হাশিম আমলা, আ ট্রু জেন্টেলম্যান

ক্রিকেট ইজ আ জেন্টলম্যানস গেম- সম্ভবত ক্রিকেটের এই চিরায়ত উক্তিটির পূর্ণতা দিয়েছিলেন তিনিই। চাল চলনের নির্লিপ্ততায় নিজভূমে কিংবা পরভূমে, গোটা ক্রিকেট বিশ্বে সাড়া জাগিয়েছিলেন। অনুভূতির প্রশস্তময় ভাবনার জগতে অন্তত ভাবতে বাধ্য করেছিলেন, এভাবেও ক্রিকেটটা খেলে বাইশ গজ আন্দোলিত করা যায়, সহস্র মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হওয়া যায়, হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়া যায়। বলছি হাশিম আমলার কথা।

দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে জন্ম। কিন্তু হাশিম আমলার পুর্ব পুরুষরা আবার ভারতীয়। তাঁর দাদা ছিলেন গুজরাটের সুরাট শহরের বাসিন্দা। পরবর্তীতে আমলার দাদার তিন ছেলে থিতু হয়েছেন তিন ভিন্ন দেশে। হাশিম আমলার বাবা হয়ে যান দক্ষিণ আফ্রিকার বাসিন্দা। আর সেখান থেকেই হাশিম আমলার বেড়ে ওঠা, বাইশ গজের ক্রিকেটে পদার্পণ।

হাশিম আমলার ক্রিকেট ক্যারিয়ারটা শুরু হয়েছিল স্কুল ক্রিকেট দিয়ে। সেই ধারাবাহিকতায় বয়সভিত্তিক ক্রিকেটেও সুযোগ পেয়ে যান দ্রুতই। ২০০১ সালে ডাক পান দক্ষিণ আফ্রিকার অনূর্ধ্ব-১৯ দলে। আর ২০০২ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে প্রোটিয়াদের অধিনায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি আমলাকে। ঘরোয়া ক্রিকেটে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের সুবাদে ডাক পান জাতীয় দলেও। ভারতের বিপক্ষে সিরিজ তাঁর টেস্ট অভিষেক হয়।

কিন্তু শুরুটাই হলো ফ্যাকাসে। অভিষেকটা রাঙাতে পারলেন হাশিম আমলা। অভিষেক টেস্টে তো ব্যর্থ হলেনই, পরপর তিন টেস্ট ধরে রানের দেখা পেলেন না। তাই দল থেকে ছিটকে গেলেন অভিষেকের রেশ না ফুরোতেই।

হাশিম আমলা এরপর ফিরলেন প্রায় দেড় বছর পর। আর সেই দীর্ঘ বিরতির পরই দুর্দান্ত এক মোড় নেয় হাশিম আমলার ক্যারিয়ার। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রত্যাবর্তনের সে ম্যাচে খেললেন ১৪৯ রানের একটি ইনিংস। ব্যাস। ঐ এক ইনিংসেই বাজিমাত করে ফেলেন আমলা। এরপর সেই যে আমলা অধ্যায় শুরু হলো তার শেষটা হলো এক যুগ পর। দীর্ঘ এ ক্যারিয়ারে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে খেললেন ১২৪ টি টেস্ট।

২৮ সেঞ্চুরি আর ৪ ডাবল সেঞ্চুরিতে ক্যারিয়ার সাজালেন ৯২৮২ রানের। দশ হাজার রানের মাইল ফলকটা চাইলেই বোধহয় স্পর্শ করতে পারতেন। কিন্তু ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই যে একটা নিজস্ব নিয়ম মেনে এসেছেন আমলা। ‘কোথায় থামতে হবে তা জানা জরুরি’ আপ্ত এ বাণীকে মেনে হাশিম আমলা টেস্ট ক্রিকেট থেকে বিদায় নিয়েছিলেন ২০১৯ সালেই।

২০০৪ সালে টেস্ট অভিষেকের পর হাশিম আমলাকে শুধু টেস্ট স্পেশালিস্ট বলেই গণ্য করা হতো। কিন্তু তাঁর প্রতিভা তো রঙিন পোশাকের ক্রিকেটেও লুকিয়ে ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট বোর্ডের সেটি বুঝতে কিছুটা বিলম্ব হলো। ওয়ানডে ক্রিকেটে আমলা পা রাখলেন ২০০৮ সালে। অর্থাৎ টেস্ট ক্রিকেটের অভিষেকেরও প্রায় ৪ বছর পর প্রথম ওয়ানডে খেলতে নামেন আমলা। অভিষেক ওয়ানডে ম্যাচ খেললেন বাংলাদেশের বিপক্ষে। কিন্তু ঐ টেস্টের মতোই ওয়ানডে ক্যারিয়ারের শুরুটাও হলো বাজে। অবশ্য সেখান থেকে ঘুরেও দাঁড়ালেন দ্রুতই। ওয়ানডে অভিষেকের প্রথম বছরেই পেলেন সেঞ্চুরি।

