জয় কিংবা পরাজয়ের হিসেবটা ছিল অনেক দূরের। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে বাংলাদেশের খেলার ধরণটাই যে ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। একটা লম্বা সময় বাংলাদেশ যেভাবে এই ফরম্যাটে খেলেছে সেই প্রক্রিয়াটাই নাকি ছিল ভুল। সেজন্যই এই ফরম্যাটে বাংলাদেশের নিজস্ব কোন ব্র্যান্ড তৈরি হয়নি, আর সাফল্য তো ছিল ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
এর সবচেয়ে বড় কারণ বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটও খেলতে চেয়েছে ওয়ানডে ফরম্যাটের মত করে, ওয়ানডের পারফর্মারদের নিয়ে। একটা নির্দিষ্ট ছকের মধ্যে থেকেই বাংলাদেশ নিজেদের পরিকল্পনা সাজিয়েছে। অথচ টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটটাই খেলতে হয়ে ছকের বাইরে গিয়ে। একেবারে নতুন করে সাঁজাতে হয়ে পরিকল্পনার থালা।
তবে সেই সাহসটা, সেই ঝুঁকিটা বাংলাদেশ দল কিংবা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড কখনো নিতে চায়নি। তাঁরা সহজ পথেই হেঁটে গিয়েছেন। সিনিয়র ক্রিকেটারদের খেলার ধরণ নিয়ে দিনের পর দিন প্রশ্ন উঠেছে। মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদরা যে এই ফরম্যাটে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না তা একেবারে পানির মত পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল।
তবুও কোন এক অদ্ভুত চিন্তায় কিংবা শক্তিতে তাঁদের দিয়েই দিনের পর দিন দল সাজানো হয়েছে। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে বাংলাদেশ মাঠেই নামত যেন একটা সম্মানজনক পরাজয়ের জন্য। জয়ের চিন্তা করা, জয়ের জন্য খেলার উদাহরণ গত কয়েকবছর এই ফরম্যাটে দেখা যায়নি। খুব স্বাভাবিকভাবেই সাফল্য ছিল ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
টি-টোয়েন্টি দলে পরিবর্তন আনার প্রশ্ন গত কয়েকবছর ধরেই উঠছে। তবে বারবার আলোচনাটা ধামাচাপা দেয়া হয়েছে বিকল্প না থাকার অযু হাত দেখিয়ে। অথচ বিকল্প যারাই আছেন, তাঁদেরকেও কখনো সুযোগ দিয়েই দেখা হয়নি। একটা ছকের মধ্যে, সর্বনিম্ন ঝুঁকি নিয়েই মান বাঁচানোর চেষ্টা করে যাওয়া হয়েছে।
সেখান থেকে বেরিয়ে আসার প্রথম একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় শ্রীধরন শ্রীরাম টি-টোয়েন্টি পরামর্শক হয়ে আসার পর। তিনি এই ফরম্যাটে ইমপ্যাক্টফুল ক্রিকেটারদের গুরুত্ব দেয়ার চেষ্টা করেছেন। গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দলেই প্রথম ছকের বাইরে কিছু করতে দেখা যায় বাংলাদেশকে। তাতে রাতারাতি খুব বড় কোন সাফল্য নিশ্চয়ই আসেনি। তবে একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল।
সাবেক টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ সেই দলে জায়গা হারান। মুশফিকুর রহিমও অবসর নেন এশিয়া কাপের ব্যর্থতার পর। লম্বা সময় পর দলে ডাকা হয় সাব্বির রহমানকে। নাজমুল হোসেন শান্ত অফ ফর্মে থাকলেও তাঁকে ব্যাক করা হয়। অল্প সময় পেলেও সেই দলে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আসে।
সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বে দলটা যে জয়ের জন্য খেলতে চাইছে সেটা বোঝা যায়। বিশ্বকাপে বড় কোন সাফল্য না পেলেও বাংলাদেশের পারফর্মেন্সে পরিবর্তন আসে। এরপর এবারের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগও একটা বড় বার্তা দিয়েছে।
লোকাল কয়েকজন ক্রিকেটার দারুণ পারফর্মেন্স করেছেন। নাজমুল হোসেন শান্ত, তৌহিদ হৃদয়রাই সিলেট স্ট্রাইকার্সকে ফাইনাল অবধি নিয়ে গিয়েছেন। রনি তালুকদার বিপিএলে প্রমাণ করেই আট বছর পর জাতীয় দলে ডাক পেয়েছেন। তৌহিদ হৃদয়কেও প্রথমবারের মত আনা হয়েছে জাতীয় দলে।
