গাই হুইটাল, বন্য শিকারির বিপন্ন অতীত

সেই গাই হুইটাল এখন কি করেন? শুনলে চমকে উঠবেন। তিনি এখন পুরাদস্তুর শিকারি। রীতিমত পেশাদার শিকারি। গাইয়ের বাবা জিমি হুইটাল বেশ খ্যাতিমান শিকারি। গাইয়ের জন্মও বন্য পরিবেশে। আসলে বন ছেড়ে বরং শহরে মানিয়ে নিতেই গাই হুইটালের বেশ ঝক্কি পোহাতে হয়েছে। তিনি আবার শিকড়ে ফিরেছেন, শিকারি বনেছেন। চান ছেলে জেমসও পারিবারিক এই পেশাটাই বেছে নেবে। ক্রিকেট কেন নয়? প্রশ্নটা শুনলে নিশ্চয়ই হুইটাল হাসবেন। মুখে না বললেও মনে মনে হয়তে বলবেন, ‘জিম্বাবুয়েতে ক্রিকেট খেলে লাভটাই বা কি!

এখন জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট বললে আপনার মাথায় যেই চিত্রটি আসে আমি ঠিক সেটার কথা বলছি না। গাই হুইটাল যখন এসেছিলেন তখন জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট পাড় করছে তাঁদের সোনালি সময়। অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ার, হিথ স্ট্রিক কিংবা নিল জনসনদের যেই সোনালি প্রজন্ম তাঁদের অন্যতম অংশ গাই জেমস হুইটাল। হাঁটুর ইনজুরির কারণে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারটা খুব বেশি লম্বা না হলেও তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে একজন নিখুঁত অলরাউন্ডার হবার সব গুণই তাঁর ছিল।

ঠিক সেই সময়টা যখন জিম্বাবুয়ের প্রতিটি স্কুলে পড়াশোনা ও খেলাধুলা সমানতালে চলে। বছর শেষে ফাইনাল পরীক্ষা নিয়ে যতটা চাপ অনুভূত হত, ঠিক ততটাই উত্তেজনার পারদ জমতো আন্ত:স্কুল প্রতিযোগিতাতে। ঠিক সেই সময়ে এক কৃষক পরিবার থেকে উঠে আসেন গাই হুইটাল। হুইটাল তাঁর স্কুল ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ছিলেন। পাশাপাশি হকি ও রাগবি দলেরও গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন তিনি।

রাগবিটা শুধু স্কুল পর্যায়ে খেলেছেন সেটা বললে অন্যায় হবে। শুধু শখের বসে খেলতে খেলতে রাগবি জাতীয় দলেও খেলে ফেলেছিলেন তিনি। ১৯৯৫ রাগবি বিশ্বকাপের বাছাই পর্বের দলেও ডাক আসে তাঁর। তবে স্কুল থেকেই তাঁর ভালবাসার জায়গা ক্রিকেট। ১৬ বছর বয়সে জাতীয় স্কুল ক্রিকেট দলের হয়ে ইংল্যান্ড ও নিউজল্যান্ড সফর করেছিলেন। সেই সময় তাঁদের কোচ ছিলেন ডেভিড হটন।

মাত্র ১৮ বছর বয়সেই জিম্বাবুয়ের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও অভিষিক্ত হন তিনি। সেই সময় মূলত ব্যাটসম্যান হিসেবেই বেশি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন হুইটাল। পরের বছরই ১৯৯৩ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন তিনি। করাচিতে নিজের অভিষেক টেস্টেই করেছিলেন ৩৩ রান। পাশাপাশি ওই টেস্টে নিয়েছিলেন বাসিত আলীর উইকেট।

জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের ইতিহাসে হুইটালের নামটা চিরকাল থাকবে। ১৯৯৫ সালে নিজের ষষ্ঠ টেস্ট ম্যাচ খেলতে নেমেছেন আবার সেই পাকিস্তানের বিপক্ষে। এবার ঘরের মাঠে হারারে স্পোর্টস ক্লাবে। পাকিস্তানের বিপক্ষে আগে ব্যাট করতে নেমে ৫৪৪ রানের বিশাল সংগ্রহ গড়ে জিম্বাবুয়ে।

