মেলবোর্নের সেই নায়কোচিত সন্ধ্যা

কোনো কোনো ম্যাচের গল্প কখনও ফুরোয় না। মাঠের খেলায় জয়-পরাজয় নির্ধারিত হলেও গল্পগুলো রয়ে যায় মানুষের স্মৃতির আঙ্গিনায়। মেলবোর্নের ভারত বনাম পাকিস্তানের ম্যাচ শেষ হয়ে যাবার এক সপ্তাহের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এখনও রেশ কাটেনি। শেষ বলে ছক্কা হাঁকিয়ে ম্যাচ শেষ করা সিনেমার নিয়মিত দৃশ্য হলেও, সেদিনের চিত্রনাট্য চমকে দেবে নামকরা স্ক্রিপ্ট রাইটারকেও। 

পেন্ডুলামের মত দুলতে থাকা ম্যাচের শেষের শুরুটা করেছিলেন বিরাট কোহলি, হারিস রউফকে ছয় মেরে আর অন্তিম সমাপ্তি টেনেছেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন, ম্যাচের শেষ বলে বাঁ-হাতি মোহাম্মদ নওয়াজকে আলতো ভঙ্গিমায় স্কুপ ড্রাইভ করে।  

ম্যাজিক্যাল সব শট, বিতর্কিত নো বল আর ওয়াইড ছাপিয়ে পুরো বিশ্বের দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন ওই চারজন – ভারতের বিরাট কোহলি ও রবিচন্দ্রন অশ্বিন এবং পাকিস্তানের হারিস রউফ ও মোহাম্মদ নওয়াজ। প্রথম দুজন ইতোমধ্যেই নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের জানান দিয়েছনে, বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ না পেলেও কিংবদন্তি তকমা পেয়ে গিয়েছেন। অন্য দুজনের ক্যারিয়ারের অবশ্য কেবলই শুরু, প্রতিভা আছে তবে পাড়ি দিতে হবে বহু পথ। একজন গতিতে পরাস্ত করেন ব্যাটারদের, অন্যদিকে ভোলান বাঁ-হাতি স্পিনের মায়ায়।  

প্রথমেই হারিস রউফের কথাই বলা যাক। এমসিজির ওই ওভারটাতে বল করতে আসার আগে তাঁকে পাড়ি দিতে হয়েছে কঠিন এক পথ। বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির বোলারদের একজন হলেও পাকিস্তানে তাঁকে ভাবা হয় শাহীন আফ্রিদির সহযোগী হিসেবেই। আফ্রিদি এবং রউফ দুজনেই পাঠান, মাঠের বাইরেও তাঁদের বন্ধুত্বের রসায়ন চমৎকার। 

এই দুই পেসারের উঠে আসার গল্পটা আবার পুরোপুরি ভিন্ন। আফ্রিদি একেবারে পাকিস্তানের ক্রিকেট সিস্টেম থেকে উঠে আসা, খেলেছেন বয়সভিত্তিক প্রতিটি দলেই। ১৭ বছর বয়সে জুনিয়র বিশ্বকাপ খেলার সময়েই ভারতের বর্তমান কোচ রাহুল দ্রাবিড় ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন বিশ্ব ক্রিকেটে রাজত্ব করবেন শাহীন। দ্রাবিড় কখনও ভুল বলেন না।

অন্যদিকে ২৩ বছর বয়সী রউফের গল্পটা একদমই আলাদা। পাকিস্তানের টেপ টেনিস টুর্নামেন্টগুলোর নিয়মিত মুখ তিনি, দুর্দান্ত গতির কারণে তাঁকে নিয়ে রীতিমত মারামারি লেগে যায় পাড়ার টুর্নামেন্টগুলোতে। রমজান মাসে রাওয়ালপিন্ডির এই ছেলেটা খ্যাপ খেলে বেড়াতো সারা দেশজুড়ে।

পাকিস্তানের ক্রিকেট সিস্টেম ব্যর্থ হয়েছিল এই হীরে চিনে নিতে। তবে ভুল করেনি পিএসএলের দল লাহোর কালান্দার্স। গুজরানওয়ালায় তাঁদের এক বোলিং হান্টে প্রথমবারের মত নজরে আসেন হারিস। সেই শুরু, গুজরানওয়ালা থেকে সোজা মেলবোর্ন এবং সেখানেই ক্রিকেটের প্রথম পেশাদার পাঠ। 

