১৩ই ডিসেম্বর ১৯৪৭ সাল।
ভারতের অস্ট্রেলিয়া সফরের দ্বিতীয় টেষ্টে, সিডনিতে ভিনু মানকড় স্বাগতিক ওপেনার বিল ব্রাউনকে বোলিং করার সময় রানআউট করে দেন।
ব্যাটসম্যান নিজের ক্রিজের বাইরে থাকলে বোলার চাইলে রানআউট করতেই পারেন। কিন্তু মানকড়ের সেই আচরণকে এতোটাই অখেলোয়াড়সুলভ বিবেচনা করা হলো যে সেই থেকে এই আউটের আনঅফিসিয়াল নাম দেয়া হলো ‘মানকাডিং’!
ভারতের ‘কালা আদমি’ কিভাবে সাদা মানুষের ‘ভদ্রলোকের খেলা’ ক্রিকেটকে কলুষিত করেছে সেইটা যাতে না না ভোলা হয় সেইটা এই নাম দিয়ে নিশ্চিত করা হয়।
কিন্তু ব্যাপারটা কি এতোটাই সরল?
ক্রিকেট ঐতিহাসিক অভিষেক মুর্খাজি এই ব্যাপারটা নিয়ে কিছু ঘটনার উল্লেখ করেছেন।
প্রথম কথা, ভিনু মানকড়ই ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম ব্যাক্তি নন যিনি এই কাজ করেছেন। প্রায় ২০০ বছর আগে, ১৮৩৫ সালে থমাস বার্কার এইভাবে আউট করেন জর্জ বেইজেন্টকে। এর পর বার্কার অন্তত আরো তিনবার এই কান্ড ঘটান; যার একটা ছিলো খোদ লর্ডসে। কেউ তখন ‘ক্রিকেটের জাত গেলো জাত গেলো’ বলে হাউকাউ করেনাই। বরং সেই সময় বেশীরভাগেরই মতামত ছিলো, বোলার যদি টের পায় তুমি বাইরে আর তোমাকে আউট করে দেয়, তবে সেইটা তোমারই বোকামি। সেইসময়কার কিছু বইপত্রে এর স্পষ্ট উল্লেখ আছে।
বার্কার তো বটেই, যাকে বলা হয় ভারতীয় ক্রিকেটের জনক, ভিক্টোরিয়ান মোরালিটির এই খেলা নেটিভদের শেখানোর ব্যাপারে যার অবদানকে মহান করে দেখানো হয়, সেই লর্ড হ্যারিস ইটনও এই কাজ করেছেন। ইটন কলেজের হয়ে লর্ডসে হ্যারো কলেজের কনরাড ওয়ালরুথকে এইভাবে আউট করেন সেই ১৮৭০ সালে। উল্লেখ্য, ইটন আর হ্যারো হচ্ছে বৃটিশ ভদ্রলোকদের মোরালিটি শেখানোর এপিটোম।
সেইদিন কেউ কিন্তু হ্যারিসের আচরণকে অখেলোয়াড়চিত বলেন নাই, উলটো প্রথম উইম্বলডন শিরোপা জেতা স্পেনসার গোরে উনার বইয়ে হ্যারিসের আচরণকে সঠিক এবং ব্যাটসম্যানের আচরণকে ভুল বলে আখ্যা দেন।
দ্বিতীয় আলাপ, মানকড় নাকি ব্রাউনকে ওয়ার্নিং দেন নাই। এই কথাটা ভুল। মানকড় এর আগে সতর্ক করেছেন। এমনকি এই আউটের পরের ইনিংসে সুযোগ পেয়েও আউট করেন নাই।
কিংবদন্তী অস্ট্রেলিয়ান বিল ও’রিলি এই ঘটনার উল্লেখ করে বলেছিলেন, ক্রিকেট আইনে এই নিয়ে বোলরের সতর্ক করারও দরকার নাই কিন্তু মানকড় ভদ্রতা করে তাও করেছেন। পরে যে আউটটা হয় সেই দোষ ব্রাউনের।
এই কথা বলে রসিক ও’রিলি অবশ্য দারুন এক মজার আলাপ দেন। উনি বলেন, ‘ অবশ্য আমার বোলিং এর সময় অবশ্য জীবনেও এমন হবে না। কারন দুনিয়ার কোন ননস্ট্রাইকার উদ্ববিগ্ন থাকবে না রান নিয়ে আমার বল মোকাবিলা করতে।’
এমনকি কিংবদন্তী ডন ব্র্যাডম্যান, যিনি ঐ ম্যাচে ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক, তিনিও ফেয়ারওয়েল অফ ক্রিকেট বইয়ে উল্লেখ করেন যে, আগে সতর্ক করে মানকড় ভদ্রতার পরিচয় দিয়েছেন, আর আউট হওয়ার পর আমাদের কোন হোলদোল হয়নাই, এইটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার ছিলো।
এমনকি পরেরদিন সিডনি মর্নিং হেরাল্ডে এই আউট নিয়ে জনতার মতামত জানতে চাওয়া হলে বেশীরভাগ মতামত দেন যে, ব্রাউন একে তো বোকার মতো আউট হইসে উপরন্ত আউট হয়ে ব্যাট ছুড়ে মেজাজ দেখাইসে। এহেন আচরণ স্কুলবয়দের থেকেও গ্রহনযোগ্য না। এইরকম লোক অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলার উপযুক্ত না।
প্রশ্ন হচ্ছে, এতো কিছুর পরেও কেন ভিনু মানকড় তাহলে কলংকিত হলেন?
সালটা ১৯৪৭, ভারত স্বাধীন হইসে ছয়মাসও হয়নাই, সদ্য প্রাক্তন কলোনিয়াল প্রভুরা এমনিতেই বিরক্ত এবং নিজেদের হেজিমনি হারানোয় ভীত। এইসময় একজন শ্বেতাংগ সাহেব ‘বোকার মতো’ আউট হইলেন এক ভারতীয়ের হাতে, এই ব্যাপারটা উনাদের জন্য খুবই অস্বস্তিকর হইলো।
তাহলে কি করা? এক্সপ্লেনেশন পাল্টায়ে দাও। পাবলিক অপিনিয়ন ঘুরায়ে দাও। আপাত স্বাভাবিক একটা ব্যাপারকে তীব্র মোরালিটির রং দিয়ে অশ্বেতাংদের কলংকিত করো, ইনফেরিয়র দেখাও। সাদা সাহেবের অহমও রক্ষা পাইলো, আবার কালা আদমিদের শুরুতেই কলংকিত করে ব্যাকফুটে ঠেলে দেয়া হইলো। সাদা সাহেবরাই মোরালিটির প্রতীক এইটাও এস্টাবলিশ হইলো।
মানকড়ের এই ঘটনা আর এর পরের যে পাবলিক অপিনিয়ন তৈরী এইটা কিন্তু জরুরী একটা শিক্ষা। কিভাবে করে, সমাজের ডমিন্যান্ট ক্লাস নানাভাবে নিজেদের হেজিমনি রক্ষা করে, ঘটনার এক্সপ্লেনেশন অল্টার করে আর পাবলিক অপিনিয়ন তৈরী করে নিজেদের মোড়লগিরি বা অন্তত মোরাল সুপিরিওরিটি বজায় রাখে সেটা বোঝা যায়।
পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত ক্রিকেট দার্শনিক সিএলআর জেমস এই কারনেই বলেছিলেন, ক্রিকেট জিনিসটাকে যারা কেবল খেলা হিসেবে দেখে ওরা আসলে ক্রিকেট বোঝে না।
কৃতজ্ঞতা: অভিষেক মুখার্জী