বর্ণনাতীত বিস্ময়, ভাষাহীন উচ্ছ্বাস, আপ্লুত অশ্রু – আসলে ইনিংসটাকে কোন আখ্যায়, কোন উপমায় আখ্যায়িত করা যায় – তা নিয়ে আলাপ হতে পারে। তর্ক বিতর্ক করা যেতে পারে। কিন্তু, কিছু কিছু ইনিংস আছে না – যাকে আসলে লিখে ব্যাখ্যা করা যায় না – বলে বোঝানো যায় না – তেমনই একটা ইনিংসের দেখা মিলল মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে।
এটা তেমন একটা ইনিংস যা দেশ কিংবা জাতি ভুলে যে কেউ-ই উদযাপন করতে পারে। আর বাংলাদেশ গর্ব করতে পারে, কারণ ইনিংসটা যে খেলেছেন এই দেশেরই ঘরের ছেলে। মিরপুরের দর্শক এখন গলা ফাঁটিয়ে বলতেই পারে – মেহেদী হাসান মিরাজ, সত্যিকারের একজন ম্যাচ ফিনিশার চলে এসেছেন।
কয়টা চার হাকিয়েছেন, আর কয়টা ছক্কা, কত তাঁর স্ট্রাইক রেট – সেই হিসেবে যাওয়া অর্থহীন। সবই তো সবাই দেখেছে। তাঁর আট নম্বরে নেমে খেলা ইনিংসটা যে বিস্ময়কর তা তো আর বলার কোনো অপেক্ষাই রাখে না। স্পেশাল, ভেরি ভেরি স্পেশাল।
৪৮ ওভার শেষেও তাঁর রান ছিল ৭২। বাংলাদেশ যে ২৫০ ছুঁয়ে ফেলবে সেটা বোঝাই যাচ্ছিল। কিন্তু, তখনও বোঝা যাচ্ছিল না যে মিরাজ আরও অভাবনীয় কিছু করবেন। ৪৯ তম ওভারে উমরান মালিকের গতি সামলে হাকালেন তিনটা বাউন্ডারি। তখনই সেঞ্চুরির স্বপ্নটা একটু একটু করে উঁকি দিতে শুরু করেছে।
শেষ ওভার শুরুর আগে তখনও সেঞ্চুরি থেকে ১৫ রান দূরে আছেন মিরাজ। যখন স্ট্রাইকে গেলেন তখন পাঁচ বলে দরকার ১৫ রান। লেগ সাইডের ছোট বাউন্ডারি টার্গেট করে শার্দুল ঠাকুরের স্লোয়ার বলটা মারলেন – বল গিয়ে পড়ল দর্শক গ্যালারির মাঝে – ছক্কা। পরের বলটা ডট। একটু কঠিন লক্ষ্য এখন। তিন বলে করতে হবে নয় রান।
চতুর্থ বলে আবারও ছক্কা। স্লোয়ার ডেলিভারিতে ডিপ মিড উইকেট দিয়ে তুলে মারলেন তিনি। দুই বলে সেঞ্চুরি থেকে তিন রান দূরে তিনি। পঞ্চম বলটা চার কতে পারত। কিন্তু, হয়নি। মিরাজের ব্যাট হয়ে মিড অফে যাওয়া বলটা ফেরত আসার আগে দুবার জায়গা বদল করা অবশ্য গেছে। এরপর শেষ ডেলিভারিতে সিঙ্গেল। ব্যাস, সেঞ্চুরি। ৮৩ টি ডেলিভারির পর আসলে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। অপরাজিত নায়ক সমাপ্তি ঘটালেন তাঁর ইতিহাস কাঁপানো এক ইনিংসের।
ম্যাচ শেষ করে আসাটা একটা শিল্প। সেই শিল্পটা যে তাঁর আয়ত্বে আছে সেটার প্রমাণ তিনি অনেকবারই দেখিয়েছেন। চট্টগ্রামে আফগানিস্তানের বিপক্ষে নেই ৮১ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। এই মিরপুরেই ভারতের বিপক্ষে তাঁর ৩৮ রানের অপরাজিত ইনিংস খাদের কিনারা থেকে ফিরিয়ে এনে বাংলাদেশকে জিতিয়েছিল স্মরণীয় এক ম্যাচ।
তবে, এবার সেই আগের দুই ইতিহাসকেও ছাপিয়ে গেলেন তিনি। মিরাজ বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা ম্যাচ ফিনিশার নাকি – সময়ই হয়ত সেই প্রশ্নের জবাব দেবে। তবে, আপাতত তাঁর এই ইনিংসটা চাপের মুখে ম্যাচ ফিনিশিংয়ের সিলেবাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে সংযুক্তি পেয়ে গেল।
রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন। ‘কি জানি কিসের লাগি প্রাণ করে হায় হায়’। সেই ‘কি’-টা আসলে কি? কেউ জানে না। কিন্তু, খুবই বিশেষ, খুবই অনিন্দ্য ও অনন্য। মিরাজের এই ইনিংসটাও তাই। এই ইনিংসের জন্য ‘প্রাণ হায় হায়’ করতে তো বাধ্য। একদিন সব শেষ হয়ে যাবে। প্রেমিকার চোখের কাজলও হয়ত মলিন হয়ে যাবে, তবে এই ইনিংসের স্মৃতি কখনও মলিন হবার নয়।