আফ্রিদি যেখানে সোজা সমতল পথে এগিয়েছেন দ্রুতগতিতে, সেখানে রউফে ঘুরপথে পাড়ি দিতে হয়েছে দুর্গম গিরি কান্তার মরু। তবে ভাগ্যের লিখনে তাঁরা দুজনে এসে মিলেছেন একই বিন্দুতে। তাঁরা বনে গিয়েছেন বোলিং পার্টনার, বিখ্যাত টু ডব্লিউ (ওয়াসিম আকরাম-ওয়াকার ইউনুস) জুটির সাথে ইতোমধ্যেই তুলনা শুরু হয়ে গিয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাফল্য পেতেও দুজনের পথটা ভিন্ন। আফ্রিদি যেখানে শুরুতেই ভারতীয় টপ অর্ডারকে ধসিয়ে দিয়ে পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছেন, সেখানে রউফকে পায়ের নিচে শক্ত মাটি পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে বছরদুয়েক। 

এমসিজিতে সেদিন আফ্রিদির বাজে দিন কেটেছিল, রউফের সামনে সুযোগ ছিল নায়ক হওয়ার। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ জিতিয়ে সারাজীবনের জন্য পাকিস্তান সমর্থকদের নয়নের মণি হতে পারতেন। ১৯তম ওভারের আগে তিনি সেই পথেও ছিলেন ভালভাবে। কিন্তু রউফ সেদিন মুখোমুখি হয়েছিলেন এমন একজনের সাথে, যিনি কিনা তাসের দান উল্টে দিতে জানেন মূহুর্তের মাঝে। 

কোহলির আর টি-টোয়েন্টির মাঝে খানিকটা দুরত্ব তো আছেই। অন্তত গত বছর দুয়েক ধরেই এই ফরম্যাটে তাঁর সাফল্য সেটাই বলে। বিগ হিটিংয়ে বড় সব ছক্কা হাঁকানোর চাইতে বরং নিখাদ টাইমিং আর ক্রিকেটীয় শটে বাউন্ডারি হাঁকাতেই তাঁর আগ্রহ। কোহলি টি- টোয়েন্টিতে কিংবদন্তি হয়েছেন নিজের আপন মহিমায় ক্রিকেট খেলেই। অজি ক্রিকেট কলামিস্ট গেডিয়ান হাইয়ের ভাষায়, ‘ব্যবসায়ীরা যতবার ক্রিকেটকে টি- টোয়েন্টি থেকে বের করে দিতে চান, কোহলি ততবারই সেটা ফিরিয়ে আনেন।’  

অথচ টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শুরুর আগে কোহলিকে নিয়ে কত কথাই না ভেসে বেড়াচ্ছিল। অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিয়েছেন, মানসিক অবসাদে ভুগছেন এমনকি দলে তাঁর জায়গা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন অনেকে। পাকিস্তানের বিপক্ষে ব্যর্থ হলে সেটা হত কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেবার মতো।  

মোড় ঘুরিয়ে দেবার সেই মূহুর্তে দিনের সেরা বোলার রউফের বিপক্ষেই যেন নিজের স্বরূপে ফিরে গেলেন কোহলি। হুক কিংবা স্কুপ নয়, প্রিয় কাউ কর্নার দিয়ে এলোপাথাড়ি ব্যাট চালানো নয়। কোহলির ছক্কাদুটো যেন নিখাদ শিল্পকর্ম, খানিকটা তুলির আঁচড় আর শিল্পীর অহংবোধের মিশ্রণ তাতে। নিখাদ ক্রিকেটীয় শট আর নিজের কব্জির উপর অগাধ বিশ্বাস যেন লিখে দিয়েছিল সেদিনের ম্যাচের ফল। পাড়ার ক্রিকেটের শেষ ওভার কিংবা বিশ্বজুড়ে টি -টোয়েন্টি লিগ খেলে ডেথ ওভারে বোলিংটা ভালোই রপ্ত করেছিলেন রউফ, কিন্তু সেদিন সবই যেন হার মেনেছিল কোহলির সামনে। 

