পার্থের সেই ম্যাচটার আগে কখনোই অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে মুখোমুখি হওয়া হয়নি ভারত ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের। লো-স্কোরিং ম্যাচটার শেষটা যে এত উত্তেজনাপূর্ণ হতে যাচ্ছে – সেটা কেই বা ভেবেছিল। রবি শাস্ত্রী নিজেও ভাবেননি তার ১১০ বলে করা ৩৩ রানের ইনিংসটাই ম্যাচের সর্বোচ্চ স্কোর হয়ে থাকবে।
সেটা ছিল ১৯৯১ সালের বেনসন অ্যান্ড হেইজেস ওয়ার্ল্ড সিরিজের উদ্বোধনী ম্যাচ। প্রথম ম্যাচেই আবার মুখোমুখি সাবেক দুই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। পার্থের ওয়াকাতে প্রথম ম্যাচেই রোমাঞ্চের রঙে রাঙিয়ে দিয়েছিল এই দুই দল।
ওয়াকার গতিময় বাউন্সি উইকেট সেদিন বোলারদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছিল। যদিও এই উইকেট এখনও পেস বোলিং বান্ধব তবে সেদিন রীতিমতো আগুন ঝরিয়েছিলেন পেসাররা। রিচি রিচার্ডসনের উইন্ডিজ একাদশের পেসারদের নামগুলো লক্ষ করুন ম্যালকম মার্শাল, প্যাট্রিক প্যাটারসন, কার্টলি অ্যামব্রোস, অ্যান্ডারসন কামিন্স।
সময়টা ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের পড়ন্ত বেলা হলেও এই নামগুলো ব্যাটসম্যানদের শিরদাঁড়ায় তখনও ভয়ের শীতল স্রোত বইয়ে দিত। আর আজহারউদ্দীনের দলে পেস আক্রমণে নেতৃত্বে অভিজ্ঞ কপিল দেবের সাথে অভিষিক্ত সুব্রত ব্যানার্জি, মনোজ প্রভাকর আর জাভাগাল শ্রীনাথ।
টসে জিতে ক্যারিবীয় অধিনায়ক রিচি রিচার্ডসন ভারতকে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানান। অধিনায়কের সিদ্ধান্ত সঠিক প্রমাণে কালক্ষেপণ করলেন না প্যাট্রিক প্যাটারসন। দলীয় ৮ রানেই প্যাটারসনের বলে থার্ড স্লিপে কার্ল হুপারের হাতে ধরা পরলেন ওপেনার কৃষ্ণমাচারী শ্রীকান্ত। তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে উইকেটে আসলেন সঞ্জয় মাঞ্জরেকার। ক্যারিবিয়ান পেস ব্যাটারির সামনে মাঞ্জরেকারও বেশিক্ষণ টিকতে পারলেন না।
ব্যক্তিগত ১৫ রান করে কামিনসের বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিলেন। দলীয় স্কোর তখন দুই উইকেটে ৩৫। উইকেটে থিতু হতে পারলেন না শচীন টেন্ডুলকারও। খানিকবাদেই অ্যামব্রোসের শিকার অধিনায়ক আজহারউদ্দীন। অ্যামব্রোস-কামিন্সদের দাপটের মাঝেও মাটি কামড়ে তখনও উইকেটে পরে আছে ওপেনার রবি শাস্ত্রী। প্রবীন আমরেকে নিয়ে ইনিংস মেরামতের চেষ্টায় শাস্ত্রী।
তবে খুব বেশি এগোতে পারলেন না। ড্রাইভ করতে গিয়ে টাইমিংয়ের হেরফের কাভার ড্রাইভ করতে গিয়ে লারার হাতে ধরা পরলেন। নামের পাশে তখন ১১০ বলে ৩৩ রান বলে দিচ্ছে উইকেটে কতটা সংগ্রাম করে টিকে ছিলেন এতক্ষণ। ৩৩ রানের ইনিংসে শাস্ত্রীর ব্যাট থেকে আসে দুটি চার। ভারতের ২৮৪ বলের ইনিংসে আর কারো ব্যাট থেকে চারের মার আসেনি।
এই তথ্যগুলো প্রমাণ করে কতটা আধিপত্য বিস্তার করছিলেন প্রতিপক্ষ বোলাররা। লোয়ার মিডল অর্ডারে মনোজ প্রভাকর আর প্রবীন আমরের ২৩ রানের গুরুত্বপূর্ণ জুটিতে একশ পার করে ভারত। এরপর চোখের পলকে শেষ তিন উইকেট হারিয়ে ১২৬ রানে অল আউট ভারত। শেষ তিন উইকেটের তিনটিই ছিল রান আউট।
১২৭ রানের টার্গেটে খেলতে নেমেই শুতেই খেই হারায় উইন্ডিজ। রানের খাতা খোলার আগেই কপিল দেবের বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন অভিজ্ঞ ডেসমন্ড হেইন্স। এরপর ভারতীয় বোলারদের সামনে তাসের ঘরের মত ভেঙে পরে ক্যারিবীয়দের ব্যাটিং লাইন আপ। দলীয় ৭৬ রানেই নেই ৮ ব্যাটসম্যান।
এরপর অ্যামব্রোস আর কামিন্সের দৃঢ়তায় আবারো ম্যাচে ফিরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ৭৬ থেকে ১১২ জয় থেকে তখনও ১৫ রান দূরে হাতে দুই উইকেট। ১১৩ রানের মাথায় রান আউটে কাটা পরে অ্যামব্রোস। অর্থাৎ শেষ উইকেটে জিততে দরকার ১৪ রান । প্যাটারসনকে নিয়ে কামিন্স এগোচ্ছিলেন সামনের দিকেই।
নাটকের শেষ দৃশ্য তখনও বাকি।
৪০ ওভারের খেলা শেষ। ভারতের চারজন বোলারই ১০ ওভারের কোটা পূর্ণ করেছেন ইতোমধ্যে।
৪১ তম ওভার করবেন কে? ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়ের জন্য দরকার ৬ রান। ম্যাচ জিততে ভারতের দরকার এক উইকেট। অধিনায়ক আজহার চাইলে সহজ পথে হেঁটে ভরসা রাখতে পারতেন শাস্ত্রীর ওপর। কিন্তু তিনি ছোট্ট একটা জুয়া খেললেন। ভরসা রাখলেন তরুণ শচীন টেন্ডুলকারের ওপর।
অধিনায়কের আস্থার প্রতিদানও দিলেন শচীন। ওভারের চার বলে দিলেন দুই রান৷ পঞ্চম বলে প্যাটারসন হুক করে ডিপ মিড উইকেটে বল পাঠিয়ে তিন বারের জন্য জায়গা পরবর্তন করেন। স্কোর লেভেল।
ওভারের শেষ বলটি করলেন অফ স্টাম্পের ঠিক বাইরে। কামিন্সের ব্যাটের কানায় লেগে এজ হয়ে বল সরাসরি স্লিপে দাঁড়ানো আজহারউদ্দীনে হাতে। শ্বাসরুদ্ধকর এক ম্যাচের পরিসমাপ্তি ঘটল অমীমাংসিত ভাবে। অর্থাৎ ম্যাচ টাই।
ওয়ানডের ইতিহাস ততদিনে খুব বেশি টাই ম্যাচ দেখেনি। সেই ম্যাচের আগে টাই ছিল মাত্র তিনটি। চতুর্থটির সাক্ষী হয়ে রইলো ওয়াকা।