দেখতে দেখতে হুড়মুড়িয়ে আবারো দোরগোড়ায় চলে এল ফুটবল বিশ্বকাপ। আর এই বিশ্বকাপে অংশ নেয়া দলগুলোর ভাগ্য নির্ধারনের ড্র-পর্ব অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো কাতারের রাজধানী দোহা’য়। বিশ্বকাপের ড্র নিয়ে তারকার হাট বসেছিল সেখানে। প্রত্যেক দেশের কোচ এবং প্রতিনিধি তো ছিলেনই। সঙ্গে কাফু, ইকার ক্যাসিয়াস, রিকার্ডো কাকা, আন্দ্রে পিরলো, লোথার ম্যাথিউজ, আলী দায়ী-র মতো কিংবদন্তি রা ছিলেন। অতিথিরা একে একে কাঁচের পাত্র থেকে বেছে নিয়েছিলেন বিভিন্ন গ্রুপের দলগুলো।
এক এক করে দলের নাম ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দলের কোচ সেটি টুকে রাখছিলেন নিজেদের ডায়েরিতে। কোন প্রতিদ্বন্দ্বী তাঁদের জন্য অপেক্ষা করবে তা নিয়ে হয়তো আজ থেকে শুরু হয়ে যাবে চুলচেরা বিশ্লেষণ, হয়তো আজ থেকে চলবে বিশেষ অনুশীলনও। বিশ্বকাপের বত্রিশ দলকে আটটি গ্রুপে ভাগ করা হয়েছে; এক নজরে দেখে নেয়া যাক কোন ফুটবল পরাশক্তি আছে কোন গ্রুপে; প্রতিপক্ষ হিসেবে কে পাচ্ছে কোন দলকে।
- গ্রুপ এ
আয়োজক দেশ হিসেবে কাতার রয়েছে গ্রুপ-এ তে। গ্রুপে হট ফেভারিট হিসেবে রয়েছে ইউরোপের দল নেদারল্যান্ডস। এই দুই দলের পাশাপাশি রয়েছে ইকুয়েডর এবং আফ্রিকার চ্যাম্পিয়ন সেনেগাল।
গ্রুপ-এ থেকে নেদারল্যান্ডস নক আউট পর্বে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে ফেভারিট। তবে স্বাগতিক কাতার, ইকুয়েডর কিংবা সাদিও মানের সেনেগালও দারুণ লড়াই করবে পরের রাউন্ডে যেতে।
- গ্রুপ বি
ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্র দুই দলই রয়েছে গ্রুপ-বি তে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দুই দেশেরই রয়েছে মুখোমুখি অবস্থান। দুই দলের মাঝে খেলার মাঠেও ক্রীড়াসুলভ লড়াই দেখার অপেক্ষায় থাকবে ভক্তরা।
এছাড়াও গ্রুপের ফেভারিট দল হিসেবে রয়েছে ইংল্যান্ড। তবে গ্রুপের চতুর্থ সদস্য কে তা জানতে আরো অপেক্ষায় থাকতে হবে। ওয়ালশ, ইউক্রেন এবং স্কটল্যান্ড এই তিনদলের যেকোনো এক দল হতে পারে গ্রুপ-বি এর সদস্য।
- গ্রুপ সি
গ্রুপ সি-এর সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন হিসেবে আছে লিওনেল মেসি’র আর্জেন্টিনা। দারুন ফর্মে থাকা এই দলের প্রতিপক্ষ হিসেবে বড় দল না থাকলেও মেক্সিকো, পোলান্ডের মত আন্ডারডগ’রা রয়েছে গ্রুপসঙ্গী হিসেবে।
এশিয়ান দল সৌদি আরবও খেলবে গ্রুপ-সি তে। এই গ্রুপের কল্যানেই লিও মেসি এবং রবার্ট লেওয়ানডস্কি’র মুখোমুখি দ্বৈরথ দেখার সুযোগ সৃষ্টি হলো দর্শকদের জন্য।
- গ্রুপ ডি
ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের ঠিকানা গ্রুপ-ডি। ফ্রান্স ছাড়াও ডেনমার্ক ও তিউনিসিয়া রয়েছে এই গ্রুপে। অস্ট্রেলিয়া, আরব আমিরাত এবং পেরু’র মধ্যকার প্লে-অফ ম্যাচ শেষে নির্ধারণ হবে গ্রুপ ডি এর অন্য সদস্য। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নের গ্রুপ পর্বে বিদায় নেয়ার ধারা গত কয়েক বিশ্বকাপে দেখা গেলেও তুলনামূলক সহজ গ্রুপে থাকা ফ্রান্সের জন্য এবার নক আউট পর্বে খেলার সুযোগ বেশিই।
- গ্রুপ ই
‘গ্রুপ অব ডেথ’ বলা যায় এবারের বিশ্বকাপের গ্রুপ-ই কে। ইউরোপের দুই জায়ান্ট স্পেন এবং জার্মানি এবার একই গ্রুপেই রয়েছে। তাছাড়া এদের সঙ্গী হিসেবে আছে এশিয়ান দল জাপান।
