হার্শা, আফগান মানে কি মানুষ নয়?

হার্শা ভোগলে — আপনি আমার আদর্শ। নিজের পড়াশোনার ক্ষেত্র ছেড়ে আপনি সেই আশির দশকে সাহস দেখিয়েছিলেন সম্পূর্ণ অনিশ্চিত এবং অশ্রুত ক্যারিয়ার বেছে নিয়ে। দেশের সেরা প্রতিষ্ঠান থেকে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পড়ে রেডিওতে কমেন্ট্রী করতে যাওয়া— নাহ, আপনার আগে কেউ ভাবেনি। আপনার পরেও কেউ – নয় নয় করে প্রায় চল্লিশ বছর হতে চলল।

স্পোর্টস ইলাস্ট্রেডে ’৮৬ সালে দেশের সর্বকালের সেরা স্কুলবয় ক্রিকেটারের ইন্টারভিউ ছাপা হয়েছিল। আপনি চিনতে পেরেছিলেন হীরক খন্ডকে। ১৪ বছরের ছেলেটিকে আপনি প্রথাগত বোরিং প্রশ্ন করেনি। সে মন খুলে আপনাকে জানিয়েছিল, একবার সেট হয়ে গেলে সে আর চাপ নেয় না। তার ওপরে টিমের বা দর্শকের প্রত্যাশা এসব নিয়ে ভাবে না। নিজের মতো খেলে যায়। অন্তত তখন সে সেরকম ভাবতো। কি পরিষ্কার চিন্তন। একটি বাচ্চার। যে কিনা আরো চার বছর টিন এজার থাকবে। আপনি না থাকলে তো আমরা এটা কখনো জানতেই পারতাম না, হার্শা।

তারপর গঙ্গা-ভোলগা দিয়ে গ্যালন গ্যালন জল বয়ে গেছে। আপনার চুল পড়েছে, টাক বেড়েছে। সেই টাকে আপনি আবার চুল বসিয়েছেন। কিন্তু আপনার বাগ্মিতায় প্রভাব পরেনি। বছরের পর বছর বরং আরো ধারালো হয়েছে আপনার জিভ। আপনার ক্ষুরধার বিশ্লেষণ। তরতর করে এগিয়ে চলেছেন। রেখেছেন বেশ কিছু মনে থাকার মতো মন্তব্য। বলেছেন সবার নিজের লিমিটেশন বোঝা উচিত।

যেমন আমি গাভাস্কারের সাথে কমেন্ট্রী করতে বসলে ডিফেন্সিভ ব্যাটিং নিয়ে কথা বলি না। আবার আকরামের পাশে কক্ষনো সুইং নিয়ে মুখ খুলি না। শচীন টেন্ডুলকারকে নিয়ে বলতে গিয়ে বলেছেন, এই নিন সত্তরটা সেঞ্চুরি আপনার হাতে তুলে দিলাম এভাবে শচীনের মায়ের হাতে সদ্যোজাত শচীনকে নার্স তুলে দেননি। সত্তরটি সেঞ্চুরি শচীনকে বেশ কষ্ট করে, ঘাম ঝরিয়ে, স্কিল প্রদর্শন করে করতে হয়েছে।

বেশ তরতর করে এগোচ্ছিল আপনার ধারাভাষ্য। আমরাও আপনার সাথে সাথে বড় আর বুড়ো হচ্ছিলাম। আপনাকে কেনো আমাদের এতো ভালো লাগে জানেন? যখন কিছু মূর্খ এসে বলে শচীনকে নিয়ে আলোচনা করছো? স্টেট লেভেলেও তো খেলো নি। ওয়াসিম আকরামের সমালোচনা করছো? জীবনে কখনো ৫০ মাইল স্পিডে বল করেছো?

তখন আমরা আপনার দিকে তাকাই। আপনিই তো আমাদের শিখিয়েছেন, সর্বোচ্চ পর্যায়ের খেলোয়াড় না হলেও সেই খেলা নিয়ে আলোচনা করা যায়, কাটা-ছেঁড়া করা যায়। সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেটারদের নিয়েই করা যায়। হাতে কলমে করে দেখিয়েছেন।

হঠাৎ ছন্দপতন হল। আপনি ২০১৬ সালে বিসিসিআই এর রোষানলে পরলেন। আপনি নিজেই লিখলেন, কেউ আমায় বলেনি কেনো আমি বাদ পরলাম। কেউ যদি এটা বলতো যে ভাই তুমি যথেষ্ট উঁচু মানের কমেন্ট্রী করতে পারছো না, তাহলেও কিছু একটা মানে দাঁড়াতো। কিন্তু কেউ কিছু বলার প্রয়োজন মনে করলো না। এই উপেক্ষা আপনাকে গভীর যন্ত্রণায় নিমজ্জিত করে ফেলল। ভেতরে ভেতরে আপনি কি জানতেন না? কী সেই কারণ। অবশ্যই জানতেন। সারা পৃথিবী জানতো। অমিতাভ বচ্চনের সেই টুইট। কী লেখা তাতে?

