ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) পঞ্চদশ আসরে চলছে প্লে অফের লড়াই। প্রথমবারের মত দশ দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় আইপিএলের এবারের আসর। তাই সব দলের জন্যই প্লে অফে যাওয়ার লড়াইটা ছিল আগের চেয়ে বেশ কঠিন। দশ দলের অধিনায়কদের অনেকেই ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স দিয়ে দলকে নিয়ে গেছেন প্লে অফে। অনেকেই দল ও ব্যক্তিগত হতশ্রী পারফরম্যান্সে দেখিয়েছেন লজ্জাজনক পারফরম্যান্স।
তবে রোহিত শর্মা, মহেন্দ্র সিং ধোনি, শ্রেয়াস আইয়ারদের ছাপিয়ে এবারের আসরে অধিনায়ক হিসেবে বিশেষ নজর কেড়েছেন হার্দিক পান্ডিয়া। প্রথমবারের মত অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েই দলকে নিয়ে গেছেন ফাইনালে। ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সও ছিল দুর্দান্ত।
আইপিএলের এবারের আসরে দশ দলের অধিনায়কের ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স কেমন ছিল সেটা দেখা যাক –
- হার্দিক পান্ডিয়া (গুজরাট টাইটান্স)
গেল বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের ভরাডুবিতে বেশ সমালোচিত ছিলেন হার্দিক পান্ডিয়া। ইনজুরি আর ফর্মহীনতার কারণে নিজের সেরাটা দিতে পারেননি এই তারকা। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) এবারের আসরটা তাই হার্দিকের জন্য ছিল প্রত্যাবর্তনের বড় এক মঞ্চ। নির্বাচক থেকে শুরু করে সমর্থকদের বিশেষ নজরটাও এই অলরাউন্ডারের উপর।
অধিনায়ক হিসেবে এবার নতুন এক দায়িত্ব। তাই প্রত্যাবর্তনের জন্য পরীক্ষা দেওয়ার মঞ্চে হার্দিকের জন্য এবার চাপটা একটু বেশি। নতুন দল, নতুন অধিনায়ক। হার্দিক কেমন করবেন? নিজের সেরাটা দিতে পারবেন কিনা সে নিয়েও ছিল অনেক প্রশ্ন। তবে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে সব প্রশ্নের জবাব যেন দিয়ে ফেলেছেন এই অলরাউন্ডার। অধিনায়ক পান্ডিয়া এবার প্রথম দল হিসেবে গুজরাটকে টেনে নিয়েছেন ফাইনালের মঞ্চে। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং আর অধিনায়কত্ব – হার্দিক পান্ডিয়ার প্রত্যাবর্তনের রূপটা এর চেয়ে আর দাপুটে হতে পারে কি?! সন্দেহ ছাড়াই এবারের আসরের অন্যতম সেরা তিনি।
১৪ ম্যাচে ৪৫ গড়ে ১৩২ স্ট্রাইক রেটে ৪৫৩ রান করেন হার্দিক; আছে চার ফিফটি।
- রোহিত শর্মা (মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স)
অধিনায়ক হিসেবে প্রথমবারের মত টুর্নামেন্টের প্রথম সাত ম্যাচেই হেরেছেন রোহিত। ব্যাট নিজের পারফরম্যান্সটাও উল্লেখযোগ্য নয়। ট্রল আর সমালোচনার বৃত্তে ঘুরপাক খেয়েছেন রোহিত। জাতীয় দলে তিন ফরম্যাটেই অধিনায়কের দায়িত্ব। মেগা নিলামে দলে পরিবর্তন, নিজের অফ ফর্ম – সব মিলিয়ে যেন এবার আরও ব্যাকফুটে ছিলেন রোহিত।
অধিনায়কত্বের চাপটা যেন গ্রাস করে ফেলেছে ভারতের এই ওপেনারকে। পাঁচবারের শিরোপাজয়ী মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স এবারের আসরে পয়েন্টস টেবিলের একদম তলানীতে থেকে টুর্নামেন্ট শেষ করেছে। ব্যাট হাতে দু:স্বপ্নের মত এক মৌসুম কাটিয়েছেন অধিনায়ক রোহিত শর্মা।
১৪ ম্যাচে মাত্র ১৯ গড়ে করেছেন ২৬৮ রান, নেই কোনো ফিফটি। রোহিতের বাজে ফর্ম প্রভাব পড়েছে দলের উপরেও। এবারের আসরে মাত্র চার জয় পেয়েছে মুম্বাই।
