যে হাসিতে কেঁদেছিল পাকিস্তান

শুরুতে ডানহাতি ব্যাটসম্যান হিসেবে শুরু করলেও পরে পুরোদস্তুর বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান হয়ে যাওয়া অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান মাইক হাসির নাম ক্রিকেট পাড়ায় খুবই সমাদৃত। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের আগেই প্রথম বিভাগ ক্রিকেটে ১৫ হাজারের বেশি রান সংগ্রহ করা মাইক হাসির রয়েছে আরো বেশকিছু অনবদ্য রেকর্ড। মাইকেল হাসি ওপেনার, টপ অর্ডার, মিডেল অর্ডার বা ফিনিশার যে কোন পজিশনের একজন পিওর ক্লাস ব্যাটসম্যান। বা হাতের অসাধারণ সব কাভার ড্রাইভ, পুল শটে মুগ্ধ করেছেন সবসময়। 

২০০৪ সালে অভিষেকের মাত্র দু’বছরের মাঝেই ২০০৬ সালে ওয়ানডে র‍্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বর ব্যাটসম্যানের পজিশন টাও নিজের করে নিয়েছিলেন মাইক হাসি। তাঁর অনবদ্য সব পারফরম্যান্স এর মাঝে ২০১০ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ ওভারে ১৮ রান নিয়ে অস্ট্রেলিয়া দলকে ফাইনালে নিয়ে যাওয়ার ম্যাচটি ক্রিকেট বিশ্বে আলাদা জায়গা করে দিয়েছে তাকে।

তবে, ২০১০ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপটা আলাদা ভাবে মনে রাখবেন হাসি। বিশেষ করে পাকিস্তানের বিপক্ষে সেই সেমিফাইনাল। এর আগে ১৯৯৯ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে শিরোপা খোয়ানোর পর এই ম্যাচটি পাকিস্তানের কাছে ছিলো প্রতিশোধের সুবর্ণ সুযোগ। এই উদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত হয়েছিলো পাকিস্তানের সম্পূর্ণ একাদশ।

ড্যারেন সামি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে স্থানীয় সময় সাড়ে এগারোটায় শুরু হওয়া ম্যাচে টস জিতে পাকিস্তানকে ব্যাটিংয়ে পাঠায় মাইকেল ক্লার্কের অস্ট্রেলিয়া। পাকিস্তানের হয়ে ওপেন করতে আসেন ইনফর্ম দুই ব্যাটার কামরান আকমাল এবং সালমান বাট। ওপেনিং পার্টনারশিপ দীর্ঘ হয় ৮২ রান পর্যন্ত। কামরান আকমাল এবং সালমান বাট মাত্র ৫৯ বলে ৮২ রানের দারুন জুটি গড়েন।

দারুণ ক্যাচের মাধ্যমে ডেভিড ওয়ার্নারের হাতে তালুবন্দি হওয়ার আগে কামরান আকমলের ব্যাট থেকে পাকিস্তানের স্কোরবোর্ডে জমা হয় মাত্র ৩৪ বলে ৫০ রানের দারুন একটি ইনিংস। নিপুণ সব ড্রাইভ এবং পুল শর্টে সাজানো ছিলো কামরানের ইনিংস।

পরবর্তী সময়ে ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান বনে যাওয়া স্মিথের এ ম্যাচে প্রধান দায়িত্ব ছিলো প্রতিপক্ষের ব্যাটারদের রানের খাতা নাতিদীর্ঘ রেখে সাঝঘরের পথ দেখানো। স্মিথ ঠিক এই কাজটিই করেছিলেন। রানের খাতার দিকে খুব একটা নজর দিতে না পারলেও অজিদের হয়ে দ্বিতীয় ব্রেক থ্রু এনে দিয়েছিলেন স্মিথ। কামরান আকমালের মত এবারও ডেভিড ওয়ার্নারের তালুবন্দি করিয়ে সাজঘরে পাঠিয়েছিলেন অন্য ওপেনার সালমান বাটকে। উইলো থেকে এসেছিলো ৩২ রান। 

