মুকেশ কুমার, ফ্রম বিহার টু গ্রেটনেস?

খবরটা যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না তাঁর। আইপিএল নিলামের একদিন পরও কারো ফোন পেলে গায়ে চিমটি কেটে দেখছিলেন, সবকিছু সত্যি তো! নিলামে আনক্যাপড খেলোয়াড় হিসেবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫.৫০ কোটি রুপিতে তাঁকে দলে ভিড়িয়েছে দিল্লি ক্যাপিটালস। এক লহমায় পেসার মুকেশ কুমারের জীবনটা যে এভাবে বদলে যাবে, সেটা কে জানতো! 

বিহারের অজপাড়াগাঁও থেকে উঠে এসে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ক্রিকেট খেলাটাই তাঁর কাছে স্বপ্নের মত। নিলামের পর তাই বেঞ্জালুরুতে চোট থেকে সারিয়ে ওঠার জন্য পুর্নবাসন করলেও মনটা পড়ে ছিল গোপালগঞ্জেই, বিহারের সেই ছোট্ট গ্রামেই। মুকেশের ভাষায়, ‘ক্ষেতেই আমি সবচেয়ে বেশি শান্তি পাই। খোলা জায়গাতে আপনি প্রাণভরে শ্বাস নিতে পারবেন। আমি সেখানেই সবচেয়ে বেশি শান্তি পাই।’

আইপিএল নিলামে প্রথম ডাকেই তাঁকে দলে ভিড়িয়েছে দিল্লি। অথচ সেই মূহুর্তে মুকেশ নাকি নিলাম দেখছিলেনই না। এক বন্ধু ফোন দিয়ে না জানালে তো চাক্ষুসই করা হতো না তাঁকে পেতে দলগুলোর কাড়াকড়ি। তিনি বলেন, ‘আমি শুরুতে নিলাম দেখছিলাম, পরে বাংলাদেশ-ভারত টেস্ট দেখায় মনোযোগ দিই। কিছুক্ষণ পর আমার ফোনে মা এবং বন্ধুদের ফোন আসতে শুরু করে। তখন আমি বুঝতে পারি কিছু একটা ঘটছে। সে সময় তড়িঘড়ি করে আবার নিলাম দেখতে শুরু করি।’

তাঁর ভাষায়, ‘আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না কি ঘটছে। কারণ এর আগে বহুবার আমার সাথে এমনটা হয়েছে  – আমি ভালো করছিলাম কিন্তু আমার নামই আসেনি। যখন আমার নামের পাশে নিজের ছবি খুঁজে পেলাম, তখনই কেবলমাত্র বিশ্বাস করেছিলাম।’

সুখের এই মূহুর্তে প্রিয়জন হারানোর বেদনাও স্পর্শ করে যায় মুকেশকে। তিনি বলেন, ‘সৃষ্টিকর্তা আপনাকে কিছু দেবার বদলে কিছু কেড়েও নেবে। আমার মনে হয় না আমি জীবনে আর কখনো এত টাকা উপার্জন করতে পারবো। কিন্তু আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুজন মানুষ – আমার বাবা এবং চাচা সুখের এই সময়টা দেখে যেতে পারলেন না।’

দুই বছর আগে বাবাকে হারিয়েছেন মুকেশ। এছাড়া আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী না হওয়ায় মুকেশের সংগ্রামের দিনগুলোতে আর্থিকভাবে তাঁকে সহায়তা করে গেছেন তাঁর বড় চাচা। তিনি বলেন, ‘রঞ্জিতে অভিষেকের পর প্রতিদিনের ভাতা বাবার হাতে তুলে দেবার পর তাঁর চোখেমুখে যে আনন্দটা দেখেছিলাম, আমি সেটা কখনোই ভুলতে পারবো না। আমি যদি আরো বেশিকিছু দিতে পারতাম তাঁকে। আমার আজ সামর্থ্য আছে, কিন্তু চাইলেও দেবার সুযোগ নেই। টাকা আপনাকে সবকিছু দিতে পারে না।’

অথচ ক্রিকেটে আসারই কথা ছিল না মুকেশের। ২০১২ সালে বিহার পুলিশে যোগ দেবার চিন্তায় বিভোর মুকেশ ব্যর্থ হলে প্রথমবারের মতো ক্রিকেটের কথা সিরিয়াসলি ভাবতে শুরু করে। তাছাড়া বিহার ভারতের রাজ্য ক্রিকেটে পিছিয়ে পড়া এক রাজ্য। ক্রিকেট হিসেবে বেড়ে ওঠার মতো সুযোগ-সুবিধা সেখানে ছিল না। ফলে টেপ টেনিসে স্থানীয় টুর্নামেন্টগুলোতে খেলেই নিজের আর্থিক খরচ সামলাতেন মুকেশ। অবশেষে বাবার পরামর্শে কলকাতায় গিয়ে ক্রিকেট ক্যারিয়ার সামনে এগিয়ে নেবার সিদ্ধান্ত নেন মুকেশ। 

