আলোকিত/কলঙ্কিত জীবন ও মৃত্যু

বর্ণবৈষম্যের কালিমায় কলঙ্কিত দেশের ক্রিকেট।।কয়েকবছর হয়েছে আন্তর্জাতিক স্তর থেকে নিষিদ্ধ দেশ। কেউ জানেনা কবে আবার আন্তর্জাতিকে ফিরবে বহু অসাধারণ প্রতিভার জন্ম দেওয়া এই দেশ। কিন্তু স্বপ্ন দেখা ছাড়েননি অনেকেই, আশায় বুক বেঁধেছেন যে তাদের উত্তরসূরীরা বিশ্বমঞ্চে প্রতিভা আবার মেলে ধরবেন।

তেমনই একজন মানুষ এউই। নিজে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলেছেন একসময় চুটিয়ে। কিন্তু ওই কলঙ্কিত অধ‍্যায়ের পর হয়তো মন বসাতে পারেননি, তাই সরে এসেছেন। কিন্তু তিনি স্বপ্নের জাল বুনছেন নিজের দুই ছেলেকে নিয়ে।

ওই দুই ভাই তখন ব্লুমফনটেন শহরের অন‍্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গ্রে কলেজে বাবার স্বপ্ন সাকার করবার মহান ব্রতে ব্রতী। ক্রিকেট হোক কিংবা রাগবি – দুই খেলাতেই দুই ভাইয়ের অবাধ বিচরণ। ছোট ভাই আবার দলের অন‍্যতম প্রধান ক্রিকেটার ও অধিনায়ক।

ছেলেটি চাইলেই পারতো ওই অরাজকতার সময়ে ক্রিকেট ছেড়ে রাগবিকে নিজের পেশা করে তুলতে। কিন্তু পেশা কি কখনও স্বপ্নের থেকে বড়ো হতে পারে যেখানে তার বাবার ইচ্ছে জড়িয়ে আছে, যেখানে গ্রে কলেজের প্রধান শিক্ষককে দেওয়া কথা জড়িয়ে আছে, ‘ক্রিকেটের মক্কা লর্ডসে খেলার সুযোগ পেলে বিমানের টিকিট পাঠিয়ে দেবে আপনাকে।’

ফ্রি স্টেট ক্রিকেট দলের (তৎকালীন অরেঞ্জ ফ্রি স্টেট) হয়েই প্রথম শ্রেণীতে অভিষেক, ১৮ বছর বয়সে। যে দলের হয়ে ভাই ফ্র্যান্স আগে খেলতেন, বাবা এউই খেলেছিলেন ষাটের দশকে। ২১ বছর বয়সে ১৯৯১ সালে তিনি সেই দলেরই অধিনায়ক হয়ে গেলেন।

স্কুলেই গড়ে ওঠা শিক্ষা, পরিশ্রম, নিয়মানুবর্তিতা নামক গুণগুলো সাহায্য করেছিল। বাংলাদেশের সাবেক কোচ এডি বারলো তখন সে দলের কোচ। অধিনায়ক হয়েই অরেঞ্জ ফ্রি স্টেটকে সেবার ‘কুরি কাপ’ এ রানার্স-আপ বানিয়েছিলেন, জিতিয়েছিলেন সীমিত ওভারের টুর্নামেন্টেও। ব‍্যাটিং-অলরাউন্ডার পরিচিত বাড়লো তাঁর।

অন‍্যদিকে ২২ বছর পর সমস্ত প্রতিকূলতা সরিয়ে বিশ্বক্রিকেটে ফেরানোর তোড়জোড় হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকাকে। নতুন ভাবে নতুন স্বপ্ন, নতুন প্রতিভা নিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটে ফিরে এলো তারা। ফিরে আসার পরের বছর বিশ্বকাপের দলে ডাক পেলেন ওই তরুণ অলরাউন্ডার, যদিও তখনো আন্তর্জাতিক ওয়ানডেতে অভিষেক হয়নি তাহার।

প্রথম বার অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হওয়া পঞ্চম বিশ্বকাপে আগের বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অভিষেক হল। টূর্নামেন্টে তিনি ১০০ এর কাছাকাছি রান ও ২ উইকেট নেন। দক্ষিণ আফ্রিকা সেমিফাইনালে পৌঁছালেও সাক্ষী হন ১ বলে ২২ রানের সেই অভাবনীয় ট্র্যাজেডির।

