টি-টোয়েন্টির ইতিহাসে প্রথম সেঞ্চুরিটা তিনিই পেয়ে যেতে পারতেন। এতটাই দানবীয় ছিল তাঁর ব্যাট। আবার সেই তিনিই আবার অতি-মন্থর ইনিংস খেলে এশিয়া কাপ ফাইনালে বাংলাদেশের পরাজয়ের কারণ বনে গিয়েছিলেন। এই দ্বৈত চরিত্রের নাম নাজিমউদ্দিন।
এক সময় বাংলাদেশের ক্রিকেট মানেই চট্টগ্রাম। একের পর এক প্রতিভা উঠে আসত বন্দরনগরী থেকে। সেই ধারাবাহিকতারই আরেক নাম ছিলেন নাজিমউদ্দিন। ব্যাট হাতে যার ছিল অফুরন্ত প্রতিভা, অথচ মাথার ভেতরে বাসা বেঁধেছিল অদ্ভুত কিছু ভয়—যেগুলো শেষ পর্যন্ত গিলে খেয়েছে এক সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার।
মরনে মরকেলের নাম শুনলেই নাকি বুক ধড়ফড় করত! অস্ট্রেলিয়ান পেসারদের খেলতে নামার আগেই মনে ভয় ঢুকে যেত। এমনকি এক সাক্ষাৎকারে নিজেই স্বীকার করেছিলেন—টিভিতে নিজের খেলা দেখালেও তিনি নার্ভাস হয়ে পড়তেন। পেস বোলারদের মুখোমুখি হওয়া মানেই ছিল অজানা আতঙ্ক। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এমন ‘বিচিত্র’ সমস্যা খুব কমই দেখা যায়।

অথচ এই নাজিমউদ্দিনই এক সময় ছিলেন টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের, এমনকি বিশ্বেরও সর্বোচ্চ রানের ইনিংসের মালিক। পাকিস্তানের মোহাম্মদ আসিফ আর শোয়েব আখতারকে পিটিয়ে ৮১ রানের সেই ঝড়ো ইনিংস আজও স্মৃতিতে অম্লান। সে সময় টি-টোয়েন্টিতে কোনো ওপেনারের এত বড় ইনিংস আর কেউ খেলেনি। নয় দিনের ব্যবধানে ক্রিস গেইল সেঞ্চুরি করে রেকর্ড ভাঙলেও, নাজিমউদ্দিনের নাম তখন ক্রিকেট দুনিয়ায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
মাত্র ১৬ বছর বয়সেই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক। এরপর অনূর্ধ্ব-১৯, বাংলাদেশ ‘এ’ দল—সব পথই খুলে গিয়েছিল তার জন্য। ২০০৭ সালে কেনিয়ার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি অভিষেক, একই বছর দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের দলে জায়গা—সব মিলিয়ে ভবিষ্যৎটা ছিল ঝকঝকে।
কিন্তু সেই আলো ধীরে ধীরে ফিকে হতে শুরু করে। ২০০৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক হলেও নিজেকে আর মেলে ধরতে পারেননি। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজে ডাক পেলেও চোটে খেলাই হয়নি। হয়তো সেটাই তার জন্য স্বস্তির ছিল—কারণ অস্ট্রেলিয়ান পেসারদের ভয় যে তখনও কাটেনি।

এরপর এল নিষিদ্ধ ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগ (আইসিএল)। সেখানে খেলতে গিয়ে যেন নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারলেন নাজিমউদ্দিন। দশ বছরের নিষেধাজ্ঞা নেমে এল তার ক্যারিয়ারে। যদিও ২০০৯ সালে আইসিএল ছেড়ে ফিরে এসে বিসিবির সহানুভূতিতে নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়, ততদিনে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে।
২০১১ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট দলে ডাক পেয়ে আবার আলো দেখেছিলেন তিনি। চট্টগ্রামে টেস্ট অভিষেক, ওপেনিং ব্যাটসম্যান হিসেবেই। কিন্তু জাতীয় দলের জার্সিতে নিজের প্রতিভার সামান্য ঝলকও আর দেখাতে পারেননি। তিনটি টেস্টে ১২৫ রান, গড় ২১। ওয়ানডেতে ১১ ম্যাচে ১৪৭ রান, টি-টোয়েন্টিতে ৭ ম্যাচে ১৪৭ রান—সব মিলিয়ে পরিসংখ্যান বড়ই নিষ্প্রাণ।
ক্যারিয়ারের শেষটা যেন আরও বেদনাদায়ক। ২০১২ এশিয়া কাপের ফাইনাল। ৫২ বলে মাত্র ১৬ রান। বাংলাদেশ হারে মাত্র দুই রানে। তিনি আর একটু দ্রুত খেললে হয়তো ইতিহাসটাই বদলে যেত। কিন্তু ‘হয়তো’ শব্দটা নিয়েই তো নাজিমউদ্দিনের ক্যারিয়ার।

অথচ ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি ছিলেন একেবারেই অন্য মানুষ। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১০৪ ম্যাচে ৬২৬৯ রান, ১২টি শতক, ৩৬টি অর্ধশতক, সর্বোচ্চ ২০৫। লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটেও ছিল ধারাবাহিকতা। প্রমাণ ছিল—প্রতিভার কোনো ঘাটতি তার ছিল না।
২০১৯ সালে ঘরোয়া ক্রিকেটকে বিদায় জানান নাজিমউদ্দিন। জাতীয় দলে নিজের নামটা ঠিকভাবে লিখে যেতে না পারার আক্ষেপটা হয়তো আজও তাড়া করে ফেরে। সাবেকদের ক্রিকেটে ঝড় তুলে যেন আন্তর্জাতিক মঞ্চের আক্ষেপটাই বাড়ান। সব মিলিয়ে অসীম প্রতিভা, সীমাহীন ভয় আর অপূর্ণ থেকে যাওয়া এক স্বপ্নের নাম নাজিমউদ্দিন।










