থমকে যাওয়া দমকা হাওয়া, ইমরান নাজির!

ইমরান নাজিরের ক্রিকেটীয় প্রতিভা দেখে অনেকেই বলেছিলেন - ‘ঈশ্বরপ্রদত্ত’। দুর্দান্ত শট, মারমুখী ব্যাটিংয়ে আখ্যা পেয়েছিলেন পাকিস্তান ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ তারকার।

আগ্রাসী ব্যাটিং আর দুর্দান্ত ফিল্ডিং দিয়ে সবার নজরে এসেছিলেন সাবেক পাকিস্তানি ওপেনার ইমরান নাজির। ক্রিকেটীয় প্রতিভা নিয়েই যেন জন্মেছিলেন এই ওপেনার। মারকাটারি ব্যাটিংয়ে নজর কেড়েছিলেন সবার। বিশ্বসেরাদের কাতারে যাওয়ার সামর্থ্য আর সম্ভাবনা সবটাই ছিল নাজিরের মাঝে।

আগ্রাসী ব্যাটিং স্টাইল, দৃষ্টিনন্দন শটে মুগ্ধ করেছিলেন ক্রিকেট সমর্থকদের। তাঁকে ভাবা হচ্ছিল ‘লম্বা রেসের ঘোড়া’।তবুও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দিতে পারেননি সামর্থ্যের সিকিভাগও। বিশ্ব ক্রিকেটে সেরা হতে এসে ক্যারিয়ার শেষ করেছেন ‘ডমেস্টিক গড’ হিসেবে! শট সিলেকশন, অধারাবাহিকতা আর নিজের খামখেয়ালীপনা নাজিরের ক্যারিয়ারের পুরো হুলিয়াই পাল্টে দিয়েছে।

পাকিস্তানের টি-টোয়েন্টি ইতিহাসে সবচেয়ে সফল দল হচ্ছে শিয়ালকোট স্টলিয়ন্স। ২০০৫-২০১০ এর মধ্যে টানা পাঁচ ন্যাশনাল টি-টোয়েন্টি কাপ জিতে দলটি। টি-টোয়েন্টি ইতিহাসে টানা ২৫ ম্যাচ জয়ের রেকর্ডটাও এই দলের বিপক্ষেই।

শিয়ালকোটের এই সাফল্যের পেছনের অন্যতম কারিগর ছিলেন ইমরান নাজির। শিয়ালকোটের হয়ে টি-টোয়েন্টিতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক নাজির। একই সাথে কমপক্ষে ১০ ম্যাচ খেলেছেন এমন ক্রিকেটারদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্ট্রাইকরেটধারীও (১৬২) তিনি।

বর্তমান সময়ে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ১৫০-৬০ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করা নিতান্তই সাধারণ ব্যাপার। তবে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের জন্মলগ্ন থেকেই নাজির ১৫০-৬০+ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করতেন নিয়মিত। ঘরোয়া ক্রিকেটের পারফরম্যান্স বা ব্যাট হাতে আগ্রাসী মেজাজটা ঠিক টেনে আনতে পারেননি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে।

ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগে (আইসিএল) খেলতে গিয়ে ক্যারিয়ার শেষ করেছেন এমন ক্রিকেটারের সংখ্যা কম নয়। এর মাঝে ইমরান নাজিরও অন্যতম। তবে নাজিরের ক্যারিয়ারে আইসিএলের প্রভাবটা ঠিক সেভাবে পড়েনি। ২০০৮ সালে আইসিএলে খেলা ক্রিকেটারদের উপর পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি) নিষেধাজ্ঞা দিলেও কোর্টের নির্দেশে এক বছরের মাথায় নিষেধাজ্ঞা উঠে যায় পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের।

আর এর কারণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে খুব একটা বাঁধা ছিল না নাজিরের। তবে নিষেধাজ্ঞা শেষে ক্যারিয়ারে আর আশার আলো দেখতে পারেননি তিনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নাজিরের আশার আলো তখন নিভু নিভু প্রায়। অবশ্য নাজিরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে দুর্দশার মূল কারণটা অধারাবাহিকতা।

বড় ভাই মুশতাক আহমেদকে দেখেই ক্রিকেটে পথচলা নাজিরের। আইডলও মানেন বড় ভাইকেই। মুশতাক গুজরানওয়ালা ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের হয়ে খেলতেন। শেখুপুরার হয়ে তিনটি লিস্ট এ ম্যাচেও খেলেছেন মুশতাক। লাহোরের হয়ে লম্বা সময়ে ধরেই খেলেছেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে। মুশতাকের অনুপ্রেরণাতেই ক্রিকেটে ক্যারিয়ার গড়া নাজিরের।

১৯৯৯ এর মার্চে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে লাহোরে টেস্ট অভিষেক হয় নাজিরের। মাত্র ১৭ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন নাজির। অভিষেকেই খেলেন ৬৩ রানের অসাধারণ এক ইনিংস। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অল্প বয়সে নাজিরের ব্যাটিং দেখে অনেকেই ভেবেছিলেন পাকিস্তান ক্রিকেট অমূল্য রতন খুঁজে পেয়েছে।

