পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশকে ক্রিকেটার তৈরির কারখানা বললে মোটেও ভুল হয় না। এই প্রদেশ থেকেই উঠে এসেছেন মোহাম্মদ রিজওয়ান, মোহাম্মদ ওয়াসিম, নাসিম শাহ্, শাহিন শাহ্ আফ্রিদি , ফখর জামানের মতো ক্রিকেটাররা।
এমন না যে, এখানে ক্রিকেটের জন্য অনেক সমৃদ্ধ ব্যবস্থা আছে। কিন্তু পাখতুনখোয়ার মানুষ জন্ম থেকেই একজন যোদ্ধার মতো বেড়ে ওঠে। শত সীমাবদ্ধতাও তাদের অদম্য মানসিকতা আর কঠোর পরিশ্রমের কাছে পাত্তা পায় না। খাইবার পাখতুনখোয়ার এমন সীমাবদ্ধতার বেড়াজাল টপকে বাইশ গজের ক্রিকেটে ‘যোদ্ধা’ রূপে জানান দেওয়া আরেক ক্রিকেটারের নাম ইফতিখার আহমেদ।
ব্যাটিং স্ট্যান্স, ব্যাটের মুভমেন্ট- সবকিছুতেই পাকিস্তানের প্রাক্তন ক্রিকেটার মিসবাহ উল হকের একটা ছাপ আছে ইফতিখারের ব্যাটিংয়ে। ক্রিকেট ক্যারিয়ার গড়েছেন সেই মিসবাহকে আদর্শ মেনেই। ইফতিখারের টেস্ট ও ওয়ানডে ক্রিকেট অভিষেকও হয় মিসবাহর অধিনায়কত্বে।
তবে তারও বহু আগে এসএনজি ওয়েল দলের একবার খেলেছিলেন ইফতিখার। আর সেই দলের অধিনায়ক ছিলেন মিসবাহ। তাই মিসবাহর সাথে জানাশোনা ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই। ইফতিখারের বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে প্রায়ই উঠে আসে মিসবাহর নাম। কারণ তাঁর মতে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আসা অব্দি এবং পরবর্তীতে পাকিস্তানের হয়ে খেলার সময়- সব সময়ই তিনি পেয়েছেন মিসবাহর সান্নিধ্য।
তবে, ইফতিখারের ক্রিকেট ক্যারিয়ার অগ্রযাত্রায় অবদান রয়েছে আরো একজনের। তিনি আব্দুর রহমান সাহিব। ২০১২ সালে তিনি কোয়েটার কোচ হয়ে আসলেন। এসেই তরুণ প্রতিভার খোঁজ করলেন। পেয়েও গেলেন দ্রুতই। ইফতিখারকে তাঁর মনে ধরলো বেশ। সেই আব্দুর রহমানের অধীনেই লিস্ট এ ক্রিকেটে অভিষেক হলো ইফতিখারের।
এর পর থেকেই ইফতিখারের উত্থানের গল্প লেখা শুরু। লিস্ট এ ক্রিকেট এবং প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট- দুই ফরম্যাটেই সমান তালে রান করে যাচ্ছিলেন। দুটিতেই চল্লিশের উপরে গড় রেখে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের চেয়ে ইফতিখার লিস্ট এ ক্রিকেটে যেন আরো সফল। প্রায় ৫০ গড়ে মৌসুমের পর মৌসুম রানবন্যা বইয়ে দিচ্ছিলেন।
কিন্তু কী এক বৈপরীত্য। যে ইফতিখার লঙ্গার ভার্শন আর লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে দ্যুতি ছড়াচ্ছিলেন সেই ইফতিখারের পরিচিতি হয়ে উঠল একজন টি-টোয়েন্টি ব্যাটার হিসেবে। অবশ্য প্রথমে সুযোগ এসেছিল ওয়ানডে আর টেস্টেই। ২০১৫ সালে ওয়ানডেতে অভিষেক, আর পরের বছর ২০১৬ তে টেস্ট।
অবাক করা ব্যাপার হলো, অভিষেকের প্রায় ৮ বছর হতে চললো। কিন্তু পাকিস্তানের হয়ে ওয়ানডে আর টেস্ট মিলিয়ে ম্যাচ খেলেছেন মোটে ১৪ টি। বোঝাই যাচ্ছে, নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ পেয়েছেন কম। তাই ঘরোয়া ক্রিকেটের ছাপ রাখতে পারেননি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে।
