এই বেশ ভাল আছি,
কর্ম কাজ নেই, গাড়ি ঘোড়া কিছু নেই,
অফিস কাছারি নেই, হাজিরা কামাই নেই,
শব্দ বা পরিবেশ দূষণ বালাই নেই,
সময় দেই না বলে তেলে বেগুনে জ্বলে গিন্নীর রাগ নেই,
টেলিফোনে ডাক নেই, শহরেতে কারফিউ, লোকজন কেউ নেই,
এক-চার-চার ধারা, ফুটপাথে থাকে যারা, কেউ কোথ্ থাও নেই
নেই নেই কিছু নেই।
১৯৯৩ সালে লেখা এ গান গাওয়ার সময় নচিকেতা কি ভেবেছিলেন, পরবর্তী শতাব্দীর কোনো এক সালে আক্ষরিকভাবেই পুরো পৃথিবী এরকম হবে? আমরা; এ প্রজন্ম কি কোনোদিন ভেবেছিলাম মহামারির মতো একটি ব্যাপারের সম্মুখীন কোনোদিন হতে হবে?
ভাবনাকে মিথ্যা প্রমাণ করেছেন বিধাতা; এই ২০২০ সালে। ২০২০, ইংরেজিতে যা শোনায় ‘টুয়েন্টি টুয়েন্টি’, বাংলায় এভাবে বললে হয় ‘বিশ বিশ’। যা আবার শোনায় ‘বিষ বিষ’-এর মতো! নামের জোরেই হোক, আর যাই হোক, ২০২০ সত্যিকার অর্থেই মানবজাতির জন্য ‘বিষময়’ এক বছরই গিয়েছে।
যেখানে জীবন বিপন্ন, সেখানে ক্রিকেট নিতান্তই বিলাসিতা। তারপরও জীবন স্বাভাবিক হয়েছে, ‘নিউ নরমাল’ এ অভ্যস্ত হয়েছি আমরা, ফিরেছে ক্রিকেটও। বছর শেষে যেটাই সবচেয়ে বড় সাফল্য।
অথচ কত সুন্দরভাবেই না শুরু হয়েছিল ২০২০!
বাংলাদেশের বেলায় যেটা আরো অনেকগুণ সত্য। অনুর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেলাম আমরা; ভারতকে টপকিয়ে। বছরের সময় তখন ফেব্রুয়ারি। যেখানে জাতীয় দল পাকিস্তান সফরে গিয়ে টি-টোয়েন্টি আর টেস্টে নাকানিচুবানি খাচ্ছে, সে মুহুর্তে জুনিয়র টাইগাররা এনে দিল প্রথম বিশ্ব ট্রফি, কম আনন্দের ব্যাপার তো নয়!
‘সম্রাট’ আকবর যখন ট্রফিটা উঁচিয়ে ধরে, তখন গর্ব করেছিল পুরো বাংলাদেশ। আনন্দে মাতে দেশবাসী। বছরটা নানা দুর্যোগে গেলেও এ মুহুর্তটা সারাজীবন বারেবারে স্মরণ করাবে ২০২০ কে।
যখন আমরা উল্লাসে মত্ত, তখন আস্তে আস্তে বিশ্বজুড়ে নিজের প্রভাব বিস্তার করে চলেছে করোনা নামক এক অণুজীব। তবে তখনও ক্রিকেট বিশ্ব মজে রয়েছে ক্রিকেটে। অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ আয়োজনের পর আইসিসি মাঠে নামিয়েছে উইমেনস টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। দ্বি-পাক্ষিক সিরিজগুলো চলছে সমানতালে।
কিন্তু করোনা মহাশয়ের চোখ রাঙানি পড়ে যায় ক্রিকেটের উপর। ৮ মার্চ রেকর্ড পরিমাণ দর্শক উপস্থিতিত উইমেনস টি-টোয়েন্টি ওয়াল্ড কাপ ফাইনাল অনুষ্ঠিত হলো। কিন্তু হঠাৎ গুঞ্জন, সেখানে নাকি পাওয়া গিয়েছে করোনা উপস্থিতি। এ কি মুসিবত!
যে আশংকা আর কাটেনি।
১৩ মার্চ অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড সিরিজ হলো দর্শক শুন্য মাঠে, ক্রিকেট বিশ্ব দেখল ক্রিকেটের নতুন রূপ। এরপর একে একে বাতিল হতে থাকল সিরিজ, খবর আসল খেলোয়াড়দের আক্রান্ত হওয়ার, ক্রিকেট হয়ে পড়ল স্থবির। পড়ে গেল এক অনিশ্চিত যাত্রায়।
২.
সেই কোমাতে চলে যাওয়া ক্রিকেট কে ফেরাবে, কীভাবে ফেরাবে এরকম চিন্তায় যখন নীতিনির্ধারকেরা চিন্তিত, ঠিক তখনই অগ্রগামী হয় ক্রিকেটের জনক ইংল্যান্ড। পালটানো হয় ক্রিকেটের নানান নিয়মকানুন, সামনে আসে ‘জৈব সুরক্ষিত পরিবেশ’ নামের এক বিষয়। তারপরেও সংশয় ছিল, ছিল আশংকা; আদৌ কি ক্রিকেট ফেরানো যাবে?
সংশয় দূর হয়েছে, ক্রিকেট ফিরেছে। ৮ জুলাই ২০২০, ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচ দিয়ে ফিরল ক্রিকেট; যার অপেক্ষায় ছিল পুরো ক্রিকেট বিশ্ব। খেলা চেয়ে বিনোদনের চেয়েও বড় কিছু, সেটা বুঝিয়ে দিল বর্নবাদ ইস্যুতে উইন্ডিজ খেলোয়াড়দের প্রতিবাদ।
যদিও বাতিল করতে হয়েছে আইসিসি পুরুষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। তারপরও ক্রিকেট ফিরেছে নিউ নরমালকে মাথায় রেখেই। হচ্ছে দ্বি-পাক্ষিক সিরিজ, হয়েছে আইপিএল, হচ্ছে ঘরোয়া ক্রিকেট। বছর শেষে যেটাই বড় পাওয়া।
যদিও বাংলাদেশ এখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখেনি, তবে প্রস্তুতি শেষ। প্রেসিডেন্টস কাপ এবং বঙ্গবন্ধু টি-২০ কাপের সফল আয়োজনের পর আগামী বছরের শুরুতে বাংলাদেশে পা রাখছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, যার দল ঘোষণা হয়ে গেল কালকে। সব ঠিক থাকলে আগামী বছর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলতে দেখতে পারব সাকিব-তামিমদের, যার অপেক্ষায় ছিলাম আমরা। হয়তো মাঠে দর্শক থাকবে না, তাতে কি; খেলাটাই সই!
৩.
আসছে ২০২১। ২০২০ এর ‘বিষময়’ বছর থেকে মুক্তির আশায় পুরো বিশ্ব, সাথে আমরাও। লেখাটা শুরু করেছিলাম নচিকেতার গান দিয়ে, শেষ করি তাঁর গান দিয়েই-
এক দিন ঝড় থেমে যাবে, পৃথিবী আবার শান্ত হবে,
বসতি আবার উঠবে গড়ে
আকাশ আলোয় উঠবে ভরে,
জীর্ন মতবাদ সব, ইতিহাস হবে
পৃথিবী আবার শান্ত হবে…
আজ এ অশান্ত দিন,
বেঁচে থাকা আশা ক্ষীণ, তবু পথ চাওয়া অবিরাম,
ধূসর আকাশ আজ, কাল নেবে বঁধু সাজ
এই বিশ্বাসেই সংগ্রাম।