নি:সঙ্গ ও নিষিদ্ধ

বলা যায় অভিষেকের পর থেকেই জিম্বাবুয়ের বোলিং আক্রমণের নেতৃত্বটা বরাবরই ছিল স্ট্রিকের কাঁধে। বল হাতে অনেক ম্যাচেই তাঁকে দেখা গেছে ‘লোন ওয়ারিয়রের’ ভূমিকায়। উইজডেন বলছে, ‘স্ট্রিক দারুণ এক বোলার ছিলেন যিনি এক হাতে ভঙ্গুর একটা বোলিং আক্রমণ সামলেছেন।’

জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের সোনালী প্রজন্মের অন্যতম প্রতিনিধি হিথ স্ট্রিক। জিম্বাবুয়ের হয়ে টেস্ট এবং ওয়ানডে উভয় ফরম্যাটেই শতাধিক উইকেট লাভকারী ‘প্রথম’ ও ‘একমাত্র’ বোলার তিনি। সাড়ে চারশো’র বেশি (৪৫৫) আন্তর্জাতিক উইকেট নিয়ে দেশটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি বোলারের নামটাও হিথ স্ট্রিক!

১৯৭৪ সালের ১৬ মার্চ বুলাওয়েতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বলা যায় অভিষেকের পর থেকেই জিম্বাবুয়ের বোলিং আক্রমণের নেতৃত্বটা বরাবরই ছিল স্ট্রিকের কাঁধে। বল হাতে অনেক ম্যাচেই তাঁকে দেখা গেছে ‘লোন ওয়ারিয়রের’ ভূমিকায়। উইজডেন বলছে, ‘স্ট্রিক দারুণ এক বোলার ছিলেন যিনি এক হাতে ভঙ্গুর একটা বোলিং আক্রমণ সামলেছেন।’

একটা উদাহরণ না দিলেই নয়। ২০০৩ সালে ব্রিস্টলে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একটা ওয়ানডেতে জিম্বাবুয়ে অল আউট হয় মাত্র ৯২ রানে। এই মামুলি পুঁজি নিয়েই সেদিন একা হাতে লড়াই করেছিলেন হিথ স্ট্রিক। দুর্দান্ত এক ওপেনিং স্পেলে মাত্র ২৫ রানের মধ্যে ফেলে দিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের চার-চারজন টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানের উইকেট। স্ট্রিকের ৯ ওভারের স্পেলটা দাঁড়িয়েছিল এরকম, ৯-৩-২১-৪!

১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের বিপক্ষে করাচিতে তাঁর টেস্ট অভিষেক। অভিষেকে মনে রাখার মত কিছু করতে না পারলেও (০/৭৭) স্ট্রিক নিজের জাতটা চিনিয়েছিলেন ঠিক তার পরের ম্যাচেই। রাওয়ালপিন্ডিতে দুই ইনিংস মিলিয়ে নিয়েছিলেন ৮ উইকেট (৩/৫৮ ও ৫/৫৬)। ‘টু ডব্লু’র বিধ্বংসী বোলিংয়ে জয়ের খুব কাছে গিয়েও শেষ পর্যন্ত ৫২ রানে ম্যাচটা হেরে যায় জিম্বাবুয়ে।

১৯৯৫ সালে জিম্বাবুয়ের ইতিহাসে প্রথম টেস্ট জয়টা এসেছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে। ঐতিহাসিক হারারে টেস্টে স্বাগতিকরা জিতেছিল এক ইনিংস এবং ৬৪ রানে। অবিস্মরণীয় এই জয়ে বল হাতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হিথ স্ট্রিক, দুই ইনিংস মিলিয়ে তাঁর শিকার ছিল ৯ উইকেট।

