গল্পটা দু’ভাবে লেখা যেতে পারত। দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা সন্তান। যেমন অনেক ল্যাটিন আমেরিকার ফুটবলারদের সব রোমাঞ্চকর গল্প থাকে। বাবা ইটভাটায় কাজ করতেন। ছোট থেকে স্ট্রাগল করে ওঠা। ফুটবলকে ঘুমঘোরে স্বপ্নে দেখা। ঐ ওল্ড ওয়াইন ইন আ নিউ বটল! যে মতি হয় আর কী। বানফিল্ডে গিয়ে ছোট্ট ছেলের ছড়ানো দ্যুতিতে সম্মোহিত হয়ে ইউরোপে পাড়ি।
এছাড়া এভাবেও লেখা যেতে পারত। ছোট থেকে জুভেন্টাসের ফ্যান শুনে বাবা বলছেন ছেলে মিলানের জন্য নিবেদিত প্রাণ! ত্রিয়েস্তে থেকে মিলানে আগত তার বাবাকে লোকে ডাকে ‘সিজার অব মিলান’। সেই ছেলে বাবার মত হবে কিনা তা সময় বলবে। তো যে সময় ইন্দিরা গান্ধী ভারতে খুন হচ্ছেন, অমিতাভের শরাবি দেখে চার পয়সার ব্যালকনিতে তুমুল সিটি বাজছে সেই সময় ইউরোপে কতকটা নি:শব্দে অভিষেক হচ্ছে তার। এটা অবশ্য ল্যাটিনের দুর্দশাগ্রস্তর গল্প নয়, গল্প ইউরোপের। এবং এমনই ইউরোপ যারা ফুটবলে মেশিনারি থাবার আমদানি করবে আর বছর কয়েক পরে।
এখন কথা হল, কী হত? যদি গড়পড়তা থাকত দু’জনে? কী হত যদি অন্য বহু আর্জেন্টাইনের মত আনন্দের হিল্লোল ভাসিয়ে নিয়ে যেত জাভিয়ের জানেত্তিকে? কী হত যদি তাবড় তাবড় নামের মাঝে হঠাৎ আকাশ থেকে হারিয়ে যেত পাওলো মালদিনি! হল যে না, শুধু এটার জন্য যে একটা বড়সড় ভাবে ফুটবলের কাছে আপামর দর্শকদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত সেটি নিতান্ত খুদে ব্যাপার।
বড় ব্যাপারটা হল, টানা ২৫-২৬ বছর ধরে ইতালীয় সিরি ‘এ’-তে এদের দু’জনকে ক্রমাগত ভাবে খেলতে দেখা। একটা আশ্চর্য মিল আছে দু’জনের। যেমন, দু’জনের কেউই প্রথাগতভাবে সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার নন। একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার এবং আরেকজন লেফটব্যাক। কিন্তু ‘তুমি আসবেই আমি জানি’-র মত দু’জনে চলে এলেন সেন্টার ব্যাকে। এবং, অবশ্যই কাপ্তান হিসেবে!
‘এল কাপিতানো’। অর্থাৎ, দ্য ক্যাপ্টেন। নির্দ্বিধায় বসানো যায় এই নাম। মানে যাদের কথা হচ্ছে, পাওলো মালদিনি এবং জাভিয়ের জানেত্তি। দুই মিলানের তর্কাতীতভাবে অবিসংবাদী নায়ক, নেতা, লেজেন্ড। মিলানের অলিন্দ এবং নিলয়, গোটা হৃৎপিণ্ড!
মালদিনি বিশ্বকাপ পাননি। বিশ্বকাপ বাদে আর যা যা পাওয়া উচিত তার অধিকাংশই পেয়েছেন। জানেত্তিও তাই। কিন্তু ঊনিশ-বিশের পার্থক্য থেকে গেল যে! খুব বেশি বড় নয়, ছোটই। মালদিনিকে বিশ্বকাপ পেতে দেয়নি রবার্তো বাজ্জিও পেনাল্টি মিস। আর জানেত্তিকে বিশ্বকাপ পেতে দেননি তাঁরই দুই স্বদেশীয় – হোসে পেকারম্যান এবং, ডিয়েগো ম্যারাডোনা। কীভাবে?
