লড়াইটা পরের রাউন্ডে হবে বলে মনে হয়েছিলো। কাতার বিশ্বকাপের ইউরোপিয় বাছাইপর্বের প্লে-অফে একই গ্রুপে নিজেদের পেয়েছিল পর্তুগাল এবং ইতালি। সেই থেকেই সবাই স্বপ্ন দেখেছিল যার যার সেমিফাইনালে জিতে মুখরোচক প্লে-অফ ফাইনালে মুখোমুখি হবে সাবেক দুই ইউরো চ্যাম্পিয়ন। পর্তুগালের জয় নিয়ে দ্বিধা থাকলেও ইতালির ম্যাচে ফলাফল যে তাদের দিকেই যেতে চলেছে সেটি বলার জন্য ফুটবল বিশ্লেষক ডাকার প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু কে জানতো কি ঘটতে চলেছে প্লে-অফের সেমিতে!
ডু অর ডাই ম্যাচে পর্তুগাল তুর্কি প্রতিরোধ ভেঙ্গে এগিয়ে যেতে পারলেও অন্তিম সময়ে গোল হজম করে নর্থ মেসিডোনিয়া এর বিপক্ষে হেরে গিয়েছে ইতালি। আর সেই সাথে বাদ পড়েছে বিশ্বকাপ বাছাই থেকেও। ফুটবল বিশ্বকে থমকে দিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপের টিকিট কাটতে ব্যর্থ হয়েছে আজ্জুরিরা।
একটা ভুতুড়ে সময় যেনো ভর করেছে ইতালির ওপর। ২০০৬ সালে বিশ্বকাপ জেতার পর থেকে যেনো এক অভিশাপে পড়েছে তারা। এই নিয়ে টানা দুই বিশ্বকাপের বাছাইপর্বেই ছিটকে গেলো। অথচ এমনটা হওয়ার কোনো কারণ ছিলো না। এর মধ্যে ইতালির ফুটবলে পুনর্জাগরণও ঘটেছে। যা দেখিয়ে তারা ইউরোও জিতে নিয়েছে।
দাপট দেখিয়ে ২০২১ ইউরো জেতা ইতালিয়ানদের অনেকেই বিশ্বকাপে অন্যতম দাবিদার ভেবে নিয়েছিল। তবে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে এসে তারা প্রথম হোঁচট খায়। গ্রুপে দ্বিতীয় হয়ে বিশ্বকাপে সরাসরি কোয়ালিফাই করতে ব্যর্থ হয়। তবুও প্লে-অফে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর পর্তুগালকে একই গ্রুপে পাওয়া সত্ত্বেও অনেকেরই বাজির ঘোড়া ছিল আজ্জুরি’রা।
বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের প্লে-অফ ম্যাচে পালেরমোতে পুরো ৯০ মিনিটই নিজেদের দাপট ধরে রেখেছিল স্বাগতিক ইতালি। কিন্তু ৬৬ শতাংশ বলের দখল এবং ৩২টি শট নিয়েও কোনো গোলের দেখা পায়নি তারা। বল দখলে রেখে বারবার মেসিডোনিয়ার বক্সে হানা দিয়েছিল ইতালি তবে আটকে গিয়েছে মেসিডোনিয়ানদের প্রতিরোধ দেয়ালের সামনে। ভিসার মুসলিউ, ডার্কো ভেলকোভস্কিদের তৈরি প্রতিরক্ষা ব্যূহের সামনে বারংবার হতাশ হতে হয়েছে ইম্মোবিলদের। মধ্যমাঠে ভেরাত্তি, জর্জিনিওদের ব্যাপক আধিপত্যের পরেও একেবারের জন্যও গোলমুখের দেখা পায়নি বর্তমানের ইউরো চ্যাম্পিনয়রা।
ম্যাচের তখন প্রায় শেষ। তখনই নাটকীয় ভাবে ঘুরে গেলো ম্যাচের মোড়। না, দশটিরও বেশি সুযোগ সৃষ্টি করা ইতালিয়ানরা গোল করে ফেলেনি। বরং পুরো ম্যাচ জুড়ে একটিও বড় সুযোগ তৈরি করতে না পারা মেসিডোনিয়া সব আলো কেড়ে নেয় যোগ করা সময়ের এক মিরাকেলে। ৯২তম মিনিটে বদলি স্ট্রাইকার মিয়ভস্কি সামনের দিকে বল পাঠান। তার এগিয়ে দেয়া বলে ডান পায়ের এক অস্বাভাবিক শটে ২৫ গজ দূর থেকে জিয়ালুইজন বুফনের উত্তরসূরী দোনারুমাকে পরাস্ত করেন ত্রাকভস্কি।
দূরপাল্লার এক অভাবনীয় গোলে ইতালিসহ পুরো পুরো বিশ্বকে স্তব্ধ করে দেন নর্থ মেসিডোনিয়া’র এই স্ট্রাইকার। মজার ব্যাপার যে, পুরো ম্যাচ জুড়ে কখনোই ইতালি’র ডি-বক্সের ভেতর থেকে শট নিতে পারেনি নর্থ মেসিডোনিয়া।
এরপর আর কিছুই নয়; রেফারি ম্যাচ শেষের বাশি বাজার সাথে সাথে ইতালি’র বিশ্বকাপের বিমান ধরার স্বপ্নেরও সমাপ্তির ঘোষনা করে দেন। অন্যদিকে ইতিহাস সৃষ্টি করা মেসিডোনিয়ান’রা তাদের জন্য এক অলীক কল্পনা, বিশ্বকাপের দিকে এক পা এগিয়ে গিয়েছে। প্লে-অফ ফাইনালে তারা মুখোমুখি হবে আরেক পরাশক্তি, স্বয়ং ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর পর্তুগালের। আরো একবার সেদিন হয়তো ইতিহাস গড়তে চাইবে মেসিডোনিয়ার কোচ ব্লাগোজা মিলেভস্কি।