গ্রান্ট ফ্লাওয়ার (২০১), অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার (১৫৬) আর গাই হুইটালের (১১৩) সেঞ্চুরিতে প্রথম ইনিংসে জিম্বাবুয়ে করেছিল ৫৪৪ রান। তবে হারারে স্পোর্টস ক্লাবের ফ্লাট ট্র্যাকে ‘শক্তিশালী’ পাকিস্তানকে দু’বার অলআউট করে জয় ছিনিয়ে আনাটা ছিল অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। যা কেবল সম্ভব হয়েছিল স্ট্রিক (৬/৯০ ও ৩/১৫), ব্রেইন (১/২৭ ও ৩/৫০) আর হুইটালের (২/৪৯ ও ৩/৫৮) দুর্দান্ত বোলিংয়ের সৌজন্যে। প্রথম ইনিংসে স্ট্রিকের ৯০ রানে ৬ উইকেটের স্পেলটাই মূলত ব্যবধান গড়ে দিয়েছিল ম্যাচে।

২-১ ব্যবধানে সিরিজ হারলেও সিরিজ সেরার ট্রফিটা উঠেছিল স্ট্রিকের হাতে। বিপক্ষ দলে ওয়াসিম, ওয়াকার, আকিব জাভেদের মত বোলার থাকা সত্ত্বেও সিরিজের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি ছিলেন স্ট্রিক; মাত্র ১৩.৫৪ গড়ে নিয়েছিলেন ২২ উইকেট।

মজার ব্যাপার হল, টেস্ট ক্যারিয়ারে কখনও ম্যাচ সেরার পুরস্কার না জিতলেও সিরিজ সেরার পুরস্কার জিতেছেন তিন-তিনবার!

  • ১৯৯৫ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৫৪ রান ও ১৩.৫৪ গড়ে ২২ উইকেট
  • ২০০০ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১২৮ রান ও ২০.২ গড়ে ১০ উইকেট
  • ২০০১ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে ১৫৪ রান এবং ১৫.৮২ গড়ে ১১ উইকেট

দীর্ঘ এক যুগের টেস্ট ক্যারিয়ারে স্ট্রিক ম্যাচ খেলেছেন ৬৫টি। ২৮.১৪ গড়ে উইকেট নিয়েছেন ২১৬টি যা জিম্বাবুয়ের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ম্যাচে কখনও ১০ উইকেট না পেলেও ইনিংসে ৫ উইকেট শিকার করেছেন ৭ বার।

১৯৯৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অভিষেকের পর থেকে ওয়ানডে খেলেছেন ১৮৯টি। ২৯.৮ গড়ে উইকেট নিয়েছেন ২৩৯টি; ইনিংসে পাঁচ উইকেট একবার আর ৪ উইকেট নিয়েছেন ৮ বার। টেস্টের মত ওয়ানডেতেও তিনি দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি।

ওয়ানডেতে স্ট্রিকের ক্যারিয়ার সেরা বোলিং ভারতের বিপক্ষে ৩২ রানে ৫ উইকেট, ১৯৯৭ সালে বুলাওয়েতে। স্ট্রিক হয়েছিলেন ম্যাচ সেরা আর জিম্বাবুয়ে জিতেছিল ৮ উইকেটে।

মূলত বোলার হলেও স্ট্রিকের ব্যাটের হাতও ছিল যথেষ্ট ভাল। ইতিহাসের সেরা ‘বোলিং অলরাউন্ডার’দের ছোট্ট তালিকায় তাই স্ট্রিককেও রাখেন অনেকেই। ক্যারিয়ার জুড়ে অসংখ্য বার তিনি দলের বিপদে রুখে দাঁড়িয়েছেন ব্যাট হাতে। লোয়ার অর্ডারকে আগলে রাখার পাশাপাশি দ্রুত রান তোলার কাজেও বেশ পারদর্শী ছিলেন তিনি।

উইজডেনের ভাষায়, ‘স্ট্রিক অসামান্য সক্ষম একজন ব্যাটসম্যান ছিলেন, যিনি বলটাকে ইন-ফিল্ডের ওপর দিয়ে আছড়ে ফেলতে ভালবাসতেন। তার ব্যাটিং জিম্বাবুয়ের লোয়ার-মিডল অর্ডারে শক্তি যোগাতো।’

