আশার ফানুস উড়াই

গেল তিন বছর টেলিভিশন, অনলাইন এমনকি সশরীরে মাঠে বসে শামিম হোসেনের অনেকগুলা ম্যাচ দেখেছি। যদিও তিনি যে একজন মারকুটে ব্যাটসম্যান তার প্রমাণ পেয়েছি কেবল কয়েক মাস হলো।

শামিম হোসেন নামটার সাথে আমার পরিচয় ২০১৮ সাল থেকে। তখন বাংলাদেশে বসেছিল যুব এশিয়া কাপের সপ্তম আসর। ওই টুর্নামেন্টে গ্রুপপর্বের বাধা টপকে সেমির টিকেট কাটে বাংলাদেশ। তাই সেমিফাইনালের দিন একটা গুরুত্বপূর্ণ অ্যানাটমি ল্যাব থাকা সত্ত্বেও তা উপেক্ষা করে মিরপুরে ছুটে যাই শুধু নয়া যুব দলের সাথে পরিচিত হতে এবং কাছ থেকে তাঁদের খেলা দেখতে। কার্যত ওই এশিয়া কাপের মাধ্যমেই আমাদের বিশ্বকাপজয়ী যুবাদের একসঙ্গে পথচলার সূচনা ঘটে।

সেমিফাইনাল দেখতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত হাতেগোনা দুই-তিনজন যুবার নাম জানতাম আমি। তন্মধ্যে নওরোজ প্রান্তিক নাবিলের নামটাই বেশি শুনেছি। কারণ ইংরেজিতে সাবলীল বাচনবঙ্গির জন্য বর্তমানে বেশি পরিচিত এই ক্রিকেটার কিন্তু ব্যাটিংয়েও মন্দ নন।

এই যা! সেমি-সেমি করতে করতে প্রতিপক্ষের নামটাই তো বলা হয়নি! প্রতিপক্ষের নাম ভারত। শুধু ভারত বলায় ব্যাপারটা পানসে শোনাচ্ছে। বরঞ্চ বলা উচিত, বিশ্বকাপজয়ী ভারত। কেননা তাসমান পাড়ে ২০১৭ যুব বিশ্বকাপটা যে তাঁরাই বাগিয়ে নিয়েছিলেন।

সেমিফাইনালে আসা যাক। আসলে ২০১৮ যুব এশিয়া কাপের ওই ম্যাচটির কথা যত কম মনে করা যায়, ততই ভালো। মাত্র দুই রানে হারার পর ম্যাচ শেষে উইকেটের দুই প্রান্তে রাকিবুল ও মিনহাজুরের হাঁটু গেড়ে পড়ে থাকার করুণ দৃশ্যটা যে (প্রথম মন্তব্যে) এখনো চোখে ভাসে! তবে হৃদয়ভাঙার ওই ম্যাচে বেশ কটা ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সও ছিল চোখে পড়ার মতো।

মিরপুরের চিরাচরিত স্লো উইকেটে সেদিন রাজ করেছিলেন শরিফুল হক ও মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী। গতির পাশাপাশি হালকা ভেতরে ঢুকা ডেলিভারিগুলাতে ব্যাটারদের নাকাল করে মাত্র ২.৮৪ ইকোনোমিতে মৃত্যুঞ্জয় তুলে নেন ২ উইকেট। আর শরিফুল গতি ও বাউন্সারে ভারতীয়দের নাভিশ্বাস তুলে ১.৬০ ইকোনোমিতে ৩ উইকেট পকেটে পুরেন।

অন্যদিকে ব্যাটিংয়ে বলার মতো পারফরম্যান্স করেন শুধু আকবর আলী ও শামিম। ১৭৩ রানের লক্ষ্যে নেমে ৬৫ রানেই ৫ উইকেট হারিয়ে ধুঁকতে থাকা দলকে তাঁরা টেনে তুলেন ৬৫ রানের জুটি গড়ে। দুজনই পরিস্থিতির দাবি মেটাতে ধীরে ধীরে জুটি গড়ে পরিণত ব্যাটিংয়ের ছাপ রাখেন। সেদিন আকবরের ব্যাট থেকে আসে ৫৯ বলে ৪৫ রান এবং শামিমের ব্যাট থেকে ৮১ বলে ৬৩!