ইতিহাসে লিখা থাকবে না কত ভাগ বল ইতালির’র দখলে ছিল, লিখা থাকবে না ঠিক কতবার ইতালির আক্রমান পরীক্ষা নিয়েছিল মেসিডোনিয়া’র গোলরক্ষক দিমিত্রিভেস্কি এর। ইতিহাস আর পরিসংখ্যানে থাকবে স্কোরলাইন; ১-০ গোলে জিতেছে মেসিডোনিয়া। শুধু এতটুকুই জ্বলজ্বল করে জলবে মেসিডোনিয়া’র ইতিহাসে, ফুটবলের ইতিহাসে। আর যতবার এমন জ্বলজ্বলে স্কোরলাইনে চোখ পড়বে ততবাই হয়তো স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রনায় ভুগবে আজ্জুরি সমর্থকরা।
স্তাদিও রেঞ্জো বারবেরা আর স্তাদিও ওলিম্পিকো। পালেরমোর রেঞ্জো স্টেডিয়াম থেকে কেউ রোমের অলিম্পিক স্টেডিয়ামের দূরত্ব প্রায় ৯৫০ কিলোমিটার। কিন্তু ইতালির এই বিদায়ে ফুটবল পাগল সব ইতালিয়ানের মনেই এক সাথে হাজির হয়ে গেলো পালেরমো আর রোম। ইস, সেদিন যদি জর্জিনিও পারতেন! সেদিন সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে পেনাল্টি থেকে গোল করতে পারলে আজকের এইদিন দেখতে হতো না এই মিডফিল্ডারকে, দেখতে হতো না ইতালিকে।
ইউরো চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মাত্র বারো মাসের মধ্যেই একটি কালো অধ্যায় দেখতে হলো চার বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইতালিকে। অথচ রবার্তো মানচিনি দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই ইতালি হয়ে উঠেছিল পরাশক্তি। পাসিং, প্রেসিং, বল দখল কিংবা দ্রুতগতি’র কাউন্টার এটাক; সবদিকেই ছিল তাদের পারদর্শিতা। ফুটবল ভক্তদের অদ্ভুত ভাবে মোহিত করে যাচ্ছিলেন মানচিনি। ডিফেন্ডিং বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স কিংবা ফুটবলের আতুড়ঘর ব্রাজিলের বিপক্ষে লড়াইয়ের জন্য দারুনভাবেই নিজেদের তৈরি করেছিল ইতালিয়ান’রা।
অথচ ভাগ্যের কি পরিহাস; বিশ্বকাপের পথে একমাত্র বাধা পর্তুগাল পর্যন্তই আসা হলো না মানচিনি’র শিষ্যদের। দুর্বল মেসিডোনিয়া’র বিপক্ষেই শেষ মূহুর্তে হেরে গিয়ে নত মস্তকে বিদায় নিতে হলো মাঠ থেকে। ইউরো জয় যদি হয় রবার্তো মানচিনি’র সেরা সাফল্য তবে বিশ্বকাপ প্লে-অফে এমন অঘটন তার জন্য হয়ে থাকবে আজীবনের আক্ষেপ। এতটা নান্দনিকভাবে নিজেদের প্রস্তুত করেও বিশ্বমঞ্চে লড়াইয়ের সুযোগ টুকু পেলেন না চিয়েল্লিনি-বনুচ্চিরা।
২০১৮ বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে সুইডেনের বিপক্ষে হেরে বাদ পড়েছিল ইতালি, এবার অঘটনের শিকার দুর্বল নর্থ মেসিডোনিয়া’র সাথে। পরপর দুইবার ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসরে খেলা থেকে বঞ্চিত হতে হলো তাদের। চারবারের বিশ্বকাপজয়ী ইতালিকে আবারো বিশ্বকাপে দেখার অপেক্ষার প্রহর বাড়তেই থাকলো ভক্তদের জন্য। সর্বশেষ ২০১৪ এর বিশ্বকাপ খেলছিল ইতালিয়ানরা। আর বিশ্বকাপের নক আউট পর্বে খেলছিল ১৬ বছর আগে; ২০০৬ বিশ্বকাপের ফাইনালে। সেবার অবশ্য জিনেদিন জিদানের ফ্রান্সকে হারিয়ে শিরোপা জিতে নিয়েছিল ফুটবলের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী এই দলটি।
ফুটবলের শক্তিতে তুলনামূলক পিছিয়ে থাকা ইরান, দক্ষিন কোরিয়া খেলবে কাতারে; হয়তো যুক্তরাষ্ট্র কিংবা কোস্টারিকা’র মত দুর্বল দলসমূহের দেখাও মিলবে ২০২২ বিশ্বকাপে। কিন্তু অনিন্দ্য সুন্দর ফুটবলের পূজারি রবার্তো মানচিনি আর তার শিষ্যদের দেখা যাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে। ফুটবলটা এজন্যই বোধহয় বেশি সুন্দর, এখানে যে নিয়তি বড্ড দুর্বোধ্য আর কল্পনাতীত।