৬৫ টেস্টে ২২.৩৫ গড়ে স্ট্রিকের সংগ্রহ ১৯৯০ রান। ১টি সেঞ্চুরির সাথে হাঁকিয়েছেন ১১টি ফিফটি। ক্যারিয়ার সেরা অপরাজিত ১২৭ রানের ইনিংসটা এসেছিল ২০০৩ সালে হারারেতে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। এছাড়া ওয়ানডেতে ১৩ ফিফটিসহ ২৮.২৯ গড়ে করেছেন ২৯৪২ রান। ক্যারিয়ার সেরা অপরাজিত ৭৯ রান, বিপক্ষ নিউজিল্যান্ড, ২০০১ সালে অকল্যান্ডের ইডেন পার্কে।

ওয়ানডেতে ব্যাটে-বলে স্ট্রিকের ক্যারিয়ার সেরা পারফরম্যান্সটা এসেছিল ২০০১ সালে সিডনিতে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে মাত্র ১৩৮ রান ডিফেন্ড করে জিতেছিল জিম্বাবুয়ে। ব্যাট হাতে দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৪৫ রানের ‘ক্যাপ্টেন্স নক’ খেলার পর বল হাতেও ৪ উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরা হয়েছিলেন স্ট্রিক।

স্ট্রিকের উদ্বোধনী স্পেলটাই (৮-৪-৮-৪) ছিল ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট। একে একে নিজের শিকারে পরিণত করেছিলেন ওয়াভেল হাইন্ডস (৮), রিডলি জ্যাকবস (৬), রিকার্ডো পাওয়েল (০) এবং লরি উইলিয়ামসকে (০)। হিথ স্ট্রিক (৪/৮), ব্রায়ান স্ট্র্যাং (৩/১৫) আর গাই হুইটালের (৩/১২) বিধ্বংসী বোলিংয়ে ক্যারিবীয়রা অল আউট হয় মাত্র ৯১ রানে।

ক্রিকেটের বাইবেল খ্যাত উইজডেন তাদের ম্যাচ রিপোর্টে লিখেছিল, ‘Streak bowled with relentless accuracy with the new ball; he moved the ball just enough to beat the bat or to find the edge.’

হিথ স্ট্রিক বল হাতে ক্যারিয়ারের সেরা সময়টা কাটিয়েছেন ২০০১ সালে। সে বছর ওয়ানডের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি বোলারদের তালিকায় ২য় স্থানে ছিলেন তিনি। ২৮ ম্যাচে ৪২ উইকেট নিয়ে ‘স্পিন জাদুকর’ মুত্তিয়া মুরালিধরনের (৫৬ উইকেট) ঠিক পরেই ছিলেন হিথ স্ট্রিক।

শুধু বোলিংই নয়, সে বছর ব্যাট হাতেও ছিলেন দুরন্ত ফর্মে। ৩ ফিফটিতে ৩২.৭১ গড়ে স্ট্রিকের ব্যাট থেকে এসেছিল ৫৫৬ রান। ওয়ানডেতে সর্বমোট ৮ বার ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতেছেন হিথ স্ট্রিক।

  • দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১০-১-২৫-৪ ও ২৯ রান, হারারে, ১৯৯৫
  • ভারতের বিপক্ষে ৮.৫-০-৩২-৫ ও ২টি ক্যাচ, বুলাওয়ে, ১৯৯৫
  • নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১০-১-৫৩-৩ ও ২১*(১১), বুলাওয়ে, ২০০০
  • নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৮-১-৩৪-২ ও ৭৯*(৬৭), অকল্যান্ড, ২০০১
  • ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৮-৪-৮-৪ ও ৪৫(৭০), সিডনি, ২০০১
  • নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ১০-১-৩৬-১ ও ৪৪*(২২), হারারে, ২০০৩
  • ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৯-০-৪৫-৩ ও ৬৫(৮১) , হারারে, ২০০৩
  • বাংলাদেশের বিপক্ষে ১০-১-৩০-৪ ও ৪৫(৬২), হারারে, ২০০৪

