ইগোকে হারিয়ে পরিশ্রমের জয়

যদি ‘ইগোকে হারিয়ে পরিশ্রমের জয়’ নামে কোন বই লেখা হতো, তবে সেই বইয়ে নিশ্চিতভাবেই একটা অধ্যায় থাকতো মোহিত শর্মাকে নিয়ে। আইপিএলের এবারের মৌসুমে ফিরে আসার এক রূপকথার গল্পই লিখে চলেছেন এই তারকা।  

অথচ একটা সময়ে আইপিএলের সেরা বোলারদের একজন ছিলেন মোহিত। চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে ২০১৪ মৌসুমে জিতেছিলেন সর্বোচ্চ উইকেটশিকারির খেতাব। টানা দুই বিশ্বকাপে মাঠে নেমেছেন জাতীয় দলের হয়ে। ক্যরিয়ারে এমন সব উজ্জ্বল পালক থাকলেও নেট বোলার হিসেবে কাজ করতে দুবার ভাবেননি এই তারকা। 

মূলত পিঠের ইনজুরিই ক্যারিয়ার শেষ করে দিয়েছিল মোহিতের। জাতীয় দলের বাইরে আছেন টানা আট বছর। আইপিএলেও কোনো দল তাঁকে দলে ভেড়াতে আগ্রহ দেখায়নি গত দুই মৌসুমে। মাঠের পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনেও কাটিয়েছেন দুঃসময়, এই সময়টাতেই পরপারে পাড়ি জমান মোহিতের বাবা। 

তবে মোহিত হাল ছাড়েননি। পিঠের অস্ত্রোপচারের পর ফেরার লড়াই শুরু হয় তারকার। যদিও সাবেক ক্রিকেটারদের অনেকেই তাঁকে বলেছিলেন ক্রিকেট ছেড়ে অন্য পেশা বেছে নিতে। কিন্তু মোহিত যেন অন্য ধাতুতে গড়া। তাঁর বিশ্বাস ছিল পরিশ্রমটা চালিয়ে গেলে ঠিকই ফিরতে পারবেন পুরনো রূপে। 

মোহিতের ছোটবেলার কোচ বিজয় যাদব বলেন, ‘২০১৯ সালে পিঠের অস্ত্রোপচারের পর অন্য কেউ হলে হয়তো ক্রিকেট ছেড়েই দিত। তাঁর পায়ে ইনজুরি ছিল, স্ট্রেস ফ্র্যাকচার ছিল। ক্যারিয়ারে সবকিছু সামলেই সামনে এগিয়েছে সে। কোচ হিসেবে আমি মোহিতের ক্রিকেটের প্রতি আত্মনিবেদনের প্রশংসা করি।’

যাদব বলেন, ‘আমি যখন তাঁকে পিঠের ইনজুরিতে কষ্ট পেতে দেখি, নিজেকে সামলাতে পারিনি। আমি সকল আশা হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমি তাঁকে গিয়ে বলি মোহিত অনেক হয়েছে, এবার থামো। অন্য কিছু করার সময় এসে গেছে। সে আমাকে বলেছিল আর একটা বছর স্যার। আমি আর একটা বছর চেষ্টা করে দেখতে চাই। আমি তাঁকে বলেছিলাম ঠিক আছে।’

মোহিত চেয়েছিলেন একদম নতুন করে শুরু করতে। সেই কারণেই গুজরাট টাইটান্সের কোচ আশিস নেহরা যখন তাঁকে নেট বোলার হওয়ার প্রস্তাব দেন, সেটা লুফে নিতে দুবার ভাবেননি মোহিত। একসময়ে যাকে দলে ভেড়াতে যুদ্ধ লেগে যেত আইপিএল নিলামের টেবিলে, সেই মোহিত তরুণ বোলারদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বল করে যেতেন নেটে। গুজরাটের ব্যাটারদের সেরা প্রস্তুতি নিশ্চিত করতেন প্রতিটি ম্যাচের আগে। 