এরপরের সময়টা শুধুই আমলার। টেস্ট ক্রিকেটে তো আগে থেকেই দুর্দান্ত ছিলেন। সেই রেশটা তিনি টেনে এনেছিলেন ওয়ানডে ক্রিকেটেও। ম্যাচের পর ম্যাচ রান করে গিয়েছেন, তিন অঙ্কের ম্যাজিক্যাল ফিগারকে বলতে প্রায় নিজের অভ্যাস বানিয়ে ফেলেছিলেন। ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাস দ্রুততম ব্যাটার হিসেবে ২০০০, ৩০০০, ৪০০০, ৫০০০, ৬০০০ আর ৭০০০ রানের মাইল ফলক করার রেকর্ড গড়েছিলেন। তাতে করে নিজেকে একদম ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

এমনকি রান কিংবা সেঞ্চুরি সব কিছুতেই একটা সময় পর্যন্ত বিরাট কোহলিকে টেক্কা দিচ্ছিলেন তিনি। কোনো কোনো সময় আবার বিরাটকেও ছাপিয়ে গিয়েছিলেন। ২০১০ সাল থেকে অবসরের আগ পর্যন্তও সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের তালিকায় তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর উপরে ছিলেন শুধুই কোহলি। তবে কোহলি, আমলার চেয়ে সে সময়ের রানে এগিয়ে ছিলেন ম্যাচ বেশি খেলার কল্যাণে।

ওয়ানডেতে নিজের এমন দাপুটে ফর্মের কারণে যে টেস্টে আবার ম্লান হয়ে গিয়েছিলেন- এমনটি একটুও হয়নি আমলার বেলায়। বরং দুই ফরম্যাটেই সমানতালে রান করতেন। বরং এর মাঝে টেস্টে তিনি একটি ট্রিপল হান্ড্রেডও মেরেছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে সেটিই একমাত্র ট্রিপল সেঞ্চুরির ঘটনা। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২০১২ সালে সেই অপরাজিত ৩১২ রানের ইনিংস খেলার পথে আমলা ক্রিজে সময় কাটিয়েছিলেন  ১৩ ঘন্টা ১০ মিনিট!

হাশিম আমলার সময়ে টেস্ট ক্রিকেটে রাজত্ব করতেন কুমার সাঙ্গাকারা আর শিবনারায়ণ চন্দরপলরা। সেই তাদের সাথে প্রায় সমান গতিতে এগিয়ে গেছেন আমলা। ক্যারিয়ারের সেরা সময় পার করেছেন ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত। আর এ সময়ে দুই হাজার রান করেছেন এমন ব্যাটারদের মধ্যে গড়ের দিক থেকে দ্বিতীয় সেরা ছিলেন তিনি। এমনকি গড়ে পিছনে ফেলেছিলেন সাঙ্গাকারাকেও।

টেস্ট, ওয়ানডে’র পর ক্রিকেটে আরেকটি পালক যোগ হলো। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট। ধুমধাড়াক্কা চার ছক্কার ক্রিকেটে ঠিকই মানিয়ে নিলেন ক্লাসিক্যাল এপ্রোচে ব্যাট করা হাশিম আমলা। ৪৪ টা আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন ক্যারিয়ারে। তাতে ১৩২ স্ট্রাইক রেটে ১২৭৭ রান। আইপিএলে খেলেছেন ১৬ টা ম্যাচ। আর তার মধ্যেই হাঁকিয়েছেন দুটি সেঞ্চুরি। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে সেখানে স্ট্রাইকরেট বেড়ে গিয়ে দাঁড়ালো ১৪৭ এ। আবার গড়টাও ধরে রেখেছিলেন দুর্দান্তভাবে, ৪৪,৩৮!

ওয়ানডে, টেস্ট এবং টি-টোয়েন্টি, তিন ফরম্যাটেই আধিপত্য দেখানো এক ব্যাটার হয়ে উঠেছিলেন হাশিম আমলা। কিন্তু ক্যারিয়ারটা যেমন বড় হওয়ার কথা ছিল তেমনটা আর হয়নি। ওয়ানডে ক্রিকেটে থেমেছেন ৮১১৩ রান করে, আর টেস্ট ক্রিকেটকে গুডবাই বলেছেন ক্যারিয়ারে ৯১৮২ রান যোগ করে।

চাইলেই একটু লম্বা করতে পারতেন ক্যারিয়ার। কিন্তু যতদিন হাশিম আমলা ‘হাশিম আমলা’ রূপে ছিলেন ঠিক ততোদিনই তিনি ক্যারিয়ার চালিয়ে গিয়েছেন। দলের কাছে বোঝা হয়ে ওঠার আগেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে ইতি টেনেছেন।