স্পেন কিংবা জার্মানি তো সবসময়ই ফেভারিট, গত বিশ্বকাপের কথা ভাবলে জাপানকেও হিসেব থেকে সরানো যাবে না। এছাড়াও বাছাইপর্ব শেষে কোস্টারিকা অথবা নিউজিল্যান্ড যোগ দিবে গ্রুপ-ই তে। সব মিলিয়ে এই গ্রুপটিকেই সবচেয়ে রোমাঞ্চকর বলা যায়।
- গ্রুপ এফ
৩৬ বছর পর বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়া দল কানাডার স্থান হয়েছে গ্রুপ-এফ তে। তবে এই গ্রুপের মূল আকর্ষণ কেভিন ডি ব্রুইনা’র বেলজিয়াম এবং লুকা মদ্রিচের ক্রোয়েশিয়া।
চার দলের অন্যটি হলো আফ্রিকান দেশ মরক্কো। বেলজিয়াম ফেভারিট কিনা সেই তর্ক হতে পারে কাগজে কলমে তবে গত বিশ্বকাপের ফাইনালিস্ট ক্রোয়েশিয়া এবং ইতিহাসে জায়গা পাওয়া কানাডা’র এই প্রজন্মও ছাড় দিবে না একবিন্দু।
- গ্রুপ জি
গত বিশ্বকাপে ব্রাজিল গ্রুপ পর্বে খেলেছিল সুইজারল্যান্ড, সার্বিয়া এবং কোস্টারিকা’র বিপক্ষে। বিশ্বকাপের ভেন্যু রাশিয়া থেকে কাতারে পরিবর্তন ঘটলেও বদলায়নি ব্রাজিলের ভাগ্য।
শুধু কোস্টারিকার পরিবর্তে গ্রুপ এফ-এ ব্রাজিলের সঙ্গী হয়েছে ক্যামেরন। সবমিলিয়ে গ্রুপ এফের চারটি দল ব্রাজিল, সুইজারল্যান্ড, সার্বিয়া এবং ক্যামেরন। চোখ বন্ধ করেই বলা যায় পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল অনেকটাই সহজ গ্রুপে স্থান পেয়েছে। মাঠে কতটা দাপট দেখাতে পারে সেলেসাও’রা সেটিই এখন প্রশ্ন।
- গ্রুপ এইচ
বহু নাটকীয়তার পর বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়া ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো’র পর্তুগাল রয়েছে সবচেয়ে শেষের গ্রুপে। গ্রুপ-এইচে পর্তুগালের আরেক সঙ্গী দক্ষিণ আমেরিকার দল উরুগুয়ে। এছাড়াও স্পার্স তারকা হিয়ং মিন সন এর দল দক্ষিন কোরিয়াও রয়েছে এই গ্রুপে।
রোনালদো, সুয়ারেজ, কাভানি, ব্রুনো, হিয়ং মিন সন এর মত তারকাবহুল এক গ্রুপে পরিনত হয়েছ গ্রুপ এইচ। এই গ্রুপের অন্য দলটি হলো আফ্রিকার দেশ ঘানা। খুব বড় দল না থাকলেও এই গ্রুপে লড়াই হবে সেয়ানে-সেয়ানে। উরুগুয়ে, পর্তুগাল, দক্ষিণ কোরিয়া; দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়ার জন্য তিনদলই ফেভারিট নিশ্চয়ই।
বাংলাদেশ ফুটবলে খুব পিছিয়ে থাকলেও ফুটবল সমর্থনে কোনভাবেই পিছনের সারিতে নয়। বিশেষ করে ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা’র প্রতি উন্মাদনা প্রতিটি বিশ্বকাপ আসরেই অন্যমাত্রা লাভ করে। স্বভাবতই এই দুই দলের গ্রুপ (গ্রুপ জি এবং গ্রুপ সি) এর দিকে অধিকাংশ দর্শকদের বিশেষ দৃষ্টি থাকবে। এছাড়াও রোনালদো’র গ্রুপ (গ্রুপ এইচ), গ্রুপ অব ডেথ (গ্রুপ ই) এর দিকেও তীক্ষ্ণ চোখ রাখবে ফুটবল ভক্তরা।
ফুটবলে এই বিশ্বকাপের ট্রফিটাই শেষ কথা। বিশ্ব জয়ের চিহ্ন, নিশানা, স্মারক। তাই তো শিল্পীদের গান আর নৃত্যে শুরু হওয়া আলোকিত আসরটিকে নিয়ে তুমুল আগ্রহ সমর্থকদের। মাঠের বাইরের হিসেব-নিকেশ শেষ; এবার মাঠের লড়াই শুরু হওয়ার প্রতীক্ষায় তারা।
দলগুলোর কারো গায়ে রয়েছে ফেভারিট তকমা, কেউবা আন্ডারডগ। তবু নব্বই মিনিট জুড়েই লড়াই হবে সমানে-সমানে। আর মাত্র তো কয়েকটা মাস বাকি, এরপরই দামামা বেজে উঠবে বিশ্বকাপের। কখনো উল্লাস, কখনো বা বিষাদের সুর ছড়িয়ে পড়বে সারা বিশ্বে; এখন শুধুই অপেক্ষা।