আমরা কমেন্ট্রি বক্সে এখন প্রায়শই তিনজনকে একই সময়ে ধারাভাষ্য দিতে দেখি। দু’জনের একসাথে দেয়া তো অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। কিন্তু একটা সময় একটা টেস্ট ম্যাচের পুরো পাঁচদিন জুড়ে ধারাভাষ্য দিতেন একজনই।
হার্শা ভোগলে বলছিলেন, তাঁর আইডল এ. এফ. এস তালিয়ারখানের কথা। সামনে একটা গ্লাসে হুইস্কি নিয়ে বসে একা একা টেস্ট ম্যাচগুলোর পুরো পাঁচদিন ধারাভাষ্য দিতেন তালিয়ারখান। কারও সাথে কমেন্ট্রি বক্স শেয়ার করাতেও আপত্তি ছিল তাঁর।
একা কমেন্ট্রি বক্সে বসে ধারাবিবরণী দেয়া বেশ শক্ত কাজ, ‘নট এভ্রিওয়ান্স কাপ অফ টি’। উনিশ বছরের যুবক হার্শা ভোগলে বসে আছেন অল ইন্ডিয়া রেডিও’র হায়দ্রাবাদ স্টুডিও তে। তখন তাঁকে ঠিক যুবক বলা চলে না। তার চাইতেও কম বয়স। রঞ্জি ট্রফিতে মুখোমুখি হায়দ্রাবাদ আর কেরালা। চা বিরতির সময় এগিয়ে আসছে। হার্শা ভাবছেন, চা বিরতির সময় যে একটা কাজ করতে পারবেন, সেটা হল স্কোরকার্ড পড়া।
সেশন শেষ হল। পাশে বসে যে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি ধারাভাষ্য দিচ্ছিলেন, উনি বাঁধালেন বিপত্তি। নিজেই দ্রুত স্কোরকার্ড পড়ে বেরিয়ে গেলেন কমেন্ট্রি বক্স থেকে। যাওয়ার সময় বলে গেলেন, ‘ওভার টু হার্শা ভোগলে।’
এখন কী করবেন হার্শা? হাই আসলে হাই তুলতে পারবেন না, না পারবেন হাঁচি আসলে হাঁচি দিতে। কেননা টি ব্রেকের পুরোটা সময় থাকতে হবে অন এয়ারে। বুঝুন কতটা কঠিন!
আরেকবার এমন ঘটনা ঘটল ১৯৮৮ সালে। হার্শার বয়স তখন ২৭। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে চেন্নাই টেস্টে ধারাভাষ্য দেবার সুযোগ আসল। এর আগে ’৮৪ তে একবার আর ’৮৬ তে একবার টেস্ট ম্যাচে ধারাভাষ্য দিয়েছেন। একদম অভিজ্ঞতা নেই যে, তা বলা যায়না। তবে অভিজ্ঞতার ঝুলি তেমন ভারিও নয়।
তিনদিন আগে থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন, কখন কীভাবে কোথায় কী বলবেন। হঠাৎই প্রযোজক তাকে ডেকে বললেন, ‘প্ল্যানে একটু চেঞ্জ হয়েছে। তোমাকে ধারাভাষ্য দিতে হবে রেডিও ত্রিনিদাদে।’ হার্শা বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি আর কে?’ প্রযোজক জবাব দিলেন, ‘তুমিই।’
সেসময় এখনকার মত ছয় ঘন্টা খেলা না হয়ে সাড়ে পাঁচ ঘন্টা হত। পোস্ট-টি অর্থাৎ ইভিনিং সেশন হত দেড় ঘন্টার। সময় ব্যবধানের জন্য রেডিও ত্রিনিদাদ শেষ দুই ঘন্টা ধারাভাষ্য শোনাত। অর্থাৎ হার্শাকে ধারাভাষ্য দিতে হবে দ্বিতীয় সেশনের শেষ দশ মিনিট, টি ব্রেকের বিশ মিনিট আর পুরো ইভিনিং সেশন।
হার্শা জিজ্ঞেস করলেন, ‘টি ব্রেকে কী করব?’ প্রযোজক বললেন, ‘চা খেয়ো।’ শেষমেশ তৃতীয় দিন থেকে একজন সহ-ধারাভাষ্যকার নিয়োগ দেয়া হয়। বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা ধারাভাষ্যকারের শুরুটা এভাবেই।
তারও কিছু সময় আগের ঘটনা। একটা ম্যাগাজিনের জন্য শচীন টেন্ডুলকারের একটা ইন্টারভিউ করবেন হার্শা। টম অল্টারের বিখ্যাত সেই ইন্টারভিউয়ের কিছু পরের ঘটনা। শচীনের ভাই অজিত টেন্ডুলকার শচীনকে সেই ইন্টারভিউয়ের জন্য দুটো ছবি পাঠালেন।
ইন্টারভিউ ছাপা হল ‘আ বয় অ্যাহেড অব হিস টাইম’ শিরোনামে। লেখার জন্য পারিশ্রমিকের পাশাপাশি তাঁকে আলাদা ২০০ রূপি দেয়া হল ছবি দুটোর জন্য। তো হার্শা ভাবলেন, ছবির জন্য টাকা তো তার প্রাপ্য নয়। কী করলেন, ২০০ রূপির একটা চেক লিখে অজিতের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলেন।
লেখার প্রথম অংশে একা ধারাভাষ্য দেয়ার কথা বলছিলাম। আমার কাছে শচীনের বিদায়ী টেস্ট ম্যাচে হার্শার দেয়া সেই ৫-৬ মিনিটের ধারাভাষ্য সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রিকেট ধারাভাষ্য। ইয়ান বিশপ ছিলেন তখন তার সাথে। বিশপ মাইক্রোফোনটা নামিয়ে রাখলেন ৷ হার্শাকে বললেন, ‘গো অ্যাহেড, ইটস ইওর মোমেন্ট!’
সেদিন নিশ্চয়ই একা ধারাভাষ্য দেয়াটাকে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ মনে হয়নি হার্শা ভোগলের।