বাঁধাই করে রাখার মতোই এক ক্যারিয়ারের মালিক হতে পারতেন আমলা। কিন্তু কিছুটা ছন্দপতন আর তা হতে দেয়নি। ক্যারিয়ারের শেষ দিকে এসে খেই হারিয়ে ফেলেন তিনি। ১৮১ ম্যাচের ওয়ানডে ক্যারিয়ারটা তিনি শেষ করেছেন ৪৯.৪৭ রেখে। প্রায় পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই গড়। মন্দ কী! তারপরও এখানে আক্ষেপ আছে কিছুটা। কারণ ক্যারিয়ারের ১০০ ম্যাচ পর্যন্তও ওয়ানডে ক্রিকেটে তার ব্যাটিং গড় ছিল প্রায় ৬০। কিন্তু এরপর ক্রমাগত তা নিম্নগামী হয়েছে। হাশিম আমলা নিজেও বোধহয় এই নিম্নদিকে ধাবিত হওয়ার গ্রাফের চিত্রটা নিতে পারছিলেন না। তাই হুট করেই জানিয়ে দেন অবসরের ঘোষণা।

টেস্টের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। শেষ ১৪ টেস্টে নেই কোনো সেঞ্চুরি, নেই কোনো হাফসেঞ্চুরি। হাশিম আমলা বুঝে গেলেন, সময়টা ফুরিয়ে আসছে। অগত্যা লাল বলের ক্রিকেটটাকেও বিদায় জানিয়ে দিলেন।

তিন ফরম্যাট মিলে ক্যারিয়ারে ১৮৬৭২ রান। সাথে ৫৫ টা সেঞ্চুরি, ৪ টা ডাবল সেঞ্চুরি। ওয়ানডে এবং টেস্ট, দুই ফরম্যাটেই ৪৫ এর বেশি ব্যাটিং গড়। যে কোনো ক্রিকেটারের জন্যই স্বপ্নের মতো এক পরিসংখ্যান। হ্যাঁ, শেষটা আরো সুন্দর হতে পারতো। তাহলে হয়তো ক্যারিয়ারটা আরো সমৃদ্ধময় হতে পারতো। কিন্তু হাশিম আমলার জীবনবোধে এসব নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই। ক্রিকেটের ঊর্ধ্বেও তার যাপিত জীবনে আরো অনেক কিছু ছিল।

বরাবরই ধর্মভীরু হিসেবে পরিচিত ছিলেন হাশিম আমলা। টিম বাসে করে যাচ্ছেন, ছোট্ট পকেট কুরআন শরীফ নিয়ে চোখ বুলাচ্ছেন- এমন চিত্র মাঝে মধ্যেই দেখা যেত। পরিশীলিত জীবনবোধে টিমম্যাটদেরও মুগ্ধ করতেন। ক্রিকেটটা তাই দিনশেষে তাঁর কাছে স্রেফ একটা খেলাই ছিল। ক্রিকেটীয় শত অর্জনেও এজন্য তিনি নির্লিপ্ত থাকতেন। কারণ পরলোকের অর্জন নিশ্চিত করাটাই যে তাঁর কাছে সব সময় মুখ্য বিষয় ছিল। সে সবকে কেন্দ্র করেই দুরন্ত গতিতে ছুটে চলে গিয়েছেন হাশিম আমলা।

ক্রিকেট মাঠে নামতেন। কব্জির দারুণ মোচড়ে বল ঠেলে দিতেন। বোলারদের আগ্রাসন, উত্তাপ সব কিছুই যেন তাঁর কাছে নিরুত্তাপের মতো ছিল। বাইশ গজের ময়দানে কত ক্রিকেটারই তো মেজাজ হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু আমলা তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ার চালিয়ে গেছেন ঐ এক মেজাজেই, শান্ত, তটস্থ, স্মিত হাসির মিশেলে মুগ্ধ জাগানিয়া আচরণে। মাঠের সব আগ্রাসন দেখিয়েছেন ব্যাটে। বোলারদের চোখ রাঙানির জবাব দিয়েছেন তাঁর উইলো দিয়ে।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের পর ঘরোয়া ক্রিকেট চালিয়ে গিয়েছিলেন হাশিম আমলা। ২০২৩ এ এসে সেটিকেও এবার তিনি বিদায় বলে দিলেন। তাঁর বিদায় নিয়ে এক সময়ের সতীর্থ এ বি ডি ভিলিয়ার্স বলেছেন, ‘হাশিম আমলা এমন একজন চরিত্র যাকে নিয়ে গোটা একটা বই লেখা সম্ভব।’ একদম ঠিক তাই। কলামের শব্দসংখ্যার সীমাবদ্ধতায় হাশিম আমলাকে আর কতটুকুই ধারণ করা যায়। তাঁর জীবনবোধ নিয়ে সহস্র শব্দের জাল বোনা যায়। তাতেও বোধহয় পূর্ণতা আসে না।

যেমন ক্যারিয়ার তিনি রেখে গিয়েছেন তেমনটা করেই অনেক ক্রিকেটার খ্যাতি পেয়েছেন। ঠিক তেমন খ্যাতি হয়তো হাশিম আমলা পাননি। কিন্তু ঠিকই ক্রিকেট ইতিহাসে একটা নিজস্বতার ছাপ রেখে গেছেন তিনি। ক্রিকেট ইতিহাসে হাশিম আমলার নাম মানেই যে, কোনো রকম ভ্রু না কুঁচকে নির্দ্বিধায় সমস্বরে আদর্শ এক মানুষ কিংবা ক্রিকেটারের বেঞ্চমার্ক হিসেবে তাঁকে বসিয়ে দেওয়া যায়।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link