শুধু যে দল চাপে পড়ায় সেদিন বাধ্য হয়ে শামিম ধীরলয়ে ব্যাটিং করেছিলেন এমনটা কিন্তু নয়। পুরো টুর্নামেন্টেই তিনি রয়েসয়ে খেলেছেন, রান তুলেছেন ৬১.২৭ স্ট্রাইকরেটে। এই সময়ে এসে আপনার কাছে তা নিশ্চয়ই তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ ঠেকছে!

প্রথম দেখায় তাই শামিমকে আমার ঠাণ্ডা মাথার ব্যাটসম্যানই মনে হয়েছে। সে ধারণা আরো প্রতিষ্ঠিত হয় পরের সিরিজগুলাতে। পরবর্তী যুব এশিয়া কাপের আগে শ্রীলঙ্কা ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দুটি সিরিজ খেলে বাংলাদেশ যেখানে ৬১.২২ ও ৭৮.৩০ স্ট্রাইকরেটে রান তুলেন তিনি। তাছাড়া ইংল্যান্ডে ভারতের বিপক্ষে ফাইনাল হেরে যাওয়া ত্রিদেশীয় সিরিজে ৭ ম্যাচে তাঁর স্ট্রাইকরেট ছিল ৭১.১২!

শামিম যে মেরে খেলতেও পারেন সে আলামত পাই একেবারে যুব বিশ্বকাপের আগমুহূর্তে শ্রীলঙ্কা সফরে এসে। এর আগে ২০১৯ যুব এশিয়া কাপ ও নিউজিল্যান্ড সফরে ব্যাট হাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হন তিনি। তাই বিশ্বকাপের আগে শেষ সুযোগটা কাজে লাগানোর বাড়তি তাগিদ ছিল তাঁর মাঝে।

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ৬১ বলে ৯৫ রানের একটি ঝড়ো ইনিংস খেলেন শামিম। সে সময় ওই ইনিংসটাকে আমার কাছে তাঁর স্বভাববিরুদ্ধই মনে হয়েছিল। কারণ এরকম দ্রুতগতির ইনিংস তখন পর্যন্ত আর একটিও যে খেলেননি তিনি! অবশ্য যুবাদের ক্রিকেটে তাঁর এমন মেরে খেলার উদাহরণও ওই একটাই।

সবকিছু বিবেচনায় যুব ক্রিকেটের ক্যারিয়ারে শামিমকে কখনোই এখনকার মতো পিঞ্চ হিটার মনে হয়নি আমার। ক্যারিয়ারে ব্যাট হাতে খুব যে বেশি ধারাবাহিক ছিলেন এমনটাও বলা যাবে না৷ বরং কখনো কখনো ব্যাটিংয়ের চেয়ে বোলিংয়েই বেশি অবদান রেখেছেন তিনি।

উদাহরণস্বরূপ ২০২০ যুব বিশ্বকাপের কথাই ধরা যাক। ওখানে ব্যাট হাতে ৪ ইনিংসে শামিম সংগ্রহ করেন মাত্র ২০ রান। কিন্তু বোলিংয়ে ছিলেন বেশ কার্যকরী। প্রায় নিয়মিতই উইকেট তুলেছেন, ইকোনোমির দিক দিয়েও ছিলেন মিতব্যয়ী।

বিশ্বকাপে বল হাতে যখন যে দায়িত্ব পেয়েছেন সেটাই সফলভাবে পালন করেছেন শামিম। মিডল ওভারে যখন ডট বলে চাপ সৃষ্টি করে উইকেট নেওয়া দরকার তখন তা করেছেন। আবার ওপেনিংয়ে এসে উইকেট নিয়ে শুরুতেই প্রতিপক্ষকে চেপে ধরার দাবিটাও পূরণ করেছেন। সবমিলিয়ে ৬ ম্যাচে হাত ঘুরিয়ে ৪.১৪ ইকোনোমিতে নিয়েছেন ৫ উইকেট। এভাবেই শিরোপা জেতা বিশ্বকাপে ব্যাটিংয়ের চেয়ে বোলিংয়ে দলের হয়ে বেশি অবদান রাখেন তিনি।