- মায়াঙ্ক আগারওয়াল (পাঞ্জাব কিংস)
লোকেশ রাহুল লখনৌতে যোগ দেওয়ায় পাঞ্জাব কিংসের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পান মায়াঙ্ক আগারওয়াল। তবে সেই দায়িত্বের বোঝা তিনি বইতে পারেননি। অধিনায়ক ট্যাগের চাপেই যেন ঝিমিয়ে পড়েছেন এই ওপেনার।
গেল আসর গুলোতে ব্যাট হাতে ছিলেন উড়ন্ত ফর্মে। অধিনায়ক হিসেবে এবারের আসরে প্রথমবার দায়িত্ব পেয়েছেন। আর এতেই যেন আগারওয়ালের শনির দশা। বলতে গেলে অধিনায়ক কোটাতেই খেলে যাচ্ছেনে এই ওপেনার। আসরে এক ফিফটির দেখা পেলেও বাকি ম্যাচগুলোতে ছিল হতশ্রী পারফরম্যান্স।
১৩ ম্যাচে ১৬ গড়ে করেছেন ১৯৬ রান; ফিফটি আছে একটি। ১৪ ম্যাচে সাত জয় আসরে পাঞ্জাব কিংসের অবস্থান ছয়ে।
- ফাফ ডু প্লেসিস (রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরু)
প্রথমবারের মতো ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) অধিনায়কের দায়িত্ব। জাতীয় দলে লম্বা সময় অধিনায়কত্ব করলেও আইপিএল ইতিহাসে এবারই প্রথম। তাও যে দলটার দায়িত্ব গেল ১৪ আসর ধরে ছিলো সাবেক ভারতীয় অধিনায়ক বিরাট কোহলির কাঁধে!
এর আগের চার আসরে খেলেছিলেন চারবারের আইপিএল শিরোপাজয়ী দল চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে। চলতি বছর ১৫ তম আসরের মেগা অকশনে সাত কোটি রুপিতে তাঁকে দলে ভেড়ায় রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরু। আর ব্যাঙ্গালুরুর হয়ে সুযোগ পেয়ে প্রথম আসরে প্রথমবার অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে দলকে নিয়ে গেছেন প্লে অফে।
গ্রুপ পর্বের ১৪ ম্যাচে ৩৪ গড়ে করেছেন ৪৪৩ রান, আছে তিন ফিফটি।
- কেন উইলিয়ামসন (সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদ)
পঞ্চদশ আসরে দলের সাথে সাথে ব্যাট হাতে পুরোপুরি ব্যর্থ সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন। প্রথম বারো ম্যাচে তিনি খেলেছেন ওপেনিংয়ে। কিন্তু এক ফিফটি বাদে আর কোনো ম্যাচেই প্রতিপক্ষের সামনে দাঁড়াতে পারেননি তিনি। প্রতি ম্যাচেই শুরুতেই আউট হয়ে ব্যর্থতার বোঝা ভারী করেছেন। গুজরাট টাইটান্সের বিপক্ষে ৪৬ বলে ৫৭ আর চেন্নাই সুপার কিংসের বিপক্ষে ৩৭ বলে ৪৭ রান ছাড়া বাকি দশ ম্যাচে করেছেন মাত্র ১০৪ রান।
ব্যাট হাতে রানের দেখা নেই, ডট বল দিয়ে দলের উপরও চাপ বাড়িয়েছেন। আইপিএল ইতিহাসে এক মৌসুমে কমপক্ষে ২০০ বল খেলা ওপেনারদের মধ্যে উইলিয়ামসনের ব্যাটিং স্ট্রাইক রেট সবচেয়ে কম! চলতি আসরে ২১৬ রান করতে উইলিয়ামসন বল খেলেছেন ২৩০টি! একশোর নিচে স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করেছেন তিনি।
১৩ ম্যাচে মাত্র ১৯ গড়ে করেছেন ২১৬ রান। স্ট্রাইক রেট ৯৩.৫১, ফিফটি এক। ১৪ ম্যাচে ৬ জয়ে দলের অবস্থান আটে।
- মহেন্দ্র সিং ধোনি (চেন্নাই সুপার কিংস)
পয়েন্ট টেবিলের নয়ে থেকে এবারের আসর শেষ করেছে চেন্নাই সুপার কিংস। দলের ব্যর্থতার মাঝেও ব্যাট হাতে খানিকটা উজ্জ্বল ছিলেন অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি। গেল দুই আসরে ব্যর্থ হলেও এবারের আসরে ধোনির ব্যাটে এবার রানের দেখা মিলেছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চারবার শিরোপা জয় করা দলটা বাদ পড়েছে গ্রুপ পর্বেই।