শ্রীরামের শুরু করা প্রক্রিয়াটাই এবার নিজের মত করে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন চান্দিক হাতুরু সিংহে। ঘরোয়া ক্রিকেটে তেমন ফর্মে না থাকলেও আবার শামীম পাটোয়ারিকে দলে ফিরিয়েছেন তিনি। কেননা তাঁর মত ব্যাটের স্যুইং বাংলাদেশের খুব কম ব্যাটারেরই থাকে। শামীমকে তৈরি করা গেলে স্লগ ওভারে তিনি হতে পারেন বাংলাদেশের ট্রাম্পকার্ড।
আর এই ধরনের পজিশনে ক্রিকেটার পেতে হলে সুযোগ দিতে হয়। শামীমের ক্ষেত্রেও সেটাই করছেন হাতুরু। শুধু দলেই ফেরাননি বরং ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে একাদশেও ছিলেন এই ব্যাটার। হাতুরু একাদশে রেখেছেন রনি তালুকদারকে।
এই সবকিছু লোকাল ক্রিকেটারদের কাছেও একটা বার্তা দেয়। পারফর্ম করতে পারলে বাংলাদেশ দলের দরজা সবার জন্যই খোলা। আট বছর পর রনি ফিরেই যেমন ওপেন করতে পারেন, তেমনি তরুণ তৌহিদ হৃদয়কেও এখানে দেয়া হয় চারে ব্যাট করার যুযোগ।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এই তরুণ দলটাই বাংলাদেশকে জয় এনে দিয়েছে। এবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের সাথে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়টাও সম্ভব বলেই মনে হচ্ছে। আর এইসব কিছুই হচ্ছে শান্ত, হৃদয়, হাসান মাহমুদদের হাত ধরে। অথচ যাদের বিকল্প ভাবতেই রাজি ছিল না বাংলাদেশ দল।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে তবে এটাই কী এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সেরা টি-টোয়েন্টি একাদশ? উত্তরটা না হওয়ার সুযোগ খুব বেশি নেই। তবে অবশ্যই আরো কিছু ম্যাচ হলে পরিবর্তন আসবে। ব্যাকআপ হিসেবে আরো কয়েকজন যোগ হতে পারেন এখানে। তবে মূলত এই দলটাই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে সেটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচটায় ওপেন করেছেন রনি তালুকদার ও লিটন দাস। লিটনের জায়গাটা মোটামুটি পাকা। তবে রনিকে আরো কিছু ম্যাচ দেখবে বাংলাদেশ। মূলত পাওয়ার প্লেতে ফ্লায়িং স্টার্ট এনে দেয়াটাই তাঁর কাছ থেকে চাওয়া। এর বাইরে পারভেজ হোসেন ইমনকেও তৈরি করতে পারে বাংলাদেশ দল।
এরপর শান্ত, হৃদয়রা, আফিফরাই থাকবেন মিডল অর্ডারের প্রাণ হয়ে। এই পজিশন গুলোতেও আপাতত খুব বেশি হেরফের হওয়ার সুযোগ নেই। এখানে ব্যাকআপ হিসেবে আসতে পারে ইয়াসির আলী রাব্বির নামও। এরপর অধিনায়ক সাকিব আল হাসান তো থাকবেনই। আর স্লগ ওভারে শামীম পাটোয়ারি বেশ কিছু ম্যাচ সুযোগ পাবেন। তবে তাঁর পাশাপাশি ব্যাকআপ হিসেবে দলে আছেন নুরুল হাসান সোহান।
এই পজিশনের জন্য আরো কিছু ক্রিকেটার নিশ্চয়ই খুঁজে বের করতে চাইবেন হাতুরু। ছয়-সাতে ব্যাট করতে নেমে দ্রুত রান করে দিতে পারেন এমন ব্যাটার খুঁজে পাওয়াটা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ওদিকে স্পিন বোলিং ডিপার্টমেন্টে সাকিবের সাথে আছেন নাসুম আহমেদ। সুযোগ পেতে পারেন তানভীর ইসলামও।
পেসার হিসেবে তাসকিন আহমেদ, হাসান মাহমুদ, মুস্তাফিজুর রহমান এই তিনজনই প্রথম পছন্দ। এছাড়া ব্যাকআপ হিসেবে রেজাউর রহমান রাজা, শরিফুল ইসলাম, মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীরাও থাকবেন ভাবনায়। বলা যায় এই নামগুলোকেই ঘুরে ফিরে আগামী কয়েকবছর বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি দলে দেখা যাবে। এর বাইরেও উঠে আসতে পারে নতুন কিছু নাম।
এছাড়া ২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপকে সামনে রেখে বাংলাদেশ বেশ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষাও করতে পারে। নিজেদের সেরা কম্বিনেশন খুঁজে বের করার জন্য ছকের বাইরে অনেক কিছুই হয়তো করতে দেখা যাবে সামনে। তাতে কখনো কখনো হোঁচটও খেতে হতে পারে। তবে এই ফরম্যাটে অনেক দূর হাঁটতে হলে এই হোঁচট গুলো তো খেতেই হত।