ফ্লাওয়ার বার্দার্সের সেঞ্চুরির পর তাঁদের সাথে যোগ দেন হুইটালও। খেলেন ১৯২ বলে ১১৩ রানের অপরাজিত ইনিংস। এরপর পাকিস্তান ৩২২ ও ১৫৮ রানে অল আউট হয়ে গেলে নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথম জয় পায় জিম্বাবুয়ে। সেটি গাই হুইটানেরও আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি।

দুই বছর পর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তাঁর একমাত্র ডাবল সেঞ্চুরির দেখা পান হুইটান। সেবার খেলেন ২০৩ রানের অপরাজিত এক ইনিংস। হুইটালের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের যেই চারটি টেস্ট সেঞ্চুরি করেছেন তাঁর তিনটিতেই ছিলেন অপরাজিত।

ইনিংস গুলো যথাক্রমে ১১৩*, ২০৩*, ১৮৮* ও ১১৯ রানের। অর্থাৎ এই চার ইনিংসে হুইটাল ৬২৩ রান করেছেন ঠিক ৬২৩ ব্যাটিং গড়েই। যা ক্রিকেট ইতিহাসের অন্য কোন ব্যাটসম্যানের নেই। তাঁর পরে আছেন বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়ক মুমিনুল হক যার সেঞ্চুরি ইনিংস গড় ৫৩৮।

মূলত মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে আসলেও পরে নিজের বোলিং সক্ষমতাকেও প্রমাণ করেছেন হুইটাল। এই মিডিয়াম পেসার জিম্বাবুয়েকে এনে দিয়েছিলেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ উইকেট। জিম্বাবুয়ের হয়ে খেলা ৪৬ টেস্টে তাঁর ঝুলিতে আছে ২২০৭ রান।

যেখানে চারটি সেঞ্চুরি ও দশটি হাফ সেঞ্চুরিও আছে। ওদিকে বল হাতেও নিয়েছেন ৫১ উইকেট। টেস্টে তিনবার চার উইকেট নিলেও কখনো পাঁচ উইকেট পাননি। তাঁর ক্যারিয়ার সেরা বোলিং ফিগার এসেছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। সেই ইনিংসে মাত্র ১৮ রান দিয়েই তুলে নিয়েছিলেন চার উইকেট।

জিম্বাবুয়ের হয়ে ১৪৭ টি ওয়ানডে ম্যাচও খেলেছিলেন এই অলরাউন্ডার। ওয়ানডে ক্রিকেটে কোন সেঞ্চুরি না থাকলেও ১১ টি হাফ সেঞ্চুরি নিয়ে করেছেন ২৭০৫ রান। পাশাপাশি এই ফরম্যাটে নিয়েছেন ৮৮ টি উইকেট।

ওদিকে ফ্লিল্ডার হিসেবেও দেশটির অন্যতম সেরা ছিলেন হুইটাল।২০০০ সালে জিম্বাবুয়ের একমাত্র ফিল্ডার হিসেবে এক ওয়ানডে ম্যাচে চারটি ক্যাচ নেয়ার রেকর্ড করেন। সব মিলিয়ে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের এক ব্যান্ডেল প্যাকেজ ছিলেন হুইটাল। ইনজুরির কারণে ২০০৩ সালেই মাত্র ২৯ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারটা শেষ না হয়ে গেলে হয়তো বিশ্ব ক্রিকেটেরও অনন্য এক প্রাপ্তি হয়ে থাকতেন হুইটাল।

তা, সেই গাই হুইটাল এখন কি করেন? শুনলে চমকে উঠবেন। তিনি এখন পুরাদস্তুর শিকারি। রীতিমত পেশাদার শিকারি। গাইয়ের বাবা জিমি হুইটাল বেশ খ্যাতিমান শিকারি। গাইয়ের জন্মও বন্য পরিবেশে। আসলে বন ছেড়ে বরং শহরে মানিয়ে নিতেই গাই হুইটালের বেশ ঝক্কি পোহাতে হয়েছে। তিনি আবার শিকড়ে ফিরেছেন, শিকারি বনেছেন। চান ছেলে জেমসও পারিবারিক এই পেশাটাই বেছে নেবে।

ক্রিকেট কেন নয়? প্রশ্নটা শুনলে নিশ্চয়ই হুইটাল হাসবেন। মুখে না বললেও মনে মনে হয়তে বলবেন, ‘জিম্বাবুয়েতে ক্রিকেট খেলে লাভটাই বা কি!’

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...