তবে শামিম হোসেন যে একজন সহজাত স্ট্রোক-মেকার সে ব্যাপারে প্রথম জানতে পারি যুব বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে ক্রিকইনফোতে প্রকাশিত একটি কলামে। একদম ছেলেবেলা থেকেই শামিমের মেরে খেলার অভ্যাস বলে ওই কলামে জানান তাঁর কোচ শামিম ফারুকী।

অবশেষে ব্যাটসম্যান শামিম সম্পর্কে আমার ধারণা বদলে যায় গেল নভেম্বরে অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে। ধারাবাহিক না হলেও টুর্নামেন্টে তিনি রান তুলেন ১৪৫ স্ট্রাইকরেটে। সে ধারা বজায় রাখেন আয়ারল্যান্ড উলভসের বিপক্ষে।

৫ ম্যাচের ওই ওয়ানডে সিরিজের প্রায় প্রতি ম্যাচেই শেষদিকে দ্রুত রান তোলায় শামিম ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। পুরো সিরিজে ১৩১.৩১ স্ট্রাইক রেটে ১৩০ রান করেন তিনি যেখানে তাঁর ঈর্ষনীয় ব্যাটিং গড় ১৩০! তাছাড়া একমাত্র টি-টোয়েন্টিতে শেষদিকে ২৫৪.৫৪ স্ট্রাইকরেটে ২৮ রান করেন তিনি।

সত্যি কথা বলতে গেলে, যুব দলে থাকাকালীন শামিম হোসেনকে কখনোই তেমন সম্ভাবনাময় ক্রিকেটার মনে হয়নি। ওই দলের সেরা ৬-৭ জন ক্রিকেটারের মাঝেও তাঁকে দেখি নাই আমি। তবে গেল কয়েকমাসে তাঁর ভয়ডরহীন ব্যাটিং এবং ফিল্ডিংয়ে ‘অ্যাথলেটিসিজম’ দেখে বেশ মুগ্ধ হই৷ আর সেই মুগ্ধতা ছড়িয়ে এখন জাতীয় দলের সাজঘর পর্যন্ত পৌঁছে গেছেন তিনি।

আন্তর্জাতিক অভিষেকেই শামিম হোসেন নিজের সামর্থ্যের জানান দিয়েছেন ইতোমধ্যে। তাঁর ছোট্ট কাঁধে এখন ফিনিশারের বড়ো দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে। প্রথম দুই পরীক্ষায় বেশ ভালো নম্বর পেয়েই উতরে গেছেন তিনি। তাই অনেকে আবার মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসা কর‍তে গিয়ে ‘মিস্টার ফিনিশার’ তকমাটাও সেঁটে দিচ্ছেন তাঁর নামের পাশে৷ যদিও শামীম কেবল প্রতিশ্রুতির স্বাক্ষর রেখেছেন। এখনও তাঁর অনেককিছু প্রমাণ করা এবং নিজেকে আরো বেশি ঝালিয়ে নেওয়া বাকি। নিশ্চয় সেটা তিনি ভালো করেই জানেন এবং সেভাবে প্রস্তুতও হচ্ছেন।

এদিকে বেশ কয়েক বছর ধরেই একজন ফিনিশারের অভাবে ভুগছে বাংলাদেশ। টি-টোয়েন্টিতে ধুন্ধুমার ব্যাটিং করা একজন ব্যাটারকে পেতেও তো আমাদের কত বছরের অপেক্ষা! অবশেষে আশার আলো দেখাচ্ছেন শামিম হোসেন পাটোয়ারি। তাঁর সাহস, সামর্থ্য, আত্মবিশ্বাস, মানসিকতা এবং নিজেকে সর্বদা নিংড়ে দেওয়ার বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে আরেকটিবারের মতো আশার ফানুস উড়াচ্ছি।

শামিম কতটুকু সফল হবেন তা সময়ই বলে দেবে। আপাতত আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে চাই, তিনি পারবেন। একজন বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেটারের ওপর এতটুকু ভরসা তো রাখাই যায়, তাই না?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link