জিম্বাবুয়ের হয়ে সর্বমোট ২১ টি টেস্ট ও ৬৮ টি ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিয়েছেন হিথ স্ট্রিক। তবে জিতেছেন মাত্র ৪ টি টেস্ট এবং ১৮ টি ওয়ানডেতে। ক্যাপ্টেন্সি রেকর্ড ততটা সমৃদ্ধ না হলেও তাঁর নেতৃত্বগুণ, লড়াকু মানসিকতা এবং দায়িত্ববোধ ছিল প্রশংসার দাবিদার।

২০০৫ সালে খেলা ছাড়ার পর বেশ কিছুদিন ক্রিকেট থেকে দূরে ছিলেন স্ট্রিক। পরবর্তীতে অবশ্য বেছে নিয়েছেন পেশাদার কোচিং ক্যারিয়ার। ২০০৯-২০১৩ সাল পর্যন্ত জিম্বাবুয়ে ও ২০১৪-১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের পেস বোলিং পরামর্শকের দায়িত্ব পালন করেছেন কৃতিত্বের সাথে।

২০১৭ সালে নিজ দেশ জিম্বাবুয়ের হেড কোচ এবং ২০১৮ সালে ছিলেন আইপিএলের দল কলকাতা নাইট রাইডার্সের বোলিং কোচ।  কাউন্টি দল সমারসেটের বোলিং কোচের ভূমিকাতেও। দেখা মিলেছে তাঁর।

শেষ করব একটি ভিন্ন প্রসঙ্গ দিয়ে। একসাথে ম্যাচ খেলা আলোচিত পিতা-পুত্র জুটি ওয়েস্ট ইন্ডিজের শিবনারায়ন চন্দরপল ও তাঁর ছেলে ত্যাগনারায়ন চন্দরপলকে তো আপনারা সবাই চেনেন। তবে এই দু’জনের আগে সর্বশেষ কোন পিতা-পুত্র জুটির একসাথে ম্যাচ খেলার ঘটনাটা ছিল ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে।

জিম্বাবুয়ের ঘরোয়া টুর্নামেন্ট লোগান কাপের একটি লিস্ট-এ ম্যাচে হিথ স্ট্রিক ও তাঁর ৪৬ বছর বয়সী বাবা ডেনিস স্ট্রিক খেলতে নেমেছিলেন একই দলের হয়ে। ম্যাচটি অবশ্য হেরে গিয়েছিলেন তাঁরা।

ক্যারিয়ারে খুব পরিস্কার ইমেজই ছিল হিথ স্ট্রিক। সেটা তিনি ধরে রেখেছিলেন কোচিং জীবনের শুরুতেও। তবে, একটা ঝড় এসে যেন সব কিছুই এলোমেলো করে দিয়ে গেল। জুয়াড়ির সাথে মিলে ফিক্সিংয়ের সাথে জড়িত থাকার প্রমাণ মেলায় ৮ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হন হিথ স্ট্রিক।

জুয়াড়ির কাছ থেকে দুটি বিট কয়েন যা প্রায় ৭০ হাজার ডলার এবং একটি আইফোন নেওয়ায় স্ট্রিককে এই শাস্তি দেন আইসিসির দুর্নীতি দমন ইউনিট (আকসু)। আকসুর তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী হিথ স্ট্রিক ২০১৮ সালে আফগানিস্তান প্রিমিয়ার লিগ সহ জিম্বাবুয়ের বেশ কিছু সিরিজের তথ্য তিনি জুয়াড়িদের কাছে দিয়েছেন। সারা জীবনের কামানো সম্মান তিনি শেষ সময়ে এসে সব জলাঞ্জলি দিলেন।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...