প্রথমে কালীঘাট ক্রিকেট ক্লাবে গেলেও পরবর্তীতে বানী নিকেতন ক্রিকেট ক্লাবে খেলতে শুরু করেন মুকেশ। সেখানকার কোচ বীরেন্দর সিংয়ের হাতেই বেড়ে ওঠা তাঁর। অভিষেক ম্যাচেই ছয় উইকেট তুলে নেন দ্বিতীয় বিভাগের ম্যাচে। কিন্তু বাবার মৃত্যুতে সবকিছু থমকে যায় মুকেশের। নিয়মিত খেলার বদলে চাকরি খোঁজায় মনোযোগ দিতে হয় তাঁকে। 

অবশেষে ২০১৪ সালে ক্যারিয়ারে সামনে এগোনোর পথ খুঁজে পান মুকেশ। সেবার সিএসবি সভাপতি সৌরভ গাঙ্গুলির উদ্যোগে বাংলার প্রতিভাবান ক্রিকেটারদের ক্যাম্প করাতে আসেন মুত্তিয়া মুরালিধরণ, ওয়াসিম আকরামের মত কিংবদন্তিরা। সেই ক্যাম্পের ট্রায়ালে সুযোগ পেয়ে যান মুকেশও। 

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মুকেশের যখন বল করার সুযোগ আসে, তখন তিনি ছিলেন ওয়াশরুমে। ফলে একপ্রকার বাদই পড়ে যাচ্ছিলেন ট্রায়াল থেকে। কিন্তু প্রখ্যাত কোচ রণদেব বসুর অনুরোধেই এক প্রকার তাঁকে ক্যাম্পে সুযোগ করে দেন ওয়াসিম আকরাম। কিন্তু ইনজুরির কারণে ক্যারিয়ারে ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছিলেন মুকেশ। হাঁটুর ইনজুরিতে তাঁকে দীর্ঘদিন মাঠের বাইরে থাকতে হয়েছে। এমনও হয়েছে প্রতি তিন ম্যাচের মাত্র একটিতে মাঠে নেমেছেন। এছাড়া তিনি ছিলেন কলকাতার বাইরের, ফলে কার্যত আউটসাইডার হয়ে তাঁর দলে জায়গা করে নেয়াটা ভালো চোখে দেখছিলেন না কেউই। অবশেষে, সবকিছুর সাথে লড়াই করে ২০১৫ রঞ্জিতে হরিয়ানার বিপক্ষে অভিষেক ঘটে তাঁর। 

শুরুর তিন বছরে তেমন খেলার সুযোগ না পেলেও ২০১৮ মৌসুমের পর থেকেই পারফরম্যান্সের ধার বাড়তে থাকে মুকেশের। এছাড়া অশোক ডিন্ডার প্রস্থানের পর বাংলার পেস অ্যাটাকেও জায়গা তৈরি হয়, ৩২ উইকেট নিয়ে সুযোগটা ভালোমতোই কাজে লাগান তিনি। সেমিফাইনালে ছয় উইকেট নিয়ে কর্ণাটকের শক্তিশালী ব্যাটিংলাইন আপকে একাই গুঁড়িয়ে দেন। সেই ম্যাচের পরই দুলীপ ট্রফি এবং ইরানি ট্রফির দলেও জায়গা পেয়ে যান। কিন্তু করোনা মহামারি আরো একবার পিছিয়ে দেন মুকেশকে। 

এ বছরের শুরুর দিকে এ দলে প্রথমবারের মতো ডাক পান মুকেশ। এছাড়া ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টি- টোয়েন্টি সিরিজের জাতীয় দলে। যদিও ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি, তবে ফর্মটা ধরে রাখলে জাতীয় দলে  অভিষেকের যে আর দেরি নেই বেশি সেটা বলাই বাহুল্য।

আইপিএলে এত বড় অংকের অর্থ পাবার পরও আহামরি উচ্চাশা নেই মুকেশের। ক্রিকেটের পাশাপাশি মাকে নিয়ে মন্দির দেখা কিংবা নিজের ক্ষেত-খামার নিয়েই সীমাবদ্ধ মুকেশের জীবন। ক্রিকেট মাঠ তাঁকে আর্থিক স্বাবলম্বী করলেও মনটা পড়ে থাকে নিজের ক্ষেতে খামারেই, সেখানেই খুঁজে পান প্রশান্তি। ক্রিকেট জীবন শেষে ফিরে যাবেন পূর্বপুরুষের সেই পেশাতেই। তবে তাঁর আগে ছাপ রেখে যেতে চান বাইশ গজে। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link