বিজয় যাদব বলেন, ‘তাঁর সিদ্ধান্তটা খুবই সাহসী ছিল। একজন ক্রিকেটার জাতীয় দলের হয়ে বিশ্বকাপ খেলেছেন, আইপিএলের সেরা বোলার ছিলেন, এমন কারো জন্য নেট বোলার হবার সিদ্ধান্ত নেয়াটা মোটেই সহজ কিছু নয়। এমন সিদ্ধান্ত নিতে অসীম সাহসের প্রয়োজন। কেননা এতে ইগো এবং জনপ্রিয়তার মতো ব্যাপার জড়িয়ে থাকে। কিন্তু সে এসব ভাবেনি, নিজেকে প্রমাণ করতে মুখিয়ে ছিল মোহিত।’

নেটে তার বোলিংয়ের গতি, ছন্দ এবং ধারাবাহিক লাইন লেংথ দেখে মুগ্ধ হয়ে স্কোয়াডে ভেড়াবার সিদ্ধান্ত নেয় গুজরাট। ভিত্তিমূল্য ৫০ লাখ রুপির বিনিময়ে ৩৪ বছর বয়সী এই পেসারের ঠিকানা হয় গুজরাট টাইটান্স। যদিও টুর্নামেন্টের শুরুর তিন ম্যাচে একাদশে ছিলেন না এই তারকা। কিন্তু একবার একাদশে সুযোগ পেতেই ফিরে আসার গল্পটা লিখেছেন নিজের হাতে। 

নিজের প্রথম ম্যাচেই পাঞ্জাব কিংসের বিপক্ষে চার ওভারে মাত্র ১৮ রানে শিকার করেন দুই উইকেট। প্রথম ম্যাচেই জিতে নেন ম্যান অব দ্য ম্যাচের খেতাব। তবে সেরাটা বোধহয় তুলে রেখেছিলেন লখনৌ সুপার জায়ান্টসের বিপক্ষে ম্যাচের জন্য। সেদিন শেষ ওভারে ১২ রান ডিফেন্ড করতে নেমে বুঝিয়ে দেন নিজের সামর্থ্য। লোকেশ রাহুল এবং মার্কাস স্টয়িনিসকে আউট করে দলকে এনে দেন সাত রানের অবিস্মরণীয় এক জয়। 

ফিরে আসার লড়াইয়ে এখনো পর্যন্ত ১১ ম্যাচে ১৭ উইকেট শিকার করেছেন এই তারকা। যাদব বলেন, ‘নেট বোলার হিসেবে কাজ করাই ছিল তার পুনরায় ক্রিকেটে ফেরার একমাত্র মাধ্যম। সে পরিশ্রম করেছে, নিজেকে প্রমাণ করেই একাদশে জায়গা করে নিয়েছে। সে নেটে ঘন্টার পর ঘণ্টা বল করেছে, গুজরাট টিম ম্যানেজমেন্টকে মুগ্ধ করেই জায়গা করে নিয়েছে স্কোয়াডে। সে সুযোগটা দুহাত ভরে নিয়েছে। তাঁর পরিশ্রম এবং আত্ননিবেদন বৃথা যায়নি।’

তিনি বলেন, ‘এক সময় পাঞ্জাব তাঁকে দলে ভিড়িয়েছিল সাড়ে ছয় কোটি রুপির বিনিময়ে। সে ভারতের হয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেট খেলেছে। তাঁর মাপের কারো জন্য নেট বোলার হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব গ্রহণ করা মুখের কথা নয়। কিন্তু মোহিত নিজের ইগোকে একপাশে সরিয়ে সিদ্ধান্তটা নিয়েছে। গুজরাটের নেটে জুনিয়র বোলাররা ছিল যারা তাঁকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলতে দেখেছে। তাঁর আত্মনিবেদন ইগোকে হারিয়ে দিয়েছে। আমি তাঁর ফিরে আসায় ভীষণ খুশি।’

যাদব আরও বলেন, ‘হার্দিক নিজেও একজন সাহসী ক্রিকেটার। ছোটবেলা থেকে লড়াই করেই আজকের এই পর্যায়ে এসেছে সে। সে নিজেও কঠোর পরিশ্রমেই বিশ্বাস করে। আমি নিশ্চিত মোহিতের মাঝেও সে এমন কিছু দেখতে পেয়েছিল এবং মোহিতের নবজাগরণের পেছনে তাঁর বড় ভূমিকা আছে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link