তবে টেস্ট আর ওয়ানডেতে না পারলেও পাকিস্তানের টি-টোয়েন্টি নিয়মিত এক মুখ ইফতিখার আহমেদ। ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের হয়ে সর্বোচ্চ দুটি ফিফটি এসেছিল তাঁর ব্যাট থেকে।
বরাবরই টেস্ট আর ওয়ানডে ক্রিকেট খেলার জন্য মুখিয়ে থাকা ইফতিখার এরপর থেকেই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে নিজেকে শাণিত করতে শুরু করেন। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটেও দ্যুতি ছড়াতে শুরু করলেন। নিজ দেশের সীমান্ত পেরিয়ে খেলার সুযোগ পেলেন লঙ্কান প্রিমিয়ার লিগে। এরপর সেই রেশে সুযোগ পেয়েছেন বিপিএলেও।
সাকিবের দল ফরচুন বরিশালের হয়ে খেলছেন তিনি। আছেন দুর্দান্ত ফর্মে। রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে সেঞ্চুরি হাকিয়ে পেয়েছেন ক্যারিয়ারের প্রথম টি-টোয়েন্টি শতকের দেখা। এখন পর্যন্ত ২৭৩ রান করে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের তালিকায় রয়েছেন ৪ নম্বরে।
ইফতিখার আহমেদকে কোনো এক অদ্ভুত কারণে ‘চাচা’ বলে ডাকা হয়। বয়স এমন আহামরি বেশিও না, কেবল ৩২। তারপরও তাঁকে চাচা নামে ডাকার কারণ কী? এর নেপথ্যের ঘটনা অনেকেরই অজানা। মূলত এটা মানুষেরই দেওয়া এক নাম। তবে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এক ম্যাচ খেলার সময় এই নামটা প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল। অধিনায়ক বাবর আজম ইফতিখারের হাতে বল তুলে দেন। পিচে সে সময়টা খুব স্পিন ধরছিল। ইফতিখারও টার্ন করার চেষ্টা করলেন।
তো ইফতিখার তখন বল করতে যাচ্ছিলেন ব্রেন্ডন টেলরের বিপক্ষে। বল করার আগে ইফতিখার বাবরকে ফিল্ডারের জায়গা পরিবর্তন করলেন। মিড উইকেটের ফিল্ডার সরিয়ে স্কোয়ার ডিপ লেগে ফিল্ডার আনতে বললেন। কিন্তু বাবর তা করতে নারাজ। কারণ তাতে অনায়াসেই ছক্কা মারতে পারেন টেলর। কিন্তু ইফতিখারের জোরাজুরিতে শেষমেষ বাবর ফিল্ডার পরিবর্তন করলেন। এর ঠিক পরের বলেই টেইলর সেই স্কোয়ার ডিপ লেগেই ক্যাচ দিয়ে আউট হয়ে ফিরে যান।
আর ইফতিখারের এমন দুরদর্শিতা দেখে বাবর চাচা-ই ক্রিকেট বলে সম্বোধন করে বসেন। ব্যাস। এর পর থেকেই ইফতিখারের পাশে চাচা নামের উদ্ভব। টিমম্যাট থেকে শুরু করে চাচা নামটা ছড়িয়ে যায় সমর্থকদের মধ্যেও।
ক্রিকেটের এ চাচার বড় এক আক্ষেপ আছে। ক্যারিয়ার সাজাতে চেয়েছিলেন ওয়ানডে আর টেস্টকে ঘিরে। কিন্তু সেই পর্যাপ্ত সুযোগটাই এখনও আসেনি। অবশ্য যাকে আদর্শ মেনে ক্রিকেট খেলেন সেই মিসবাহর ক্যারিয়ার সমৃদ্ধি হয়েছে তো বয়স ত্রিশ পেরোনোর পরেই।
তাই উত্তরসূরি হয়ে মিসবাহ সেই পদচ্ছাপ অনুকরণ করার সুযোগ এখনও রয়েছে ইফতিখারের সামনে। পাকিস্তান ক্রিকেটের ‘বড়ে মিয়া’ ছিলেন জাভেদ মিয়াদাদ। কে জানে, পাকিস্তান ক্রিকেটে স্মরণীয় চাচা হয়ে উঠতে পারেন এই ইফতিখার আহমেদ।