জাদেজা জাদুতে কুপোকাত পাকিস্তান

বিশেষ দ্রষ্টব্য দিয়ে শুরু করি। করোনা ত্রাসে ঘরবন্দি অবস্থায় স্টার টিভি যখন আবার ১৯৯৬ বিশ্বকাপের ভারত-পাকিস্তান পুরো ম্যাচ দেখাচ্ছে, মনশ্চক্ষে আবার চব্বিশ বছর আগে ফিরে যেতে বাঁধা কোথায়? আধ ঘন্টার হাইলাইটস এ যত না বোঝা যায়, পুরো সম্প্রচারে খেলার মেজাজ ধরা যায় অনেক বেশি।

তাই আমার ভেতরের সাংবাদিক আজ মিয়াঁদাদ, আজহার দেড় ‘কভার’ না করলে পারলো না। নিতান্তই কর্মহীন বিকেলে নস্টালজিয়া তে ডুবে গিয়ে আসন্ন সংকট ভুলে থাকার চেষ্টা। পড়ে খারাপ লাগলে ত্রুটি মার্জনা করবেন।

_________________

উদ্যান শহরে বার বা পাব গুলি মধ্যরাতের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায় শুনে ইয়ান চ্যাপেল ধারাভাষ্য দিতে দিতে আশ্চর্য হয়ে গেলেন। এরকম একটা ম্যাচ জিতে উঠে সুরাহীন উদযাপন, ভাবতেই পারেন না ইয়ান। তখনো মিয়াঁদাদ ক্রিজে, সাথে রাশিদ লতিফ। সহ ভাষ্যকার গাভাস্কার বললেন, ‘আগে বহু ম্যাচ এরকম অবস্থা থেকে বার করেছেন মিয়াঁদাদ। এখনই লাফালাফির কোনো কারণ দেখি না।’

গাভাস্কারের আশঙ্কা সত্যি করে দিয়ে রাশিদ আর মিয়াঁদাদ বাউন্ডারির বর্ষণ শুরু করলেন। ঐ সময় রাজু যদি রশিদ লতিফের উইকেট না নিতেন, কি হতো বলা যায় না। তবে শেষ অব্দি জিতলো ভারত। মিয়াঁদাদ, মালিক , আনোয়ার সবার প্রচেষ্টা ব্যর্থ করেই জিতলো। আগামী রবিবার লাহোরে ফাইনাল খেলবে কিনা সেটা ঠিক হবে আগামী বুধবার একলাখ লোকের সামনে শ্রীলংকার বিরুদ্ধে কলকাতায়।

মিয়াঁদাদ এবং ইমরান। গত দুই দশকে পাকিস্তান ক্রিকেটের ক্ষমতা প্রবর্তিত হয়েছে এই দুজনকে ঘিরে। লাহোর-করাচি লড়াই অন্য মাত্রা পেয়েছে এই দুই মহীরুহের ইগোর লড়াই ঘিরে। তা জাভেদের এরকম করুন বিদায় দেখে হয়তো মনে মনে ইমরান ও যথেষ্ট দুঃখিত হবেন। কোথায় চার বছর আগে তাঁর মেলবোর্নে হাজার ওয়াটের আলোর রোশনাই তে বিদায়, আর আজ মিয়াঁদাদের কুৎসিত রান আউটে ক্রিকেট ক্যারিয়ার এর যবনিকা।

স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে আর চাপ নিতে পারছেন না জাভেদ। মাঝে দু বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বাইরে ছিলেন, এই বিশ্বকাপেও সেরকম ব্যাটিং পাননি। তাও সালিম মালিক ও রাশিদ লতিফের সাথে জুটি বেঁধে মন্দ খেলছিলেন না। কিন্তু ওরা দুজন আউট হবার পরে আর টানতে পারলেন না জাভেদ। এরপরে উপমহাদেশে ক্রিকেট খেলায় কোনো অতীতকালের মহাতারকাকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে ঢোকানোর আগে ক্রিকেট কর্তারা অন্তত দুবার ভাববেন।

অবশ্য আনোয়ার-আমির যা শুরু করেছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল ২৮৭ করেও আজ মিয়াঁদাদের শেষ ওয়ানডে হচ্ছে না। আজ সকালেই শ্রীলংকা -ইংল্যান্ডের খেলায় ইংল্যান্ড বোলিং কে নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছেন জয়সূর্য। সেই একই চিত্রনাট্য না আবারো অভিনীত হয়। কিন্তু শান্তি দিলেন শ্রীনাথ! সেই শ্রীনাথ, যিনি বড় ম্যাচে ঝোলানোটা মোটামুটি অভ্যেস করে ফেলেছেন।

