সে একটা সময় ছিল বটে। যখন ভারতের ক্রিকেট নিয়ামক সংস্থাকে ম্যাচ প্রতি ৫ লক্ষ টাকা দিতে হতো ভারতের জাতীয় সম্প্রচারক দূরদর্শনকে। ১৯৯৩ সালে প্রথম ট্রান্সওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশানাল নামক একটি সংস্থাকে বিসিসিআই ইংল্যান্ড সিরিজের টিভি স্বত্ব বিক্রি করে সামান্য কিছু টাকায়। দূরদর্শনকে সেই সিরিজের সব ম্যাচ সম্প্রচার করার জন্যে টিডব্লিউআইকে দিতে হয় পারিশ্রমিক। সেই শুরু।
গত কয়েক বছরে প্রায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়া বোর্ড সেই টিভি স্বত্ব বেচে খানিক লাভের মুখ দেখলো। ভারতে ক্রিকেট নামক ব্যবসার ডালপালা বিস্তার সেখান থেকেই শুরু। হিরো কাপের সম্প্রচার স্বত্ব এবং তার আইনি লড়াই, সুপ্রিম কোর্টের অভূতপূর্ব রায় এবং তার পরবর্তীতে ভারতীয় ক্রিকেটের আর্থিক বাড়বাড়ন্তের এক অত্যন্ত মনোগ্রাহী বর্ণনা দিয়েছেন বোরিয়া মজুমদার তাঁর ‘ইলেভেন গডস অ্যান্ড এ বিলিয়ন ইন্ডিয়ান্স’ বইতে।
আজকের দিনে ভারতীয় বোর্ড পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ক্রিকেট বোর্ড। আশির দশকের শেষ ভাগের করুণ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি থেকে বোর্ডের আজকের মহীরুহ হয়ে ওঠার পিছনে যে ‘বস্তু’টি অনেকাংশেই দায়ী – তা হল ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ বা আইপিএল।
২০০৮ সালে যখন আইপিএল শুরু হয়, সেখান থেকে আজকের ক্রিকেট অনেক বদলে গেছে। জাতীয় দলের খেলা থাকলে আইপিএল ছেড়ে খেলোয়াড়রা পারি দিতেন দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলতে। ২০০৮ এর টুর্নামেন্টেই তো, ম্যাককালামরা প্রথম চার ম্যাচের পরেই ইংল্যান্ড সফরের উড়ান ধরেন। সেখানে টেস্ট সিরিজ খেলতে।
আবার পন্টিং-হেইডেনরা উড়ে যান সুদূর ক্যারিবিয়ানে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রাকৃতিক ক্রিকেট মৌসুমে আর সেখানে লম্বা লম্বা টেস্ট সিরিজ হয় না। পাঠক খেয়াল করুন লারার ৩৭৫ কিন্তু ওই ১৮ এপ্রিলেই করা। ওই দিনেই তো আইপিএলের জন্ম।
নিউজিল্যান্ডের প্রধান খেলোয়াড়রা পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক ম্যাচ না খেলে আইপিএল খেলেন। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কার মতো বোর্ড গুলি আইপিএল উইন্ডোয় আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেললে ধেয়ে আসে আগামী নিলাম থেকে ‘শ্যাডো’ ব্যানের চোখ রাঙানি। দরিদ্র বোর্ডগুলির অন্তর্ভুক্ত খেলোয়াড়রা আজকাল জাতীয় চুক্তি বাতিল করে দেশে দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা কুড়ি বিশ লিগ খেলে বেড়ান। অথচ, একসময় গেল এবং ব্রাভোদের জাতীয় দলে না খেলতে চাওয়া নিয়ে গেলো-গেলো রব শোনা যেত।
হবে নাই বা কেন? মাত্র পনেরো বছরে যে লিগ পৃথিবীর দ্বিতীয় ধনীতম হতে পারে, তার দিকেই তো সকলের নজর থাকবে। আইপিএল-এর বল প্রতি টিভি স্বত্বের যা দর, তা যে কোনো উচ্চকোটির প্রবন্ধন সংস্থা থেকে পাশ করা ছেলে মেয়েদের স্বপ্নের বাৎসরিক আয় হয়ে থাকে। কাজেই… আইপিএল এখন ক্রিকেটেরই খুব জরুরী অংশ।
আজ আইপিএল এর ফ্র্যাঞ্চাইজিরা শুধু ভারতে সীমাবদ্ধ নেই। গোটা বিশ্বের বিভিন্ন লিগে বিস্তার করেছে তাদের প্রভাব। সকলেই এক একটি ব্র্যান্ড। গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে এদের স্কাউটিং নেটওয়ার্ক। অস্বীকার করে লাভ নেই, অদূর ভবিষ্যতে কুড়ি-বিশ আরও বাড়বে। আইপিএল হয়তো বছরে মাস ছ’য়েক ধরে চলবে। এবং আরও ফুলে ফেঁপে উঠবে বোর্ড অব কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া। ক্রিকেট নামক ভিক্টরিও খেলাটির খোল নলচে আমূল পাল্টে যাবে।
একজন পেশাদার ক্রিকেটার তাঁর জীবনে কি কি চাইতে পারেন? তাঁর দক্ষতা দেখানোর জন্যে উচ্চ মানের একটি মঞ্চ, নির্দিষ্ট এবং যথেষ্ট পরিমানে উপার্জন, উচ্চমানের প্রতিযোগিতা, জনপ্রিয়তা। হেজিয়ে লাভ নেই, আইপিএল-এর সব ক’টি মানদণ্ডেই লেটার পেয়ে পাশ করে। এবং বর্তমান আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের চেয়ে বেশি নম্বর পায়। একজন ক্রিকেটার তাঁর জীবনের অন্যান্য শখ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে ৩৫-৪০ বছরেই অবসর নিতে হবে জেনেও কেন রোদ-ঝড়-শীত উপেক্ষা করে উদয়াস্ত পরিশ্রম করবে? উপরের সব ক’টি মানদণ্ডের জন্যেই করবে।
কাজেই আইপিএল ও রমরম করেই চলবে। তার হাতে বেটিং, শ্রীশান্থ, লোলিত মোদি, মায়াপ্পান, গোপন খাম, স্পট-ফিক্সিংয়ের রক্ত লেগে থাকা সত্ত্বেও।
আইপিএল ভারতের ক্রিকেটকে কদর্য ভাবে ধনী করে তুলেছে। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘স্টিঙ্কিং রিচ’। তবে শুধু আর্থিক ভাবেই নয়। আইপিএল-এর স্কাউটিং বহু অজানা-অচেনা খেলোয়াড়কে সুযোগ করে দিয়েছে। বহু অকিঞ্চন ঘরের খেলোয়াড়কে এনে দিয়েছে আর্থিক সচ্ছলতা। ভারতের অপ্রতুল জনসংখ্যার সুবিধা পেতে সাহায্য করেছে ভারতের ক্রিকেটকে।
সর্বোচ্চ পর্যায়ে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়দের সাথে গা ঘেঁষা-ঘেষি করে শেখার সুযোগ করে দিয়েছে। ডাকাবুকো মননের ক্রিকেটারের জন্ম দিয়েছে আইপিএল। ভালোয়-মন্দয় মিশিয়ে আইপিএল আছে আইপিএল এই। ওই ইংরেজিতে বলে না, ‘Love it or Hate it, but you can’t ignore it’। কথাটা মনে হয় আইপিএল নামক জন্তুটির জন্যেই তৈরি হয়েছিল।