অন্য সময়ে ফিনিশিংয়ের গুরুদায়িত্ব পালন করা পাকিস্তানের অধিনায়ক শহীদ আফ্রিদি এই ম্যাচে হয়েছিলেন পুরোদস্তুর মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান।  ব্যাট করতে এসেছিলেন চার নম্বর পজিশনে। যদিও খুব একটা সুবিধে করতে পারেন নি বুম বুম আফ্রিদি। নিজের নামের পাশে যোগ করতে পেরেছিলেন ৯ বলে মাত্র ৮ রান।

শহীদ আফ্রিদি না পারলেও পেরেছিলেন উমর আকমল। ভ্রাতা কামরান আকমল এর মতো উমর আকমল ও তুলে নিয়েছিলেন দারুণ এক অর্ধশতক ৷ তার অপরাজিত ৩৫ বলে ৫৬ রানের অনবদ্য ইনিংসে পাহাড়সম টার্গেট পেয়েছিলো পাকিস্তান। ৩৫ বলের ইনিংসটি ২ বাউন্ডারি এবং ৪ ওভার বাউন্ডারিতে নিপুণ হাতে সাজিয়ে ছিলেন উমর আকমাল। উমর আকমালের বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ের সাথে আব্দুর রাজ্জাক এর ৭ বলে ১২ রানের ক্যামিও পাকিস্তানকে ১৯১ রানের সংগ্রহ এনে দিয়েছিলো। শেষ চার ওভারে উমর আকমল এবং আব্দুর রাজ্জাকের বদৌলতে পাকিস্তান সংগ্রহ করেছিলো ৫৯ রান।

সাঈদ আজমল, মোহাম্মদ আমির, শাহিদ আফ্রিদির মতো বোলারদের বিপক্ষে ১৯২ রান তাড়া করে ম্যাচ জেতা অসম্ভব বললেও খুব বেশি বলা হতো না সে সময়। তবু অজিদের ভরসার জায়গায় ছিলো বিধ্বংসী ওপেনিং পেয়ার ডেভিড ওয়ার্নার এবং শেন ওয়াটসন। 

কিন্তু এদিন হতাশ করেছিলেন দুজনই। ইনিংসের মাত্র দ্বিতীয় বলেই শূন্য রানে আউট হন ডেভিড ওয়ার্নার। দলীয় তৃতীয় ওভারে এবং আমিরের ব্যক্তিগত দ্বিতীয় ওভারে আব্দুর রেহমান এর তালুবন্দি হয়ে সাজঘরে ফেরেন শেন ওয়াটসন৷ ওয়াটসন ৯ বলের ছোট ক্যামিওতে ১৬ রান সংগ্রহ করেছিলেন। অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্ক এবং ব্র্যাড হ্যাডিন এর সাথে তৃতীয় উইকেট জুটিতে কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তাদের পার্টনারশিপ থেকে যোগ হয় ৩২ রান। কিন্তু দলীয় ৭.২ ওভার এবং ৮.২ ওভারের সময় দুজনই আউট হয়ে গেলে আবারও ব্যাকফুটে চলে যায় অজিরা। 

পঞ্চম উইকেট জুটিতে ৪৩ রান সংগ্রহ করেন ডেভিড হাসি এবং ক্যামেরুন। স্পিনার আব্দুর রেহমান এর বলে বোল্ড হয়ে ডেভিড হাসি আউট হন। পঞ্চম উইকেট হারানোর পর উইকেটে আসেন মাইক হাসি। মাইক হাসি যখন ক্রিজে আসেন তখন অজিদের জেতার জন্য দরকার মাত্র ৪৫ বলে ৮৭ রান।

ক্যামেরুন হোয়াইট এদিন দানবীয় ব্যাটিং করেছিলেন। মাইক হাসি ক্রিজে আসার আগে ১১তম ওভারে হোয়াইট, শহীদ আফ্রিদিকে মিড উইকেট দিয়ে একই ওভারে দুটি বিশাল ছক্কা হাঁকান। দুই বাউন্ডারি হজম করে  আফ্রিদি আক্রমণে আনেন মোহাম্মদ হাফিজকে। বোলিং পরিবর্তন করেও ফলাফলে পরিবর্তন আনতে পারেনি আফ্রিদি। হাফিজ কে ও দুটি ছক্কা হাঁকান তিনি।

