স্বপ্নে হারিয়ে যাই পরীর দেশে

এরপর কি হয়? মুম্বাই বিমানবন্দর থেকে খেলোয়াড়দের নিয়ে যাওয়া হয় ব্যাবোর্ন স্টেডিয়ামে। স্টেডিয়ামের উপচে পড়া জনতা সংবর্ধনা দেয় ভারতীয় দলকে। চন্দ্রশেখর একবার বলেছিলেন, ‘সেদিনের সেই উল্লাসধ্বনি আজও আবার কানে বাজে!’

সেটা সাদাকালো যুগ। সেই ম্যাচের একটাও রঙিন ছবি খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ, সেটা ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে রঙিন দিনগুলোর একটা। পরীর দেশে সেদিন স্বপ্ন এসে ধরা দিয়েছিল। আর তাতে হারিয়ে একাকার হয়েছিল ভারতীয় দল।

কাট টু ১৯৩১। ষষ্ঠ দল হিসেবে ১৯৩১ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস পায় ভারত। স্ট্যাটাস পাবার দুই দশক পরে মাদ্রাজে ইংরেজদের বধ করে প্রথম জয়ের দেখা পায় বিজয় হাজারের দল। কিন্তু কিছুতেই ইংরেজ মূলুকে গিয়ে জয়ের দেখা পাচ্ছিলো না তারা। অবশেষে প্রায় চার দশক বাদে ওভাল টেস্টে দুই স্পিনার শ্রীনিবাস ভেঙ্কটরাঘবন এবং ভগবত চন্দ্রশেখরের ঘূর্ণিতে পরম আকাক্ষিত জয় পায় ভারতীয়রা।

১৯৭১ সালে মনসুর আলী খান পতৌদি অবসর নিলে ভারত জাতীয় দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পান অজিত ওয়াদেকার। ভারত দলে তখন তরুণ তুর্কিদের জয় জয়কার। সুনীল গাভাস্কার, ফারুক ইঞ্জিনিয়ার, গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ এবং বিখ্যাত ‘স্পিন কোয়াট্রেট’ বিষাণ সিং বেদি, এরাপল্লি প্রসন্ন, ভেঙ্কটরাঘবন, ভগবৎ চন্দ্রশেখররা তখন কেবলমাত্র ক্যারিয়ার শুরু করছেন।

এই তরুণদের যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে নিজের প্রথম সিরিজের স্যার গ্যারি সোবার্সের ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজ জেতান ওয়াদেকার। ক্যারিবীয়দের বধ করে পা রাখেন ইংরেজ মূলুকে। ভারতের কাছে নিজেদের মাটিতে তখনো অপরাজেয় ইংরেজরা। প্রথম দুই টেস্ট ড্র হওয়ায় ওভালে তৃতীয় এবং শেষ টেস্ট হয়ে দাঁড়ায় সিরিজ নির্ধারণী।

টস জিতে প্রথমে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন ইংরেজ অধিনায়ক রে ইলিংওর্থ। ব্যাটিংয়ে নেমে মাঝপথে খেই হারালেও জন জেমসনের ৮২, অ্যালান নটের ৯০ এবং রিচার্ড হাটনের ৮১ রানে ভর করে ৩৫৫ রানের দারুণ সংগ্রহ পায় ইংল্যান্ড। একনাথ সোলকার নেন তিন উইকেট। বেদি, ভেঙ্কটরাঘবন, চন্দ্রশেখর পান দুটি করে উইকেট। কিন্তু ম্যাচের দ্বিতীয় দিন ভেসে যায় বৃষ্টিতে।

তৃতীয় দিনে দিলীপ সারদেশাই এবং ফারুক ইঞ্জিনিয়ারের জোড়া ফিফটিতে ম্যাচে ভালোভাবেই টিকে ছিল ভারত। কিন্তু খেলা শেষের  মিনিট দশেক আগে ইঞ্জিনিয়ার আউট হয়ে গেলে ম্যাচে পরিষ্কারভাবে এগিয়ে যায় ইংল্যান্ড। পরের দিন শুরুতেই ভারত অলআউট হয়ে যায় ২৮৪ রানে। অধিনায়ক ইলিংওর্থ পান পাঁচ উইকেট এং ইংল্যান্ড পায় ৭১ রানের লিড।