দল ভাল না করলেও ধোনির পারফরম্যান্স খারাপ বলার সুযোগ নেই। ১৩ ম্যাচে ৩৪.৩৩ গড়ে করেছেন ২০৬ রান, আছে এক ফিফটি। বয়স আর গেল দুই আসর বিবেচনায় নিলে এবার ব্যাট হাতে বেশ ভালই করেছেন এই ভারতীয় তারকা।
- লোকেশ রাহুল (লখনৌ সুপার জায়েন্টস)
এখন পর্যন্ত আসরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সফল দল লখনৌ সুপার জায়েন্টস। অধিনায়ক হিসেবে এই নতুন দলের দায়িত্বে আছেন লোকেশ রাহুল। বেশ কয়েক আসর ধরেই ব্যাট হাতে ধারাবাহিক রাহুল। আইপিএলে গেল কয়েক আসরের সবচেয়ে ধারাবাহিক ব্যাটার তিনি। গেল চার আসরেই গড়ে প্রায় ছয়শোর বেশি রান করেছেন এই তারকা। স্ট্রাইক রেট নিয়ে খানিকটা সমালোচনা হলেও এবারের আসরে সেটিও আকাশচুম্বি।
ধারাবাহিকতার সাগরে ভেলা ভাসিয়ে তিনি দিব্যি ছুঁটে চলেছেন। গুজরাট টাইটান্সের পর দ্বিতীয় দল হিসেবে প্লে অফে পা দেয় লখনৌ।
১৪ ম্যাচে প্রায় ৪৯ গড়ে ৫৩৭ রান করেছেন রাহুল। আছে ২ সেঞ্চুরি ও ৩ ফিফটি। আসরে এখন পর্যন্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তিনি।
- শ্রেয়াস আইয়ার (কলকাতা নাইট রাইডার্স)
দিল্লী ক্যাপিটালস থেকে পঞ্চদশ আসরে সুযোগ পেয়েছেন কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে খেলার। অধিনায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পান তিনি। তবে সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন আইয়ার। ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সে ব্যাট হাতে অনেকটাই উজ্জ্বল ছিলেন তিনি। তবে দলের পারফরম্যান্স ছিল সাদামাটা।
১৪ ম্যাচে ৬ জয় আর ৮ হারে ১২ পয়েন্ট নিয়ে আট নম্বরে থেকে প্রথম পর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছে কলকাতা। তবে ব্যাট হাতে ১৪ ম্যাচে প্রায় ৩১ গড়ে ৩ ফিফটিতে ৪০১ রান করেন আইয়ার।
- ঋষাভ পান্ত (দিল্লী ক্যাপিটালস)
অনেকটা আক্ষেপ নিয়েই পঞ্চদশ আসর শেষ করেছে ঋষাভ পান্তের দিল্লী ক্যাপিটালস। ডু অর ডাই ম্যাচে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের কাছে হেরে পয়েন্টস টেবিলের পাঁচে থেকে বিদায় নেয় দলটি। তবে ঋষাভের ব্যাটে এবারের আসরে ছিল না আশানুরূপ পারফরম্যান্স। অধিনায়কত্বের চাপটা কি এবার তাহলে বেশি অনুভব করেছেন পান্ত?
১৪ ম্যাচে ৩০.৯১ গড়ে করেছেন ৩৪০ রান; নেই কোনো ফিফটি। আগের আসর গুলোর তুলনায় এবারের পারফরম্যান্সটা বেশ সাদামাটাই বলা চলে পান্তের। অধিনায়ক হিসেবেও সমালোচিত হয়েছেন বেশ কয়েকবার। উইকেটের পেছনে ক্যাচ মিস সহ, ভুল সিদ্ধান্ত ছিল চোখে পড়ার মত।
- সাঞ্জু স্যামসন (রাজস্থান রয়্যালস)
সাঞ্জু স্যামসনের নেতৃত্বে এবার প্লে অফে খেলছে রাজস্থান রয়্যালস। অধিনায়ক হিসেবে এবার বেশ ভাল পারফরমই করছেন স্যামসন। ব্যাট হাতে আগের আসরের চেয়ে খানিকটা পিছিয়ে থাকলেও দেখা গেছে ঈর্ষনীয় পারফরম্যান্স। জশ বাটলার সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ও যুজবেন্দ্র চাহাল এবারের আসরের এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি; দু’জনেই খেলছেন রাজস্থানের হয়ে। এই দু’জনের পারফরম্যান্স যেন স্যামসনকে দিয়েছে স্বস্তি। সহজেই পৌঁছে গেছেন প্লে অফে।
১৫ ম্যাচে ৩০ গড়ে করেছেন ৪২১ রান। আছে দুই ফিফটি, স্ট্রাইক রেট ১৫০ এর বেশি। এবারের আসরে হাঁকিয়েছেন ২৪টি ছক্কা; আইপিএল ক্যারিয়ারে কোনো আসরে ব্যক্তিগত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।