১ গোলে ড্র করে। কিন্তু যখন সবাইকে অবাক করে দ্বিতীয় রাউন্ড খেলার স্বপ্ন দেখছে পুরো গ্রীসবাসী, তখনই তুলনামূলক দুর্বল রাশিয়ার কাছে হেরে বসে তারা।

গ্রুপপর্বের তিন ম্যাচ শেষে স্পেন এবং গ্রীসের পয়েন্ট দাঁড়ায় সমান ৪। গোল পার্থক্য এবং মুখোমুখি লড়াইতে ফলাফল ড্র থাকায় সৃষ্টি হয় গড়মিল। অবশেষে নানা হিসেবের মারপ্যাঁচে গোল বেশি করার সুবাদে কোয়ার্টার ফাইনালে উত্তীর্ণ হয় তারা।

কোয়ার্টার ফাইনালে তারা মুখোমুখি হয় মহাপরাক্রমশালী ফ্রান্সের। সোনালি সময় ফেলে আসলেও অঁরি-জিদান-থুরাম-ভিয়েরা-বার্থেজদের নিয়ে গড়া ফ্রান্সকে টপকানো পাহাড়সম ছিল গ্রীসের কাছে। কিন্তু লিসবনের আলভালাদে স্টেডিয়ামের সেদিন দেখা মিলেছিল অন্য এক গ্রিসের।

বারবার ফরাসি আক্রমণ আছড়ে পড়লেও থেমে যাচ্ছিলো নিকোপলিডিস নামের এক বাঁধার সামনে। বলকে যিনি পেতে দেননি জালের স্পর্শ। উল্টো ৬৬ মিনিটে কর্নার থেকে পাওয়া এক বল থেকে দারুণ হেডে গোল করে সবাইকে স্তব্ধ করে দেন চ্যারিস্তিয়াস। বহু চেষ্টার পরও তাই ম্যাচে ফিরতে পারেনি ফরাসিরা।

সেমিফাইনালে গ্রীকরা মুখোমুখি হয় টুর্নামেন্টের আরেক চমক চেক প্রজাতন্ত্রের। মিলান বারোস নামক এক পরশপাথরের স্পর্শে যেন জেগে উঠেছে চেকরা। আর সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সেনাপতি বারোস। প্রতিপক্ষ নিয়ে ছেলেখেলা করে ইতোমধ্যে ৫ গোল করে পেয়েছেন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতার আসন।

কিন্তু সেমিতে বারোসকে যেন নড়তেই দিলেন না সেরিতারিদিয়াস, পুরোটা সময় রাখলেন কড়া মার্কিংয়ে। ফলাফলস্বরূপ নখদন্তহীন চেক আক্রমণ চিন্তায় ফেলতে পারলো না গ্রিকদের। ট্রাইয়ানোস ডেলাসের অতিরিক্ত সময়ের গোলে ম্যাচ জিতে নেয় গ্রীস।

অবশেষে ফাইনাল। স্বপ্নের ফাইনাল। শুরুর মতো ফাইনালের প্রতিপক্ষও পর্তুগাল। রূপকথার মতো তিন সপ্তাহের শেষটা কি হবে খুশির নাকি পরিণতিটা হবে বিয়োগান্তক। অন্যদিকে পর্তুগাল খেলবে স্বাগতিক দর্শকদের সামনে, নিজেদের চেনা মাঠে। ম্যাচের আগে কোচ রেহাগেল কি বলেছিলেন শিষ্যদের সেটা বোধহয় কেউই জানেন না। কিন্তু মাঠে দেখা গিয়েছিল প্রত্যয়ী এক গ্রিসকে। পর্তুগিজদের সাঁড়াশি আক্রমণ তারা সামলাচ্ছিল দাঁতে দাঁত চেপে।

অবশেষে ৫৭ মিনিটে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ডানপ্রান্তে কর্নার পেল গ্রিস। সেখান থেকে জিয়ানোকোপুলোসের ভাসানো বল গ্রিপ করতে কিছুটা এগিয়ে এলেন পর্তুগিজ গোলরক্ষক রিকার্ডো। কিন্তু বল ধরার ঠিক আগে মাথা ছুঁইয়ে দিলেন চ্যারিস্তিয়াস, হতভম্ভ রিকার্ডো আবিস্কার করলেন বল জড়িয়ে গেছে জালে। ৬২ হাজার দর্শকের লিসবন স্টেডিয়ামে তখন পিনপতন নীরবতা।

সবাই যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে, ভুলে গেছে কথা বলতে। অতিরিক্ত সময়ের তিন মিনিট শেষে জার্মান রেফারি মার্কাস মের্ক যখন খেলা সমাপ্তির বাঁশি বাজালেন ততক্ষণে ট্রফির গায়ে খোদাই করা হয়েছে গ্রীসের নাম। টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন গ্রিসের অধিনায়ক থিওদোরোস জাগোরাকিস।

গ্রিসের পরের পরিণতিটা বিয়োগান্তক। পরের ইউরোতে আর কোনো ম্যাচই জিততে পারেনি তারা। ফলাফলস্বরূপ বাদ পড়ে গ্রুপপর্ব থেকেই। তবে তিন সপ্তাহের সেই অনবদ্য ফুটবল ইতিহাসে স্থান করে দিয়েছেন অটো রেগালের গ্রীসকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link