একজন ভারতীয় ধারাভাষ্যকরের উচিত নিজেদের দেশের খেলোয়ারদের কথা বেশী করে বলা। এবং তারপর প্রবল প্রতাপশালী ভারতীয় কাপ্তেন মহেন্দ্র ধোনির রিটুইট। যাতে লেখা— আমার আর কিছু যোগ করার নেই। সেই ধোনি, যিনি দুঃখেষুনিরুদ্বিগ্নমনা। শত প্রলোভনেও যিনি মুখ খোলেন না। তিনি মুখ খুললেন। আপনি অবশ্যই জানতেন, যে আপনার ঘাড়ে কোপ আসতে চলেছে। শুধু ভাবতে পারেন নি, এত বছর সার্ভিসের পর কোনো কারণ না দর্শিয়েই আপনাকে ছুঁড়ে ফেলা হবে। উপেক্ষা সহ্য করতে পারেন নি। কেউ জিগ্যেস করেন নি, তবুও আপনি আত্মপক্ষসমর্থনে খোলাখুলি সোশাল মিডিয়ায় লিখলেন।

যাগগে, সে রাম’ও নেই, সেই রাজত্ব’ও নেই। আপনার কেরিয়ারের মেঘ কেটে গেছে। আপনি আবার ক্রিকেটের মূলস্রোতে ফেরত এসেছেন। বেশ অনেক দিন হলো। বেশ কয়েক বছর ধরে পুরনো হর্ষকে আমরা শুনতে এবং দেখতে পাচ্ছি। আপনার গলার উত্তেজনা ছোঁয়াচে হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে কোটি কোটি শ্রোতার ধমনীতে। এই নতুন হর্ষ একটু বেশী সাবধানী। সুনীল গাভাস্কারকে যেখানে নির্দোষ মজা করার জন্য ক্ষমা চাইতে হয়। সেখানে হর্ষ ভোগলে কে? আপনাকে তো সাবধানে থাকতেই হবে।

হঠাৎ পুনরায় ছন্দপতন। আজকে। ৫ই মে, ২০২৩, গুজরাট বনাম রাজস্থানের আইপিএল ম্যাচে।

আফগান স্পিনারদের সাফল্য নিয়ে স্ট্যাট দেখানো হচ্ছে। ধারাভাষ্যকর নিজের মত রাখবেন। হয় স্ক্রিনে যা দেখা যাচ্ছে তার থেকে আলাদা কিছু বলতে হবে, অথবা চুপ করে থাকতে হবে। চ্যানেল নাইনে রিচি বেনোর অমোঘ শিক্ষা। আপনি কী করলেন? মুখ খুললেন। আপনি বললেন, আমি জানি এরকম দু’হাজার স্পিনার আফগানিস্তানের ট্রেনিং সেন্টারগুলোয় প্র্যাক্টিস করছে। তারপরে উল্লসিত স্বরে মন্তব্য করলেন, আমাদের উচিত আফগানদের সাথে একটা এমওইউ সাক্ষর করা।

তারপর স্পিনারদের ধরে ধরে আফগানিস্থান থেকে ‘এক্সপোর্ট’ করা উচিত। এক্সপোর্ট— ঠিক এই শব্দটিই। শুনেই কেমন জানি কানে খট করে লাগলো। সেই কৃষ্ণাঙ্গ দাস-দাসী এক্সপোর্ট করা হতো আফ্রিকা থেকে। অথবা আমাদের রাজ্যের অধুনা বহুলপ্রচারিত গরুপাচার। আপনার এত বছরের অভিজ্ঞতা, আই আই এমের ডিগ্রী— আপনি পারতেন না অন্য শব্দ চয়ন করতে?

ঠিক দশ মিনিট’ও হয় নি। পছন্দের মানুষকে যেটুকু গ্রেস মার্ক আমরা এদিক ওদিকে তাকিয়ে দিয়ে দিই, সেরকম দিয়ে ফেলেছি আর কী। ঠিক আছে, মুখ ফসকে বলে ফেলেছেন। ওরকম হয়। কিন্তু না। আয়ারল্যান্ডের তরুণ বোলার এসেছেন আপনার সামনে। পোস্ট ইনিং ইন্টারভিউ। ভালো বল করেছেন বলেই ওকে নিয়ে আসা হয়েছে আপনার মতো পোড়খাওয়া সাংবাদিকের সামনে। সে ছেলেটি অত্যন্ত ভদ্র।

তার সাফল্যের রহস্য জানতে চাইলেন আপনি। সে খোলসা করে বললো, আশিষ নেহরা এবং সে নিজে মিলে প্রচুর খেটেছে বোলিং এর উন্নতিকল্পে। ছেলেটি বললো উই(we)। আপনি স্থির থাকতে পারলেন না। আপনার জিভের মুখোশ খসে পরলো। আবার মুখ খুললেন, তুমি নিশ্চিত, উই? এও বলে বসলেন, আয়ারল্যান্ডের তরুণকে, যা মাতৃভাষা ইংরেজী— ইউ মানে কিন্তু সিঙ্গুলার আর প্লুরাল দুটোই হয়। একটি মুখের কথায় আপনি দুটো অপমান ছুঁড়ে দিলেন— ১) আশিষ নেহরার ইংরেজী জ্ঞানের অভাব, ২) আশিষ নেহরার অবদান নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন।

তরুণ ছেলেটি মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। তারপর মুখের পেশী অবিকৃত রেখে বললো, আমি নিশ্চিত আমি নিজে ইংরিজী জানি। অ্যান্ড সো ডাজ হি। মানে, নেহরাও জানেন। এই সপাট জবাব পেয়ে কেমন লাগলো হার্শা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link