মেসি ও কাতার: এক ভূবনভোলানো অধ্যায়

একটা ফুটবল বিশ্বকাপ – চার বছর পর পর অতিথি হয়ে আসে, নাড়িয়ে দিয়ে যায় পুরো বিশ্বকে। এরপর চোখের পলকেই বিদায় নেয়, তবে রেখে যায় একগুচ্ছ স্মৃতি। যার শুরু আছে, তাঁর শেষও আছে – প্রকৃতির এই বিষন্ন সত্যকে আরো একবার মনে করিয়ে দিতেই বিদায় নিয়েছে বহুল আকাঙ্খিত কাতার বিশ্বকাপ। প্রায় এক মাসের বেশি সময় পৃথিবীকে মাতিয়ে রাখার পর গল্পের ইতি টেনেছে ফিফা বিশ্বকাপের ২২তম আসরটি।

ফ্রান্স বনাম আর্জেন্টিনার হাইভোল্টেজ এক ফাইনাল ম্যাচের মধ্য দিয়ে পর্দা নেমেছে ফিফা বিশ্বকাপের। নির্ধারিত নব্বই মিনিটে ২-২ গোলে সমতায় থাকায় ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। তবে সেখানেও নিষ্পত্তি না হওয়ায় টাইব্রেকার নামক পরীক্ষায় নামে দুই দল। পেনাল্টি শুটআউটে জিতে দীর্ঘ ৩৬ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটান আর্জেন্টিনা।

লিওনেল মেসির নেতৃত্বে তৃতীয় বিশ্বকাপ ঘরে তুলে দলটি। এবারের আসরে অলরাউন্ড পারফরম্যান্স দিয়ে আবারো গোল্ডেন বল নিজের করে নিয়েছেন তিনি। সেই সাথে গ্রেটেস্ট অব অল টাইম বিতর্কে নিজেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে গিয়েছেন আর্জেন্টাইন দলপতি।

সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় ছয় গোল করা লিওনেল মেসির আগেই আছেন কিলিয়ান এমবাপ্পে, এই তরুণ গোল করেছেন সাতটি। তাই তো গোল্ডেন বুট জিতেছেন এই পিএসজি ফরোয়ার্ড। তালিকার তৃতীয় স্থানে যৌথভাবে রয়েছেন অলিভার জিরুড এবং জুলিয়ান আলভারেজ। আর টুর্নামেন্ট তিনটি করে অ্যাসিস্ট করেছেন আঁতোয়ান গ্রিজম্যান, লিওনেল মেসি এবং ব্রুনো ফার্নান্দেজ। যদিও সুযোগ তৈরির ক্ষেত্রে এদের সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন ফরাসি তারকা।

অনেক সমালোচনা আর বিতর্ক মাথায় নিয়েই বিশ্ব ফুটবলকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যের দেশ আরব। মদ, সমকামিতা সহ বিভিন্ন বিষয়ে আইনকানুন জারি করে শুরুতেই চমকে দিয়েছিল দেশটি। এসব ক্ষেত্রে ফিফাকে পাশে পাওয়ায় অবশ্য ঝামেলা পোহাতে হয়নি কাতারকে; যদিও মনঃক্ষূণ্ন হয়েছেন অনেক ফুটবল বিশ্লেষক এবং খেলোয়াড়রা। এছাড়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও উঠেছিল বিশ্বকাপ আয়োজক কমিটির উপরে।

তবে মাঠের খেলা যত এগিয়েছে, ততই এসব বিতর্কিত বিষয়ে হারিয়েছে আঁধারে। মাঠের বাইরের এসব আলোচনা ভুলে ফুটবলপ্রেমীরা মুগ্ধ হয়েছিলেন অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর পারফরম্যান্স আর কাতারের আয়োজন দেখে। আধুনিক প্রযুক্তির সমাহার, পর্যটক-বান্ধব ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রশংসা কুড়িয়েছে আরব দেশটি। আর সৌদি আরব, জাপানের মত তুলনামূলক ছোট দেশগুলোর অপ্রত্যাশিত জয় এবারের বিশ্বকাপের উন্মাদনা বাড়িয়ে দিয়েছিল কয়েকগুণ।