মাইক হাসি, হোয়াইট এর সাথে বিধ্বংসী খেলায় যোগ দেন ১৬ তম ওভারে আবার শাহিদ আফ্রিদি বোলিংয়ে আসলে দুটি বিশাল ছক্কা হাঁকানোর মাধ্যমে। ১৬ তম ওভারে ১৪ রান সংগ্রহ করলেও পরের ৪ ওভারে অস্ট্রেলিয়ার দরকার ছিল ৫৬ রান। এসময় বোলিংয়ে এসে মোহাম্মদ আমির দারুন ওভার করেন। ১৭ তম ওভারে মাত্র ৮ রানের খরচায় তুলে নেন ক্যামেরুন হোয়াইট এর উইকেট। ১৮ তম ওভারের শুরুতেই স্মিথ এর উইকেট শিকার করলেও এই ওভারে ১৪ রান খরচা করেন সাঈদ আজমল।

শেষ দুই ওভারে অস্ট্রেলিয়ার জয়ের জন্য দরকার ছিল ৩৪ রান। ১৯ তম ওভারে আবারও বোলিংয়ে আসেন মোহাম্মদ আমির। তবে এবার প্রথম বলেই দরকারি ৪টি রান সংগ্রহ করতে ভোলেননি মাইক হাসি। পরের চার বলে চার ডাবলে ওভারের প্রথম পাঁচ বলে হাসি সংগ্রহ করেন ১২ রান। অজিদের তখন দরকার মাত্র ৭ বলে ২২ রান। ওভারের শেষ বলে আরো একটি বাউন্ডারি হাঁকান মাইক হাসি। যার ফলে শেষ ওভারে দরকার ছিলো ১৮ রান।

দুর্দান্ত ব্যাট করতে থাকা এবং আগের ওভারেই ১৬ রান সংগ্রহ করা মাইক হাসির জন্য শেষ ওভারে ১৮ রান সংগ্রহ করা সম্ভব হলেও দূর্ভাগ্যবশত স্ট্রাইক প্রান্তে ছিলেন বোলার মিশেল জনসন। কিন্তু প্রথম বলেই বুদ্ধিদীপ্ত সিঙ্গেল এ মাইক হাসিকে স্ট্রাইক প্রান্ত দেন জনসন। দরকার তখন ৫ বলে ১৭ রান। বোলিংয়ে তখন অন্যতম সেরা বোলার সাঈদ আজমল।

ওভারের দ্বিতীয় বলেই স্কয়ার লেগ দিয়ে বিশাল ছক্কা হাঁকান মাইক হাসি। প্রথম ছক্কা হজমের পর কিছুটা ব্যাকফুটে চলে যাওয়া সাঈদ আজমল ওভারের তৃতীয় বলটি শর্ট বল করে ফেলেন। এই বলেও বাউন্ডারির সীমানা ছাড়া করেন মাইক হাসি। চতুর্থ বলে সাঈদ আজমলের লক্ষ্য ছিল অফ স্ট্যাম্পের কিছুটা দূর দিয়ে বল করা যেন মাইক হাসির নাগাল পেতে কষ্ট হয়। কিন্তু এই বলও চারে রুপান্তর করেন হাসি। নিপুণ কাট শটের মাধ্যমে ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগ দিয়ে চার মারেন মাইক হাসি।

এই চারের মাধ্যমেই দুই দলের রান সমতায় চলে এসেছিলো। অজিদের জন্য দরকার ছিল মাত্র একটি রান ৷ এক রান সংগ্রহ করতে গিয়েও ছক্কা হাঁকিয়ে বসেন মাইক হাসি। শেষ ওভারে ১৮ রানের সমীকরণ মাত্র ৬ বলেই পাড় করে ফেলেন মাইক হাসি। ম্যাচের চিত্রনাট্য বদলে ফেলা ইনিংসে হাসি তিনটি চার আর আধা ডজন ছক্কায় ৬০ রান করেন। ইনিংসটা অবশ্যই বিশ্বকাপের মঞ্চের সেরা টি-টোয়েন্টি ইনিংসগুলোর একটি।

ভিভ রিচার্ডসন বলেছিলেন, ‘দরকারটা যখন গুরুতর, চ্যাম্পিয়নরা তখনই নিজেদের সবচেয়ে বেশি মেলে ধরেন।’ এই কথাটারই বাস্তব উদাহরণ সেদিন দেখিয়েছিলেন হাসি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link