বিশ্বকাপের পর ‘নতুন’ দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম টেস্টের সদস্য হন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে। তখনকার সবচেয়ে শক্তিশালী দল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে জিততে জিততে হেরে গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা, শেষ দিনে ২০০ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে এক পর্যায়ে দক্ষিণ আফ্রিকার ছিল ২ উইকেটে ১২২ রান, সেখান থেকে মাত্র ১৪৮ রানে অল আউট হয়ে যায় প্রোটিয়ারা। যদিও বলার মতো তেমন পারফরম্যান্স দিতে পারেননি ওই তরুণ অলরাউন্ডার।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এরপর দুর্দান্ত আসতে শুরু করে তাহার কাছে। ভারতের বিপক্ষে ১৯৯২-৯৩ মৌসুমে ঘরের মাটিতে ওয়ানডে এবং টেস্ট সিরিজে দুই ফরম্যাটেই ব্যাটে-বলে তিনি ছিলেন অসাধারণ। টেস্টে নিজের ক্যারিয়ারের পঞ্চম ইনিংসে ৪১০ বলে ১৩৫ রান করে নির্বাসনের পর দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম জয় নিশ্চিত করেন তিনি।

১৯৯৪-৯৫ সেশনে অস্ট্রেলিয়া সফরের সিডনি টেস্টের আগে অধিনায়ক কেপলার ওয়েসেলসের চোট অধিনায়কত্বের ভার এসে পড়ে তাহার কাঁধে যেহেতু তিনি সহ-অধিনায়ক ছিলেন। নেতৃত্ব দেওয়ার অসাধারণ প্রতিভা নিয়ে জন্মানো তিনি তার প্রমাণ দেন অস্ট্রেলিয়াকে পাঁচ রানে হারিয়ে, যেখানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অ্যালান ডোনাল্ডকে সরিয়ে ফ‍্যানি ডি ভিলিয়ার্সের হাতে বল তুলে দেবার জন্য যিনি ৬ উইকেট তুলে দলের জয় নিশ্চিত করেন।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসে কিন্তু ছোটবেলায় প্রধান শিক্ষককে দেওয়া কথা ভুলে যাননি। ১৯৯৪ সালে ইংল্যান্ড সফরে প্রথম টেস্টটি হয়েছিল ক্রিকেটের মক্কা লর্ডসেই, আর সেই ম‍্যাচের জন্য বিমানের টিকিট সেই প্রধান শিক্ষকের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতেন, দক্ষিণ আফ্রিকাকে বিশ্বকাপ জেতাবেন।।১৯৯২ এর ‘বৃষ্টি ট্র্যাজেডি’র সময় খেলোয়াড় হিসেবে স্বপভঙ্গ হয়েছিল। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে তাহার অধিনায়কত্বেই অন‍্যতম দাবীদার হিসেবে শুরু করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা,কারণ আগের বছরই আইসিসি নকআউট ট্রফি তথা মিনি বিশ্বকাপ(চাম্পিয়ন্স ট্রফি) জিতেছে।।অসাধারণ ছিল সেই বিশ্বকাপে তাহারা।

আরেক কিংবদন্তি অলরাউন্ডার ল‍্যান্স ক্লুজনার সেই বিশ্বকাপে অসাধারণ পারফরম্যান্স দিচ্ছেন। এরপর এলো ১৯৯৯ এর ১৭ই জুন। শেষ উইকেটে শেষ ওভারে ৯ রান প্রয়োজন এমন সময় সেই ক্লুজনার যখন ফ্লেমিং এর প্রথম দুই বলে পরপর দুটো চার মেরে রান সমান করলেন তখন জিতে স্বপ্ন পূরণের শেষ ধাপটিতে পৌঁছাতে নিয়ে যাচ্ছেন তখনই অঘটন।

চতুর্থ বলে ব‍্যাটে লাগিয়েই ক্লুজনার এমন ছুটলেন যে উল্টোদিকে দাঁড়ানো ডোনাল্ড কিছুই বুঝতে পারলেন, স্বপ্নের পরিসমাপ্তি সেখানেই যা আজও পূরণ হয়নি। ১৯৯৮ সালের ঢাকার মাটিতে জেতা সেই আইসিসি নক আউট (চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি) তাই তার একমাত্র বড় শিরোপা, যা আবার দক্ষিণ আফ্রিকারও এখন পর্যন্ত একমাত্র বৈশ্বিক অর্জন।

সেই ফাইনালেও প্রথমে ২ উইকেট নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২৫০ এর কম রানে আটকে রান তাড়া করবার সময় আবার অপরাজিত অসাধারণ অর্ধশতরান করে দলের প্রথম আন্তর্জাতিক আইসিসি ট্রফি এনে দিয়েছিলেন।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মাত্র ৮ বছরের ক্যারিয়ারে অর্জন করেছিলেন অনেক কিছু। ৬৮টি টেস্ট ম্যাচে ৩৬ এর কাছাকাছি ব্যাটিং গড়ে ৩৭১৪ রানের পাশাপাশি শিকার করেছেন ৫০ এর কাছাকাছি টেস্ট উইকেট। অন‍্যদিকে ১৮৮ টি ওয়ানডে ম্যাচে ৩৮ এর বেশি ব্যাটিং গড়ে ৫,৫৬৫ রান করার পাশাপাশি শিকার করেছেন ১০০ এর বেশি উইকেট। যার বোলিং নিয়ে মহান শচীন টেন্ডুলকার পর্যন্ত বলেছিলেন, ‘তাঁর বোলিং মোকাবেলা করা ছিল বেশ কঠিন। ও বোলিংয়ে এলে বুঝতে পারতাম না, কী করব?’