প্রসাদ দ্বিতীয় স্পেলে ততটাই ভালো করেছেন, যতটা প্রথম স্পেলে ঝুলিয়েছিলেন। সোহেল কে আজ মুখের মতো জবাব দিয়েছেন প্রসাদ। বরাবর আমির সোহেল জাভেদ মিয়াঁদাদ ক্রিকেটিং স্কুলের ছাত্র। তাঁর শিক্ষা বলে বোলার আমাকে স্লেজ করার আগে আমি বোলারকে স্লেজ করবো। তা জাভেদ মিয়াঁদাদ যেমন পার্থের মাটিতে লিলির দিকে ব্যাট তুলে দৌড়ে গিয়েছিলেন অতটা নয়, কিন্তু প্রায় কাছাকাছি অঙ্গভঙ্গি করলেন সোহেল, প্রসাদ কে কভার বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে। অন্য সময় হলে হয়তো ভারত আত্মসমর্পণ করে ফেলতো, কিন্তু আজ যে আশ্চর্য হবার ই দিন। প্রসাদ পরের বলেই ডান্ডা উড়িয়ে সোহেলকে পথ দেখালেন।

আজ শুরু থেকেই আশ্চর্য সব ঘটনা ঘটছিল। এত আক্রমণাত্মক ও ডাকাবুকো আমির সোহেল আজ এত রক্ষণাত্মক অধিনায়কত্ব করেছেন যে সময় সময় মনে হচ্ছিল ভারত-পাকিস্তান নয় , ভারত-বাংলাদেশ খেলা হচ্ছে। যেখানে বাংলাদেশী অধিনায়ক শুধু ভারতের রান বাঁচাতে চাইছেন। উইকেট তোলাতে কোনো আগ্রহ নেই। এই মনোভাব দিনের শেষে ভারত চমৎকার ভাবে কাজে লাগালো।

শুরুতে নতুন বলে সিধু নড়বড়ে জানা সত্ত্বেও একটি স্লিপ বা সময় সময় শুধু কভার আর মিড্ উইকেটে ক্যাচার রাখলেন সোহেল , আকরাম না খেলায় যিনি পাকিস্তানের তুরুপের তাস হতে পারতেন, সেই ওয়াকার কে চার ওভার পর সরিয়ে দিলেন। শচীন আজ শচীনোচিত খেলেননি। কিন্তু লম্বা ওপেনিং পার্টনারশিপ করেছেন সিধুর সাথে।

ওখানেই ম্যাচে অনেকটা এগিয়ে যায় ভারত। সিধু বরাবর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দারুন খেলেন। আজ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে তাঁর ষষ্ঠ অর্ধ শতরান করলেন , সাত রানের জন্যে সেঞ্চুরি না হওয়াতে তাঁকে খুব একটা বিমর্ষ লাগলো না। সাংবাদিকদের পরে বললেন যে ম্যাচের সেরার পুরস্কার অজয় জাদেজার পাওয়া উচিত ছিল। এমন একাত্মতা ভারতীয় দলে ততটাই আশ্চর্য যতটা এবারের ইলেক্শনে নারাসিম্হা রাওয়ের পুনর্নির্বাচিত হওয়া।

এদিন সকাল বেলাও ঠিক ছিল আজহারের সাথে টসে যাবেন আকরাম। খেলা শুরুর আড়াই ঘন্টা আগে, যখন সবাই মাঠে পৌঁছে গেছে, তখন জানা গেল আজকের অধিনায়ক আমির সোহেল। এটা কি ইন্তিখাব আলমের কোনো ধূর্ত চাল? যে আমার সেনাপতি আহত, কিন্তু বিপক্ষকে তা জানতে দেব  না। ঈশ্বরই জানেন। পাকিস্তানী আওয়ামের মত নিলে অবশ্য আকরাম ইচ্ছা করে ম্যাচ ছেড়ে দিয়েছেন।

যেটাই আসল ঘটনা হোক, পুরোনো বলে আক্রাম না থাকার সুবিধা পুরো মাত্রায় উপভোগ করলেন অজয় জাদেজা। ওয়াকার ইউনুসকে শেষ দু ওভারে যা মারলেন (৪০), ওয়াকার আগে কখনো এত মার্ খেয়েছেন কিনা সন্দেহ। কুমার শ্রী রঞ্জিৎসিনঝির লতায়-পাতায় আত্মীয় জাদেজার পরিবার। তা এতদিন তিনি প্রতিশ্রুতিমান খেলোয়াড়ের তালিকায় ছিলেন। আজ রঞ্জি-দলীপের আত্মাকে শান্তি দিলেন ২৫ বছরের এই তরুণ। ওয়াকার গত বিশ্বকাপ খেলতে পারেননি পিঠের চোটে। এই বিশ্বকাপ তাঁর শেষ হয়ে গেল দুই ওভারের জাদেজা ঝড়ে।

ইডেনে নতুন উইকেটে এবার সামনে শ্রীলঙ্কা। জয়াসুরিয়া-রানাতুঙ্গাদের বিরুদ্ধে লড়াই আরো কঠিন হবে বলে মনে করছে ক্রিকেট মহল। কারণ রানাতুঙ্গার শ্রীলঙ্কা অনেক কম ইমোশনাল এবং অনেক বেশি পেশাদারি ক্রিকেট খেলে। তবে আজহার-কুম্বলের প্রিয় ইডেন কি খালি হাতে ফেরাবে ইডেনে খেলা তাঁদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে? টিমের অন্দরে কান পাতলে কিন্তু একটাই কথা ভেসে আসছে, ‘লাহোর চলো’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link