ম্যাচে তখনো পরিষ্কার এগিয়ে ইংল্যান্ড। কিন্তু অন্যরকম ভেবে রেখেছিলেন একজন। কে ভেবেছিল চন্দ্রশেখরের ছোটবেলায় পোলিও আক্রান্ত হাত সেদিন হয়ে উঠবে মারণাস্ত্র। তার হাত থেকে বেরোনো গুগলি কিংবা ফ্লিপারের কোনো জবাব ছিল না সেদিন ইংরেজ ব্যাটসম্যানদের কাছে।

ইংরেজ ব্যাটসম্যানরা সেদিন দাঁড়াতেই পারেনি তার সামনে, লাকহার্স্টের ৩৩ রানে ভর করে ইংরেজদের ইনিংসের সমাপ্তু ঘটে মাত্র ৪৫ ওভারেই, ১০১ রান করে। চন্দ্রশেখর একাই নেন ছয় উইকেট। সেদিন মাঠে যেন অতিমানবীয় হয়ে উঠেছিলেন তিনি, কেবল বল হাতে নয়। দারুণ এক থ্রোতে রান আউট করেছিলেন প্রথম ইনিংসে দারুণ ব্যাট করা জন জেমসনকে। শেষদিনে ভারতের সামনে লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় ১৭৩ রানের।

ওভালের পিচে শেষ দিনে দেড়শো পেরোনো সহজ কথা নয়। তার উপর আগের দিন চন্দ্রশেখরের বল টার্ন করা দেখে চীখ চকচক করে উঠছে ডেরেক আন্ডারউডের। এধরনের পিচে পঞ্চম দিনে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠার রেকর্ড আছে তার। সেদিন সেটাই হচ্ছিল, সুনিল গাভাস্কারকে রানের খাতা খোলার আগেই ফেরত পাঠান জন স্নো।

কিন্তু, শেষরক্ষা হয়নি তাদের, ভারতীয় অধিনায়ক ওয়াদেকার এবং সারদেশাইয়ের চল্লিশোর্ধ ইনিংসের পাশাপাশি বিশ্বনাথ এবং ফারুক ইঞ্জিনিয়ারের ত্রিশোর্ধ ইনিংসে ভর করে চার উইকেটে জয় পায় সফরকারীরা। তিন উইকেট নিয়েও দলকে বাঁচাতে পারেননি ডেরেক আন্ডারউড। ম্যাচের পাশাপাশি ১-০ ব্যবধানে সিরিজও জিতে নেয় তারা। অবশেষে চার দশকের অপেক্ষার প্রহর শেষে ইংরেজ মুলুকে উড়ে ভারতীয় পতাকা।

কয়েকদিন আগে মোহাম্মদ শামি, জাসপ্রিত বুমরাহ, মোহাম্মদ সিরাজদের দাপটে লর্ডসে ইংল্যান্ডকে বিধ্বস্ত করেছে বিরাট কোহলির নতুন দিনের ভারত। কোহলিদের জয়ের পেছনের বীজটা অর্ধশতাব্দী আগে বুনেছিলেন ওয়াদেকার, ফারুক ইঞ্জিনিয়ার, চন্দ্রশেখররাই।

এরপর কি হয়? মুম্বাই বিমানবন্দর থেকে খেলোয়াড়দের নিয়ে যাওয়া হয় ব্যাবোর্ন স্টেডিয়ামে। স্টেডিয়ামের উপচে পড়া জনতা সংবর্ধনা দেয় ভারতীয় দলকে। চন্দ্রশেখর একবার বলেছিলেন, ‘সেদিনের সেই উল্লাসধ্বনি আজও আবার কানে বাজে!’

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...