২০০৬। মার্সেলো বিয়েলসার কোচিংয়ে আগেরবার দুর্দান্ত খেলেও বিদায় নিতে হয় জাপান থেকে। তাই একটা ছাইচাপা আগুন ছিলই আলবিসেলেস্তেদের মধ্যে। উপরন্তু, ২০০৬-র টিমে একটা ঝাঁকড়া চুলের ১৯ নম্বর যোগ হয়েছে যার নাম লিওনেল মেসি। সঙ্গে তেভেজ, রিকেলমে, স্যাভিওলা। ডিফেন্সে কোলোচ্চিনি, বুর্দিসোর সাথে কোনও এক আশ্চর্য খেয়ালে ঐ বিশ্বকাপ টিমে জায়গা হল না পিক ফর্মে থাকা জানেত্তির! তার বদলে গ্যাব্রিয়েল হেইনজ্ টিমে এলেন অত্যাশ্চর্য ডাকে। যিনি ঐ সিজনের গোটাটাই প্রায় কাটিয়েছিলেন ইনজুরিতে, না হয় ডাগ আউটে বসে। খেলেছিলেন হাতে গোনা কয়েকটি ম্যাচে।
সেই বিশ্বকাপে পেকারম্যান কোন কারণে জার্মানি ম্যাচের শেষ মূহূর্তে রিকেলমেকে তুলে নিয়েছিলেন, তা নিয়ে মহাকাল আজও গবেষণা করেন!
কাট টু- ২০১০। স্বপ্নের ফর্মে হ্যাভিয়ের জানেত্তি। উপেক্ষার পর উপেক্ষাকে একটি তুড়িতে হাওয়ায় পাঠিয়ে তিনি ইন্টার মিলানের হয়ে জিতছেন ট্রেবল। অর্থাৎ, সিরি এ, কোপা ইতালিয়া এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতলেন বায়ার্নকে হারিয়ে! সে বছর অনবদ্য যে ক’জন ইন্টার মিলানে খেলেছিল তাদের মধ্যে আশ্চর্যজনক যে – প্রত্যেকের জীবনেই ঘনিয়ে এসেছিল অভিশাপের কালো মেঘ! স্নেইডার হারালেন বিশ্বকাপ, আর জানেত্তি হারালেন বিশ্বকাপ স্কোয়াডে তাঁর প্রায় পাকা জায়গাখানি।
কেন? কোনও যুক্তিযুক্ত কারণ কেউ উপস্থাপন করতে পারেনি। যে কোচ হয়ে এসেছিলেন, সেই ডিয়েগো ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনার কাছে কী, তার প্রকাশ অনভিপ্রেত। যেটা অভিপ্রেত ছিল যে জানেত্তি এবার সাউথ আফ্রিকার মাটিতে নীল-সাদা জার্সি গায়ে নামছেন। সবাইকে কার্যত হতবাক ক’রে দিয়ে তার জায়গায় জার্মানির বিপক্ষে নামল নিকোলাস ওটামেন্ডি। যাকে নিয়ে গোটা ম্যাচে লিটরেলি ছিনিমিনি খেলেছিল লুকাস পোডলস্কি! চার-চারটে গোল হজম করতে হয়তো হত না, যদি ৪ নম্বর জার্সি গায়ে জানেত্তি মাঠে থাকতেন! অবশ্য ঐ বিশ্বকাপে বুড়ো ভেরনকেও ফিরিয়ে মারাদোনা তাড়িয়েছিলেন রিকেলমেকে। যিনি বছর দুয়েক আগের বেইজিং অলিম্পিকে আর্জেন্টিনাকে এনে দিয়েছিলেন সোনার মেডেলের সম্মান।
কিন্তু যাকে নিয়ে এই উপেক্ষার উপন্যাস, সেই জানেত্তি ছিলেন স্থিতধী। অবিশ্বাস্য রকমের শান্ত! বলেছিলেন, ‘টিভিতে দেখে আমি আর্জেন্টিনাকে সাপোর্ট করব। দলের পাশেই থাকবো। আমরা সকলেই অল্পবিস্তর জানি যে, অতি বড় মহামানবরা যুগে যুগে এমন শান্তির বাণীই ধরাধামে প্রচার করে গেছেন। সুতরাং জানেত্তির এই মন্তব্য ততটা অবাক হওয়ার ঘটনা আদৌ থাকে না। থাকলেও, তা অবাক করার মতোও নয়।
অথচ এই উপেক্ষাকে সঙ্গী করেই জাতীয় দলে ১৪৫টা ম্যাচ! ইন্টারের লেজেন্ড, শুধু তাই নয় টানা পনেরো বছর ধরে ক্যাপ্টেন! যা নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মালদিনিরও ছিল না!
কে বড়, মালদিনি না জানেত্তি? বোকারা প্রশ্ন করবে। করতেই থাকবে।
জানেত্তি আসবেন, ফুটবল খেলবেন, টাটা করবেন। তার অনেক বছর পর হঠাৎ এক নিস্তব্ধ দুপুরে স্মরণ করতে বসব, ‘লোকটা কী ছিল রে, কী ছিল…’