বেশ প্রসিদ্ধ এক প্রবাদ আছে। ‘প্রেমে ও রণে সবই চলে’। ফুটবল যেমন প্রেমময় মধুর অনভূতি জোগায়। সেই ফুটবলই আবার রক্তপাতের মঞ্চায়ন ঘটায়। আর রণক্ষেত্রে থাকেনা কোন নিয়ম। তাইতো হ্যান্ডবল শাস্তিযোগ্য হলেও, ফুবটল ইতিহাসের পাতায় কিছু কিছু হ্যান্ডবল হয়ে আছে অমর।
- দিয়াগো ম্যারাডোনা (আর্জেন্টিনা বনাম ইংল্যান্ড)- ১৯৮৬
নিঃসন্দেহে বিশ্বকাপের সবথেকে জনপ্রিয় হ্যান্ডবলটি এসেছে দিয়াগো ম্যারাডোনার হাত থেকে। ১৯৮৬ ফুটবল বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে এই ঘটনাটি ঘটে। এই আর্জেন্টাইনের করা হ্যান্ডবলটি সকল ফুটবল প্রেমীদের মাঝে চির স্মরণীয় হয়ে আছে এখনও, ভবিষ্যতেও থাকবে নিশ্চয়ই।
ম্যাচটি দ্বিতীয়ার্ধেও ০-০ গোলে সমতায় চলছিল। ইংল্যান্ডের খেলোয়াড় স্টিভ হজ বলটি ভালোভাবে ক্লিয়ার করতে ব্যর্থ হন। ম্যারাডোনা সেই বলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে বলটিকে গোলকিপার পিটার শিলটনের মাথার উপর দিয়ে বাম হাতে পাঞ্চ করে জালে জড়ান। এমনকি হ্যান্ডবলটি রেফারির তীক্ষ্ম নজরও এড়িয়ে যায়।
ম্যাচটি শেষ পর্যন্ত ২-১ গোলে আর্জেন্টিনা জিতে যায়। পরবর্তীতে সেই বিশ্বকাপও হয়েছিল আলবি সেলেস্তাদের। ম্যারাডোনা পরবর্তীতে জানিয়েছেন যে সেই গোলটি হওয়ার জন্য স্বয়ং ঈশ্বর তার হাত দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। এই গোলটি ‘দা হ্যান্ড অফ গড’ নামে পরিচিত।
- লুইস সুয়ারেজ (উরুগুয়ে বনাম ঘানা)- ২০১০
২০১০ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উরুগুয়ে মুখোমুখি হয়েছিল ঘানা। ম্যাচটি পুরো ৯০মিনিট জুড়েই ছিল উত্তেজনায় পরিপূর্ণ। কিন্তু ম্যাচটি অতিরিক্ত সময়ে গড়ানোর পর এক অন্য স্তরে পৌঁছে যায়।
ম্যাচটি ১-১ গোলের সমতায় চলছিল। ঘানা খুব তোড়জোড় লাগিয়ে দিয়েছিল গোল করার জন্য। ১২০ মিনিটের মাথায় লুইস সুয়ারেজ গোল লাইনে একটি শট হাত দিয়ে আটকে দেন। এই হ্যান্ডবলের কারণে সুয়ারেজকে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়তে হয়।
ঘানা একটি পেনাল্টিও পেয়ে যায়। সুয়ারেজ অশ্রুসজল চোখ নিয়ে মাঠ ত্যাগ করেন। তিনি ভেবেছিলেন হয়তো তার জন্য উরুগুয়ে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়বে। কিন্তু ভাগ্য সেদিন সুয়ারেজের পক্ষে ছিল। ঘানার খেলোয়াড় আসামোয়া জিয়ান পেনাল্টিকে গোলে পরিণত করতে ব্যার্থ হন। ফলে খেলাটি টাইব্রেকারে গড়ায় এবং উরুগুয়ে ম্যাচটি জিতে যায়।
- লুইস ফাবিয়ানো (ব্রাজিল বনাম আইভরি কোস্ট)- ২০১০
ব্রাজিল ফরোয়ার্ড লুইস ফবিয়ানো ২০১০ বিশ্বকাপে আইভরি কোস্টের বিপক্ষে একটি গোলের জন্য একবার নয় পর পর দু’বার হাতের সহয়তা নেন। ব্রাজিলের দ্বিতীয় গোলটি তৈরি করার সময় এই ঘটনাটি ঘটে।
ফাবিয়ানো যখন সেন্টার লাইনে ফিরে যাচ্ছিলেন তখন রেফারি তাকে জিজ্ঞেস করে যে হ্যান্ডবল হয়েছে কিনা। তখন ফাবিয়ানো সরাসরি অস্বীকার করেন।
- টরস্টেন ফ্রিংগস (জার্মানি বনাম যুক্তরাষ্ট্র)- ২০০২
২০০২ সালের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচে যুক্তরাষ্ট্র জার্মানির উপর ভালোভাবেই চড়াও হওয়ার চেষ্টা করছিল। তবে প্রথমার্ধের শেষের দিকে মাইকেল ব্যালাক একটি হেডের মাধ্যমে ১-০ গোলে ম্যাচে এগিয়ে যায় জার্মানি। যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয়ার্ধে বেশ চাপ প্রয়োগ করছিল। তারা খেলায় সমতায় আনার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।
ঠিক তখন যুক্তরাষ্ট্র একটি কর্নার পায়। কর্নার থেকে বলটি উড়ে আসে মার্কিন খেলোয়াড় গ্রেগ বারহাল্টারের দিকে। তিনি বলটি গোলের দিকে লাথি মারেন। বলটি অলিভার কানের গায়ে লেগে গোলের ভেতরে যাচ্ছিল। তখন টরস্টেন ফ্রিংগসের হাতে লেগে বলটি পুনরায় অলিভার কানের হাতে চলে যায়। পরবর্তিতে ম্যাচটি ১-০ গোলেই জার্মানি জিতে যায়।
- কার্লোস সানচেজ (কলম্বিয়া বনাম জাপান)- ২০১৮
২০১৮ বিশ্বকাপে কলম্বিয়ার প্রথম ম্যাচেই একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। প্রথম তিন মিনিটের মাথায় জাপানের বিপক্ষে কার্লোস সানচেজ লাল কার্ড দেখে মাঠ থেকে বেরিয়ে যান। ইউইউ ওসাকোর একটি শট সেভ করেন গোলকিপার ডেভিড অসপিনা। ফিরতি বলটি গিয়ে পড়ে শিনজি কাগওয়ার পায়ে। তিনি বারে শট চালান। তার এই বলটি সানচেজ হাত দিয়ে ঠেকান। ফলে তাকে লাল কার্ড দেখে চলে যেতে হয় মাঠের বাইরে।
সাবেক অ্যাস্টন ভিলার এই মিডফিল্ডার বিশ্বকাপ ইতিহাসের দ্বিতীয় দ্রুততম রেড কার্ড দেখা খেলোয়াড়। তার এই হ্যান্ডবলের কারণে জাপান পেনাল্টি পায় এবং গোল করতেও সক্ষম হয়।
এই ঘটনাগুলো ফুটবল বিশ্বকাপের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। হ্যান্ডবল একটি সাধারণ নিয়ম লঙ্ঘন হলেও, কখনো কখনো তা ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেয় এবং ইতিহাস তৈরি করে। এই ঘটনাগুলো শুধু একটি খেলার নিয়ম ভঙ্গ নয়, বরং তা আবেগ, কৌশল, এবং ভাগ্যের মিশেলে ফুটবলের প্রতি মানুষের অমোঘ প্রেমের পরিচয় বহন করে।