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই ভারতের মাটিতে ওয়ানডেতেও অভিষিক্ত হন তিনি। অবশ্য ওয়ানডে অভিষেকের প্রথম দুই ম্যাচে করেন মাত্র ৬ রান! এরপর এক বছর ছিলেন দলের বাইরে। পরের বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে সাদা পোশাকে নিজের দ্বিতীয় টেস্টেই দেখা পান প্রথম সেঞ্চুরির।

কার্টলি অ্যাম্ব্রোস, কোর্টনি ওয়ালশদের সামনে দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি তুলে নেন নাজির। এর পরের তিন টেস্টে ছিল হতাশাজনক পারফরম্যান্স। এরপর ২০০৩ সালে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে দেখা পান ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেঞ্চুরির! বাকি দুই টেস্টে ব্যাট হাতে চরম বাজে প্রদর্শনীর পরই বাদ পড়েন দল থেকে। এরপর আর টেস্টে ফিরতে পারেননি তিনি।

টেস্ট ক্যারিয়ারে ৮ টেস্টে ১৩ ইনিংসে করেন ৪২৭ রান। এর মধ্যে দুই সেঞ্চুরি আর এক ফিফটিতে করেন ৩২২ রান! বাকি ১০ ইনিংসে করেন মোটে ১০৫ রান! চরম অধারাবাহিকতাই অল্প সময়ে নাজিরের টেস্ট ক্যারিয়ারের ইতি টেনে দেয়।

ওয়ানডেতে ছিলেন অনেকটাই নিয়মিত মুখ। ২০০০ সালে এক বছরেই খেলেছিলেন সর্বোচ্চ ২৭ ম্যাচ! ওই বছরই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দেখা পান মেইডেন ওয়ানডে সেঞ্চুরির। শহীদ আফ্রিদির পর দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে সবচেয়ে কম বয়সে ওয়ানডে সেঞ্চুরির কীর্তি গড়েন নাজির। বর্তমানে সাদা বলের ক্রিকেটে সবচেয়ে কম বয়সে সেঞ্চুরির তালিকায় তিনে আছেন এই ওপেনার। ওই বছর ৪ ফিফটি আর ১ সেঞ্চুরিতে ক্যারিয়ারের সেরা সময়ই পার করেন তিনি।

পরের বছর ২০০১ সালটা খুব বাজে সময় পার করেন এই ওপেনার। দল থেকে বাদও পড়েন। তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে তাঁর নিয়মিত পারফরম্যান্স আবার সুযোগ করে দেয় জাতীয় দলে। এরপর ২০০২ সাল পর্যন্ত দলের নিয়মিত মুখই ছিলেন তিনি। তবে অধারাবাহিক পারফরম্যান্স তাঁর দলে থাকা নিয়েও বার বার প্রশ্ন তুলছিল। পরের দু’বছরে সুযোগ পান মাত্র ৮ ম্যাচে!

দল থেকে বাদ পড়লেই ঘরোয়া ক্রিকেটে নজরকাঁড়া পারফরম্যান্স দিয়ে আবার ফিরে আসতেন জাতীয় দলে। এই যেন কাল হয়ে দাঁড়ায় নাজিরের ক্যারিয়ারে।

সাবেক পাকিস্তানি পেসার রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেস খ্যাত শোয়েব আখতার নাজিরের ব্যাপারে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘বীরেন্দ্র শেবাগের চেয়েও বেশি কিছু সম্ভাবনা ছিল নাজিরের। তবে টিম ম্যানেজমেন্টের গাফিলতিতেই নাজিরের ক্যারিয়ার থমকে গিয়েছে অল্পতেই।’

শোয়েবের কথা অবশ্য ফেলে দেওয়ারও নয়। জাতীয় দল থেকে বাদ পড়লেই ঘরোয়া ক্রিকেটে দাপট দেখিয়ে দ্রুতই আবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরতেন নাজির। নিজেকে নিয়ে খুব বেশি কাজও করতেন না তিনি।

তবে এই আসা-যাওয়ার রীতিটা থেমে যায় ২০০৪ সালে। নির্বাচকরাও বিরক্ত ছিলেন নাজিরের অধারাবাহিকতায়।টানা হতাশাজনক পারফরম্যান্সে দল থেকে বাদ পড়েন নাজির। প্রায় তিন বছর জাতীয় দলে ফিরতে পারেননি তিনি। ইমরান ফরহাত, মোহাম্মদ হাফিজ, তৌফিক উমর, সালমান বাট, ইয়াসির হামিদদের ভীড়ে ওপেনিংয়ে জায়গা মেলাতে ব্যর্থ হন নাজির।

২০০৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ দিয়ে আবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরেন এই ওপেনার। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে খেলেন ৩৯ বলে ৫৭ রানের অসাধারণ এক ইনিংস।

