ক্রিকেটটা এখন যেভাবে খেলা হয়, তা আজ থেকে দুই-তিন দশক আগেও এভাবে হতো না। এখন ব্যাটারদের দাপটে বোলারদের অসহায়ত্বের দৃশ্যটা চিরায়ত হওয়া পথে। কিন্তু, নব্বই দশকের ক্রিকেটটা একদমই আলাদা ছিল।
পেসারদের আগ্রাসনে উল্টো তখন ব্যাটাররাই খোলসবন্দী থাকতো।সে সময় শুরুর ১৫ ওভারে ৩০ গজ বৃত্তের বাইরে দুজন ফিল্ডার থাকতে পারত। এতে ব্যাটারদের সুযোগ থাকত শুরুতেই কিছু বাউন্ডারি বের করে নেওয়ার। তবে এই সুযোগটা তখন পর্যন্ত খুব বেশি ব্যাটার নিতে পারেননি।
টেস্ট ক্রিকেটের মতো ওয়ানডে ক্রিকেটও ছিল মন্থর গতির। তবে ওয়ানডে ক্রিকেটের এই সংজ্ঞাটা পাল্টে দিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কার সনাথ জয়াসুরিয়া ও রমেশ কালুভিতারানা। লঙ্কান ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথম নামটা পরিচিত হলেও কালুভিতারানা নামটা ঠিক ততটা পরিচিত নয়।
টেস্টে ২৬.১২ ও একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২২.২২ গড়ের একজন ক্রিকেটারকে আলাদা করে মনে রাখার কোনো কারণও নেই অবশ্য। তবে রমেশ কালুভিতারানা নামটা শুধু শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট ইতিহাস নয়, ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসেই আলোচিত একটা চরিত্র হয়ে রয়েছেন।
কেননা তাঁর হাত দিয়েই ওয়ানডে ক্রিকেটে একটা বদল আসে। আর সেই স্রোতেই এখনকার ক্রিকেট আগের চেয়ে হয়ে উঠেছে আরো বেশি আক্রমণাত্বক ও গতিশীল। শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটে রমেশ কালুভিতারানার পরিচয় ‘লিটল কালু’ হিসেবে।
পরিসংখ্যানের মানদণ্ডে হয়তো কালুভিতারানা পিছনের সারিতেই থাকবেন। তবে কিন্তু শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটের নবজাগরণে তাঁর ভূমিকা ছিল সম্মুখ সারির একজন সারথি হিসেবে। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে আন্ডারডগ শ্রীলঙ্কার শিরোপা জয়ের পেছনে কালুভিতারানা ও জয়াসুরিয়ার ব্যাটিং ছিল ম্যাচের চিত্র বদলে দেওয়ার টার্নিং পয়েন্ট। প্রতি ম্যাচে এ দুজন প্রথম ১৫ ওভারের পাওয়ার প্লে-র ফায়দা উঠিয়ে শ্রীলঙ্কাকে এনে দিয়েছিলেন উড়ন্ত সূচনা।
কালুভিতারানার ক্যারিয়ারের শুরুটা অবশ্য ওপেনার হিসেবে নয়। শুরুর দিকে ৬/৭-এ ব্যাটিং করতেন তিনি। তবে ১৯৯৫-৯৬ এর বেনসন অ্যান্ড হেইজেস সিরিজটা কালুভিতারানার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ সিরিজ ছিল। এ সিরিজে কালুকে জয়াসুরিয়ার ওপেনিং সঙ্গীর দায়িত্ব দেয়া হয়।
সবাইকে চমকে দিয়ে শ্রীলঙ্কার হয়ে ঐ সিরিজে সর্বোচ্চ ২৫০ রান করেন কালুভিতারানা। আর সে সময় সবচেয়ে নজর কেড়েছিল তাঁর স্ট্রাইকরেট। ঐ সিরিজে কালুভিতারানার স্ট্রাইক রেট ছিল ৯০-এর ওপরে।
এখনকার সময়ে এ স্ট্রাইকরেট গড়পড়তা হলেও কালুভিতারানা এমন একটা সময়ে এ স্ট্রাইক রেটে ব্যাটিং করেছিলেন যখন ৬০/৭০ স্ট্রাইকরেট কেও ভদ্রস্থ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মূলত ঐ সিরিজের পরই বদলে যায় ওয়ানডে ক্রিকেটের সংজ্ঞা। লঙ্কান ক্রিকেটকে পাল্টে দেন জয়াসুরিয়া-কালুভিতারানা জুটি। ১৯৯৬ বিশকাপের আগেও প্রথম ১৫ ওভারে ৫০-৬০ রানকে মনে হতো পর্যাপ্ত।
কিন্তু, ৯৬ বিশ্বকাপে এসে এ ভাবনাকে পাল্টে দেন জয়াসুরিয়া-কালুভিতারানা জুটি। সবাইকে চমকে দিয়ে ভারতের বিপক্ষে জয়াসুরিয়া-কালুভিতারানার উড়ন্ত ব্যাটিংয়েই প্রথম ১৫ ওভারে ১১৭ রান তুলেছিল শ্রীলঙ্কা। এরপর কেনিয়ার বিপক্ষে পাওয়ার প্লে-তে ১২৩, কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে করেছিল ১২১ করেছিল লঙ্কানরা।
সে টুর্নামেন্টে কালুভিতারানা খুব একটা ভাল করেননি বটে। ৬ ম্যাচে ৭৩ রান করেছিলেন। তবে তাঁর সাথে জুটি গড়ে ১৩০ এর উপর স্ট্রাইকরেটে ব্যাটিং করেছিলেন জয়াসুরিয়া। আর এমন দাপুটে ব্যাটিংয়ে শিরোপার পথে এগিয়ে এগিয়ে যায় শ্রীলঙ্কা। নিজেদের ইতিহাসে একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ শ্রীলঙ্কা জেতে সেবারই।
বিশ্ব ক্রিকেটে জয়াসুরিয়া কিংবদন্তি চরিত্র বনে গেলেও কালুভিতারানা সেভাবে আলোচিত নয়। তবে মাতার হ্যারিকেনের মারকাটারি ব্যাটিংয়ে অন্যতম সঙ্গী ছিলেন এই কালুভিতারানা। আর তাঁর কারণেই পাল্টে যায় ক্রিকেটের চেহারা।
বদলে যায় পাওয়ার প্লে-তে ব্যাটিং করার ধরণও। ভয়ডরহীন ক্রিকেটের শুরুটা যে জুটির হাত দিয়ে হয়েছিল, সেই জয়াসুরিয়া-কালুভিতারানা জুটি একসাথে খুব বেশি ম্যাচ খেলেননি। তবে ওয়ানডে ক্রিকেটে একটা পরিবর্তনের ছাপ রেখে গিয়েছেন তাঁরা। আজকের মারকাটারি ক্রিকেট যুগের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন তারাই।