সবমিলিয়ে ২০২২ সালের বিশ্বকাপে মোট ৬৪টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে। আর এই ৬৪ ম্যাচে দর্শকেরা দেখেছে ১৬৭টি গোল, অর্থাৎ প্রতি ম্যাচে গড়ে ২.৬১ গোল হয়েছে কাতার বিশ্বকাপে। তবে বড় দলগুলো একতরফা গোল করেছে আর র‍্যাংকিং বিবেচনায় পিছিয়ে থাকা দলগুলো কেবল গোল হজম করেছে ব্যাপারটি মোটেই তেমন নয়। এই যেমন বেলজিয়াম গ্রুপ পর্বে মাত্র ১টি গোল দিতে পেরেছে। আবার তিউনিসিয়ার জালে বল জড়িয়েছে শুধু একবার।

২০২২ সালের বিশ্বকাপে ম্যাচপ্রতি সবচেয়ে বেশি ২.৬টি গোল করেছে ইংল্যান্ড এবং সবচেয়ে কম ০.৩টি গোল হজম করেছে তিউনিসিয়া। সর্বোচ্চ চারটি ক্লিনশিট রেখেছে আসরের ডার্ক হর্স মরক্কো, তবে সর্বাধিক শট সেভ করে আলো কেড়েছেন পোল্যান্ডের গোলকিপার ভয়চেক শেজনি। সবচেয়ে বেশি হলুদ কার্ড দেখার কীর্তিটা অবশ্য সৌদি আরবের, মাত্র তিন ম্যাচ খেলেই ১৪টি হলুদ কার্ড দেখেছে দলটির খেলোয়াড়রা।

মরক্কো, ক্রোয়েশিয়ার মত গড়পড়তা দলগুলোর পারফরম্যান্স মূলত কাতার বিশ্বকাপকে করে তুলেছে অনন্য। হাকিম জিয়েচ, আশরাফ হাকিমি, ইয়াসিন বোনোর মত প্রতিভাবান ফুটবলারদের নিয়ে বিশ্বকাপের সেমিতে পৌঁছেছিল আফ্রিকান দেশটি।

অন্যদিকে গতবারের ফাইনালিস্ট ক্রোয়েশিয়া এবারও মদ্রিচ, লিভাকোভিচদের উপর ভর করে খেলেছে সেমিফাইনালে। বিশ্বকাপের রৌপ্য ট্রফিও জিতেছে তারা। এছাড়া জার্মানি, স্পেন, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, পর্তুগালের মত দলকে হারানো জাপান, ক্যামেরুন, সৌদি আরব, দক্ষিণ কোরিয়াও সমর্থকদের হৃদয় জিতে নিয়েছে।

ফুটবলীয় হিসেবের বাইরেও অনেক প্রথমের সাক্ষী হয়েছে কাতার বিশ্বকাপ। এবারই প্রথম শীতকালীন মৌসুমে বসেছে ফুটবলের মহাযজ্ঞ, এর আগে প্রতিবারই জুন-জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল বিশ্বকাপ। এছাড়া কাতার বিশ্বকাপেই প্রথমবার দেখা গিয়েছে নারী রেফারি, সেন্সরযুক্ত বল, সেমি-অটো অফসাইড প্রযুক্তি এবং পারফরম্যান্স বিশ্লেষণ করার জন্য ডেটা অ্যাপ।

ফুটবল থেকে কিছুটা দূরে অবস্থান করা কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজন করাটা সহজ ছিল না, তাই তো খরচের অংকটা বেড়েছে অবিশ্বাস্য গতিতে। ফুটবল বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল সংস্করণ ছিল এটি। কাতার কর্তৃপক্ষ এই বিশ্বকাপ আয়োজন করার জন্যে প্রায় ২২০ বিলিয়ন ইউএস ডলার খরচ করেছেন; যা বাংলাদেশের বার্ষিক বাজেটের প্রায় তিনগুণ।

ইংল্যান্ডের রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথকে ছাড়া এবারই প্রথম কোন বিশ্বকাপ মাঠে গড়িয়েছে। এলিজাবেথ এবারের বিশ্বকাপ তাই উপভোগ করতে পারেননি ঠিকই, তবে পুরো বিশ্বই উপভোগ করেছে দারুণভাবে; পেয়েছে অনন্য এক স্বাদ। ফিফা বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা আসরের বিশেষ মুহুর্তগুলো ফুটবলপ্রেমীরা হৃদয়ে লালন করবে অনেকদিন। আর সেই সাথে শুরু হবে ফুটবলের আরেকটি মহাযজ্ঞের জন্য অপেক্ষা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link