ওই সিরিজেই আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতেও অভিষিক্ত হন তিনি। অভিষেক ম্যাচে করেন মাত্র ৫ রান। এরপর ২০০৭ ওয়ানডে বিশ্বকাপে জায়গা পান তিনি। ওই বিশ্বকাপেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বিশ্বকাপে প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পান নাজির। ১৬০ রানের অসাধারণ এক ইনিংসের পথে পাকিস্তানের হয়ে বিশ্বকাপে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানের মালিক হন তিনি।

এরপর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও ডাক পান তিনি। ওই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেই খেলেন ২৯ বলে ৪৯ রানের তান্ডবময় ইনিংস। সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৪১ বলে ৫৯ রানের দুর্দান্ত এক ম্যাচ জয়ী ইনিংস খেলে দলকে ফাইনালে তোলেন নাজির।

টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের মেইডেন ফিফটির দেখাও পান ওই ম্যাচেই। এরপর ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে ১৪ বলে ৩৩ রানের ঝড়ো ইনিংস খেললেও মাত্র ৫ রানে হেরে শিরোপা জয়ের আক্ষেপে পোড়ে নাজির-মিসবাহরা।

এরপরই আইসিএলে যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞার মুখে প্রায় দেড় বছর ছিলেন ক্রিকেটের বাইরে। নিষেধাজ্ঞা উঠলে ২০০৯ সালে আবার জাতীয় দলে ফেরেন তিনি।

২০০৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান কোর্টের নির্দেশে আইসিএলে খেলা ক্রিকেটারদের নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে দেওয়া হয়। ওই বছরের আগস্টে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজে আবারও দলে ফেরেন তিনি। নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফিরলেও খুব বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি নাজির।

৫ ওয়ানডেতে কোনো ফিফটির দেখা পাননি তিনি। এরপরই বাদ পড়েন ওয়ানডে দল থেকে। এরপর ২০১০ হংকং সুপার সিক্সেস টুর্নামেন্টে পাকিস্তানের হয়ে খেলার সুযোগ পান তিনি। ওই টুর্নামেন্টের ফাইনালে নাজিরের বোলিংয়েই ম্যাচ হারে পাকিস্তান! শেষ ৮ বলে দরকার ছিল ৪৬ রানের! নাজির ৭ বলেই দেন ৪৮ রান!

খেলেছেন ফ্র‍্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট টুর্নামেন্টও। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) ঢাকা গ্লাডিয়েটরসের ৭ ম্যাচে ৪১ গড়ে ১৫০ স্ট্রাইক রেটে ২০৭ রান করেছেন তিনি। এছাড়া জাতীয় লিগেও ঢাকার হয়ে খেলেছেন এই ওপেনার।

এরপর ২০১২ সালে পাকিস্তান দলে আবার ডাক পান তিনি। ২০১২ টি-টোয়েন্ট বিশ্বকাপ দলে ডাক পান নাজির। ওই টুর্নামেন্টে ৬ ম্যাচে প্রায় ২৬ গড়ে ১৫০ স্ট্রাইক রেটে ১৫৩ রান করেন তিনি। বাংলাদেশের বিপক্ষে ৩৬ বলে ৭২ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংসও খেলেন এই ওপেনার। ওই বিশ্বকাপের পর আর জাতীয় দলে ফিরতে পারেননি এই মারকুটে ওপেনার।

রঙিন পোশাকে ৭৯ ওয়ানডেতে ২৫ গড়ে করেছেন ১৮৯৫ রান। ২ সেঞ্চুরি আর ৯ ফিফটি করেছেন এই ফরম্যাটে। ২৫ টি-টোয়েন্টিতে ২২ গড়ে করেছেন ৫০০ রান। ১৩৫ স্ট্রাইক রেটে এই ফরম্যাটে করেছেন ৩ ফিফটি। ঘরোয়া ক্রিকেটে টি-টোয়েন্টিতে ১০৩ ম্যাচে ২৮ গড়ে ২৫৪৩ রান। ১৪৯ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করেছেন টি-টোয়েন্টিতে!

ইমরান নাজিরের ক্রিকেটীয় প্রতিভা দেখে অনেকেই বলেছিলেন – ‘ঈশ্বরপ্রদত্ত’ । দুর্দান্ত শট, মারমুখী ব্যাটিংয়ের আখ্যা পেয়েছিলেন পাকিস্তান ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ তারকা। কেউ কেউ বীরেন্দ্র শেবাগ, রিকি পন্টিংয়ের সাথেও কোনো অংশে মিলিয়ে ফেলছিলেন।

তবে, যে সম্ভাবনা দেখিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এসেছিলেন তার কিঞ্চিৎ হয়তো দেখাতে পেরেছেন। বাকি সময়টা ঘরোয়া ক্রিকেটের কিংবদন্তি হিসেবেই ক্যারিয়ার শেষ করেছেন। পাকিস্তান ক্রিকেটের এক আক্ষেপের নাম নাজির।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...