আটের দশকের শুরু থেকেই ইমরান খান বিশ্ব ক্রিকেটে ইয়ান বোথাম আর কপিল দেবের সঙ্গে অলরাউন্ডার হিসেবে আলোচিত নাম। তবুও সেই সময় ওনাকে মূলত বোলার হিসেবেই দেখত ক্রিকেট বিশ্ব। এবং ভয় পেত।
সেই বিখ্যাত ‘ইন ডিপার’ তো ছিলই, সেই সঙ্গে ছিল ভয়াবহ গতি, রিভার্স স্যুইং আর অত্যন্ত অসুবিধেজনক লেন্থ থেকে বল বাউন্স করানোর ক্ষমতা। ভারতের বিরুদ্ধে এক সিরিজে ৪০ উইকেট নেওয়ার গল্প প্রায়ই শুনতাম প্রবীণদের কাছ থেকে। আর নিজের চোখের সামনে দেখেছিলাম শারজার মাটিতে একদিনের ম্যাচে মাত্র ১৪ রানের বিনিময়ে ছয় উইকেট নিয়ে ভারতকে ১২৫ রানে শেষ করে দেওয়ার বীরত্ব।
তবে লোকটাকে খুব একটা পছন্দ করতাম না। বিশ্ব কবি আর রাজশেখর বসু মহাশয় যতই কর্ণের মহত্ব প্রচার করার চেষ্টা করুন, আমি চিরকালই অর্জুনের দলের লোক। ক্রিকেট মাঠে আমার কাছে সেই অর্জুনসম ছিলেন কপিলদেব। তবে এটাও বা অস্বীকার করি কীভাবে যে কর্ণের বীরত্বের গাথা পড়বার সময়েও শরীরে শিহরন খেলত। এমন কি কর্ণ-অর্জুনের যুদ্ধে যদিও আমার ইমোশনাল সাপোর্ট সব সময়ই তৃতীয় পাণ্ডবের দিকে থাকত, কর্ণের বীরত্বের কাহিনীও আমি খুবই উপভোগ করতাম।
সেই যাই হোক, যে ম্যাচের বিষয়ে আমি আলোচনা করব সেটায় কোনরকম কনফ্লিক্টের সম্ভাবনা ছিল না কারণ ম্যাচটি ছিল পাকিস্তান আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যে শারজাতে। নেট ঘেঁটে দেখলাম ম্যাচটার তারিখ – ১৫/১১/১৯৮৫।
প্রথমে ব্যাট করে পাকিস্তান খুব একটা সুবিধে করতে পারে নি তখনও অব্দি। ক্রিজে ব্যাট হাতে যদিও ইমরান কিন্তু তিনি সবে নেমেছেন মাঠে। এবং ইনিংসের শেষ ওভারে যে লোকটিকে বল হাতে বোলিং মার্কের দিকে এগোতে দেখা গেল তাকে দেখে বড় বড় ব্যাটধারীর মুখ শুকিয়ে যেত। নাম শুনেছেন হয়ত – জোয়েল গার্নার।
যদিও টেস্ট ক্রিকেটে ম্যালকম মার্শাল, মাইকেল হোল্ডিং বা অ্যান্ডি রবার্টসের নাম বেশি, কিন্তু একদিনের ক্রিকেটে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বোলারটির নাম যে জোয়েল গার্নার সেই বিষয়ে খুব বেশি বিতর্ক নেই। আইসিসির বোলারদের মধ্যে সর্বোচ্চ রেটিং প্রাপ্ত হিসেবেও এক নম্বরে এই ৬’৮” লম্বা মানুষটিই রয়েছেন।
সে যাই হোক শেষ ওভার শুরু হো। কিন্তু তারপর যা ঘটলো তার জন্যে আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। সম্ভবত তিনটে সুবিশাল ছক্কার সাহায্যে ইমরান ২২ রান নিলেন গার্নারের সেই ওভারে। প্রায় স্পিনারের মতো ক্রিজ ছেড়ে এগিয়ে এসে এসে গার্নারকে লিফট করলেন অনায়াসে। অন্তত দুটো বল গিয়ে পড়ল দর্শকদের মাঝে। নিজের নয় ওভারে ৫৯ রান দেন গারনার যা তখনকার দিনে অকল্পনীয়।
এর আগে অবধি ইমরানকে যদিও মোটামুটি নির্ভরযোগ্য ব্যাট হিসেবে চিনতাম, কিন্তু সঙ্গে এটাও জানতাম যে বোথাম বা কপিলের মতো তাঁর হাতে বিস্ফোরক স্ট্রোক নেই। একদিনের ক্রিকেটে যেখানে কপিলের স্ট্রাইক রেট ৯৫, ইমরানের সেখানে ৭২। সুতরাং ইনিংসের শেষ ওভারে যে উনি গার্নারের মাপা লেন্থ-লাইনের বলগুলির বিরুদ্ধে খুব একটা সুবিধে করতে পারবেন তেমন আশা করিনি।
পরে অবশ্য জানলাম যে ইমরান মাঝে মধ্যেই এরকম গিয়ার চেঞ্জ করতে পারদর্শী। একবার ভারতের বিশ্ববিখ্যাত স্পিনারদের ঠেঙিয়ে প্রায় ড্র হওয়া ম্যাচ পাকিস্তানকে জিতিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর নেহেরু কাপের ফাইনালে… থাক! সেটা আর মনে করতে চাই না।
অবশেষে অবশ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচটা অনায়াসেই জিতে নিয়েছিল। রিচি রিচার্ডসন ৯৯ আর ভিভ ৫১ রান করেন।
তবে ক্রিকেট খেলার সৌন্দর্য্য এখানেই। একটা সাদামাটা ম্যাচের মধ্যেও এমন কিছু মুহূর্ত, এমন কিছু দ্বৈরথ লুকিয়ে থাকে যা দর্শকদের মনে চিরকাল গেঁথে থাকে।