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এমন কৌশলী, বুদ্ধিদীপ্ত, ক্ষুরধার অধিনায়ক অনেকের চোখেই সবার উপরে থাকবেন। অধিনায়ক হিসেবে তার পরিসংখ্যান সে কথাই বলে। দক্ষিণ আফ্রিকাকে ১৮টি টেস্ট সিরিজে নেতৃত্ব দিয়ে জয় পেয়েছেন ১৩টি সিরিজে,যার বিপরীতে পরাজয় মাত্র ৪টি সিরিজে।

সংখ্যার হিসেবে ৫৩ ম‍্যাচে ২৭টি জয়, ১১টি হার। ওয়ানডেতে ১৩৮ ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়ে ৯৯টি জয় এনে দিয়েছেন দলকে, পরাজিত হয়েছেন ৩৫ টি ম্যাচে। যদি আরও খেলতে পেতেন তবে এই পরিসংখ্যান যে আরও উন্নত হতো তা বলবার অপেক্ষা রাখে না।

শুধুমাত্র পরিসংখ্যান দেখেই কাউকে বিচার করা সম্ভব নয়। তিনি এমন এক ক্রিকেটার যিনি নিজের সময়ের থেকে এগিয়ে ছিলেন তা ক্রিকেটার কিংবা অধিনায়কত্ব দুক্ষেত্রেই। আর এই ভাবেই হয়ে উঠলেন দেশ বিদেশের সমর্থকদের আদর্শ তথা নায়ক‌‌।

কিন্তু সবকিছু ভেঙে চুরে চুরমার হয়ে গেলো ২০০০ দক্ষিণ আফ্রিকার ভারত সফর ও ইংল্যান্ড সফরে।।যে ট্র‍্যাজেডিতে নড়ে গেলো পুরো বিশ্ব। ধুরন্ধর’ ক্রিকেট মস্তিস্কের যে এমন ‘অপব্যবহার’ করবেন তা কে ভেবেছিলো। জড়িয়ে গেলেন ম্যাচ ফিক্সিং। ক্রিকেট বিশ্বের ওপর যেন ভেঙে পড়লো আকাশ!

ক্রিকেট থেমে গেল, জীবন তো আর নয়! এরপর একটি স্নাতকোত্তর কোর্সে ভর্তি হন। ২০০২ সালে যোগ দেন স্টক এক্সচেঞ্জের তালিকাভুক্ত এক কোম্পানীতে জোহানেসবার্গে। সপ্তাহজুড়ে থাকতেন জোহানেসবার্গেই, আর সপ্তাহের শেষে ফিরতেন জর্জে, স্ত্রী বার্থার কাছে। তেমনই এক দিন ছিল ২০০২ সালের জুন মাসের ১ তারিখ, ক্রিকেট হয়তো তখন আর তাহার কিছুই মনে করায় না।

তুষারপাতের কারণে রাস্তায় আটকা পরে ফ্লাইট মিস করলেন। পরে এক কার্গো বিমানে দুই পাইলট বন্ধুর সাথে ভ্রমণের ব্যবস্থা হলো। পাইলট বহু বছরের অভিজ্ঞ।।জর্জ বিমানবন্দরের কাছাকাছি এসে পরিচিত আবহাওয়ায় মেঘের মাঝে পথ হারিয়ে ফেললেন সেই পাইলট। সঠিকভাবে অবতরণ হল না। ঠিক যেমন ওয়েসেল জোহানেস হ্যান্সি ক্রনিয়েও হঠাৎ জুড়ে আসা মেঘে ব্যর্থ হয়েছিলেন ক্রিকেট-জীবনের সঠিক রানওয়েতে অবতরণ করতে।

ক্রনিয়ে ক্রিকেট থেকে ফুরিয়ে গিয়েছিলেন আগেই, এবার জীবন থেকেই হারিয়ে গেলেন।।এক খলনায়কের জীবনগাঁথার পরিসমাপ্তি যিনি হয়তো হতে পারতেন এক অসাধারণ নায়ক, হয়তো এখনো নায়কই আছেন, নাহলে মৃত্যুর ২ বছর পরেও কেন দক্ষিণ আফ্রিকার সেরা মানুষদের তালিকার ভোটে ১১ নং স্থান পাবেন। খলনায়কের মত বিদায়ের পরও তাঁর সম্মান বিশ্বজুড়ে আজো কমেনি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link