কোহলির শটের পরও ম্যাচ হেরে যেতে পারতো ভারত যদি শেষ ওভারে মোহাম্মদ নওয়াজ মাথা ঠান্ডা রাখতে পারতেন। এমনিতে এই বাঁ-হাতি অলরাউন্ডার বেশ শান্তশিষ্ট মানুষ। পেসার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করলেও পরবর্তীতে কোচের পরামর্শ বনে যান বাঁ-হাতি স্পিনার। পাকিস্তানের ক্রিকেটে অবশ্য এটাকে পশ্চাৎগমণ হিসেবেই দেখা হয়।  

কিন্তু নওয়াজ থামেননি, তিনি লড়াইটা চালিয়ে গিয়েছেন একাকী, নীরবে-নিভৃতে। অনূর্ধব -১৯ দলে থাকাকালীন দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যাওয়ার সময়ে প্লেনেই পরিচয় সমমনা এক তরুণীর সাথে যিনি কিনা ফিরছিলেন কেপ টাউনে নিজের শহরে। এরপরই বদলে গেল নওয়াজের জীবন, ছুটিটাকে ভাগ করে নিয়ে অর্ধেক কাটতে লাগলো দুই মহাদেশের দুই প্রান্তে। সেদিনের তরুণী আজ তাঁর সহধর্মিণী, প্রতিটি ম্যাচে স্টেডিয়ামে কিংবা টিভির সামনে বসে সাহস জুগিয়ে যান নওয়াজকে। এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে জয়ের নায়ক হলেও মেলবোর্নে আর পেরে উঠেননি। তাঁর সামনে সুযোগ ছিল আরও একবার ভারত বধের নায়ক হবার। 

পেরে ওঠেননি বললে ভুল হবে, বরং বলা ভাল তাঁকে নায়ক হতে দেননি ক্রিকেটার পরিচয় বদলে “চিন্তাশীল ক্রিকেটার” হয়ে ওঠা রবিচন্দ্রন অশ্বিন। আইপিএলে জস বাটলারকে মানকাড কিংবা টানা ক্যারম বল করে মার খেলে অনেকেই তাঁকে টিটকারি মেরেছেন মাত্রাতিরিক্ত স্মার্ট সম্বোধন করে। 

অশ্বিন পুরো বিশ্বকে ভুল প্রমাণ করেছেন। তাঁকে এক বলে এক রান করতে হত আর ফিল্ডাররাও সবাই ছিলেন সার্কেলের ভেতরে। এমন পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ ক্রিকেটারই বড় শট খেলতে চান, উড়িয়ে মারতে যান অফসাইডের ফিল্ডারের মাথার উপর দিয়ে। অনেকে আবার স্লগ করতে যান মিড উইকেটের উপর দিয়ে। এমন মূহুর্তে পায়ের সামনে বল করাটাই সবচেয়ে নিরাপদ অপশন স্পিনারদের জন্য।

নওয়াজ সেটা জানতেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে অশ্বিনেরও সেটা অজানা ছিল না। লেগস্ট্যাম্পের দিকে সরে গিয়ে নওয়াজকে দিয়ে ওয়াইড আদায় করে নিলেন। টানা দুই ওভারে দুই ভারতীয় ব্যাটার পাকিস্তানি বোলারের মন পড়ে নিলেন। সাবেক পাকিস্তানি ক্রিকেটার রশিদ লতিফের ভাষায় প্রকৌশলির মত মস্তিষ্কটাকে ব্যবহার করলেন।

আগামী দিনগুলোতে ভারতের শিশুরা হয়তো কোহলির সেই শট কিংবা অশ্বিনের মত বল ছেড়ে দিয়ে ওয়াইড আদায় করে নেয়াটা অনুকরন করতে চাইবেন। পাকিস্তানে হয়তো কোচরা পরামর্শ দেবেন রউফ-নওয়াজদের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে। আগামী দিনগুলোতে হয়তো রূপকথার গল্পের মত মানুষের মুখে মুখে ঘুরে ফিরবে সেদিনের সেই সন্ধ্যার গল্প। কোনো পডকাস্ট, ধারাভাষ্য, টকশো কিংবা পুরনো বন্ধুদের আড্ডায় ফিরে আসবেন সেদিনের নায়কেরা।

 জাভেদ মিয়াদাদ-চেতন শর্মা, শচীন টেন্ডুলকার-শোয়েব আকতারদের লড়াইয়ের পাশাপাশি মেলবোর্নের কথাও উঠবে যেদিন কোহলি খেলেছিলেন কিংবদন্তির মত আর অশ্বিন মস্তিষ্কটাকে ব্যবহার করেছিলেন প্রকৌশলীর মত। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link