আইপিএল, প্রদীপের আড়ালে থাকা অন্ধকার

ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ – এই শব্দগুচ্ছ নিশ্চয়ই মস্তিষ্কে একটা জাকজমকের প্রতিচ্ছবি তৈরি করে দেয়। সাথেই সম্ভবত অর্থের ছড়াছড়ির একটা অস্পষ্ট ছবি ভেসে বেড়ায়। তবে এসবকিছু ছাপিয়ে ক্রিকেট পাড়ায় জোর গুঞ্জন আছে ক্রিকেটের উন্নয়নে আইপিএল রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

অন্তত ভারতের প্রেক্ষাপটে সে কথা সত্য বটে। কিন্তু গোটা আইপিএলই যেন এক মরীচিকা। যা দেখা যায় তার আড়ালেও থেকে যায় অনেক কিছু। প্রতিটা জিনিসেরই তো রয়েছে খারাপ-ভাল দিক। আইপিএলের ভাল দিকের পাশাপাশি সেখানেও রয়েছে বেশ কিছু খারাপ দিক। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, নেতিবাচক দিকগুলোর প্রভাবটাই যেন পড়ছে বেশি।

প্রথমত, আইপিএলকে ভেবে নেওয়া হচ্ছে খেলোয়াড় বাছাইয়ের অন্যতম এক মাধ্যম। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দারুণভাবে ব্যাকফায়ার করেছে আইপিএল থেকে খেলোয়াড় বাছাইয়ের নীতি। কেননা জৌলুশের ভীরে যেন ভারতীয় নির্বাচকরা হারিয়ে ফেলেন স্বাভাবিক চিত্রের স্মৃতি। আইপিএলের পারফরমেন্সের উপরে ভর করে টেস্ট বা ওয়ানডে ক্রিকেটে খেলোয়াড়দের সুযোগ দেওয়াই যার বড় উদাহরণ।

ক্রিকেটের ক্ষুদ্রতম সংস্করণের এক ঘরোয়া লিগ বনেদী ফরম্যাটে খেলোয়াড় বাছাইয়ের মাপকাঠি হতে পারে না। তবে আইপিএল সেই প্রভাব ইতোমধ্যেই বিস্তার করে ফেলেছে পুরো ভারত জুড়ে। তাছাড়া এক আইপিএলের পারফর্ম করা খেলোয়াড়কে তড়িঘড়ি করে জাতীয় দলের আনার মাশুলও দিতে হয়েছে ভারতীয় নির্বাচকদের।

সবচেয়ে বড় উদাহরণ সম্ভবত বরুণ চক্রবর্তী। আইপিএলের দূর্দান্ত পারফরমেন্সের কারণে সোজা বিশ্বকাপ দলে জায়গা করে নেন তিনি। বিধিবাম, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সামনে যেন রীতিমত অসহায় বনে যান বরুণ। এমন ভুড়িভুড়ি উদাহরণ খুঁজলেই মিলে যাবে। তবে একথাও ঠিক যে, আইপিএল বেশকিছু উৎকৃষ্ট মানের খেলোয়াড়ও উপহার দিয়েছে ভারতকে।

এই যেমন জাসপ্রিত বুমরাহ, হার্দিক পান্ডিয়া, রবীন্দ্র জাদেজা, রবিচন্দ্রন অশ্বিন-সহ আরও অনেক। তবে এই যে খেলোয়াড় উপহার দিচ্ছে আইপিএল আবার ভ্রমের সৃষ্টি করছে, এর পাশাপাশি খেলোয়াড়দের মাঝে ক্লান্তি আর ইনজুরির প্রবণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

ক্রমশ দিন যত যাচ্ছে, আইপিএল যেন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। প্রায় দুই মাস ধরে কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে যেতে হয় খেলোয়াড়দের। প্রায় প্রতিদিনই খেলোয়াড়দের নামতে হয়ে স্নায়ুবিক যুদ্ধে। তাছাড়া শারীরিক পরিশ্রমের বিষয়টিও তো রয়েছে। মানসিক ও শারীরিক অবসাদ একেবারে জাপটে ধরে খেলোয়াড়দের। আর সেটার প্রভাব গিয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে।

সবচেয়ে কাছের উদাহরণ তো টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ভারতের নিদারুণ হার। অস্ট্রেলিয়ার কাছে রীতিমত পাত্তাই পায়নি ভারত। কেননা মাত্র কয়েকদিনের মাঝেই ভারতের অধিকাংশ খেলোয়াড়দের নিজেদের প্রস্তুত করতে হয়েছে। কয়েকদিনের মাথায় দুই মাসের চিন্তাধারা থেকে বেড়িয়ে আসতে পারেনি ভারত। ফলাফলটা তো মাঠেই পেয়েছে।

এর আগেও অবশ্য একই ধরণের ভরাভুবির সম্মুখীন হতে হয়েছিল ভারতকে। ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে প্রথম পর্ব থেকে বাদ পড়তে হয়েছিল ভারতকে। সেবারও কয়েকদিনের মাথায় আইপিএল শেষ করে বিশ্বকাপ খেলতে নেমেছিল রোহিত শর্মার দল। আর সেবার হানা দিয়েছিল শারীরিক ক্লান্তি আর টিম কম্বিনেশন।

এসব কিছু ছাড়াও আরও একভাবে আইপিএল বিরুপ প্রভাব ফেলছে। শুধুমাত্র ভারত নয় এর প্রভাবটা ছড়িয়ে যাচ্ছে পুরো ক্রিকেট বিশ্বে। প্রচুর অর্থকড়ির লোভনীয় প্রস্তাব প্রতিনিয়ত ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে খেলোয়াড়দের দিকে। তাতে করে অল্প সময়ে বিপুল অর্থ উপার্জনের তাগিদ বেড়ে যাচ্ছে ক্রিকেটারদের।

এতে করে জাতীয় দলের প্রতি খেলোয়াড়দের নিবেদন কমছে। এমনকি জাতীয় দলের খেলার গুরুত্বও হ্রাস পাচ্ছে। এই বিষয়টির সূত্রপাত আইপিএল করলেও, গোটা বিশ্বে চলমান ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট একই ধারা অব্যাহত রেখেছে। এতে করে বিশ্বের নানা প্রান্তে ক্রিকেট ছড়িয়ে যাচ্ছে ঠিক। তবে ক্রিকেটের আসল আমেজটাই কোথাও একটা বিলীন হচ্ছে।

সুতরাং দিনশেষে হয়ত আলোর রোশনাই চোখের সামনে একটা আলাদা পৃথিবী দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। আড়াল করছে পেছনে থাকা ঘোর অন্ধকার। ওই যে বাংলায় বলে না, প্রদীপের নিচেই অন্ধকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link