জেন্স লেহম্যান, খ্যাপাটে এক কিংবদন্তি

ম্যানুয়েল নয়্যারের আবির্ভাবেই পূর্বে সুইপার কিপারের সাথে পরিচিত ছিল না ফুটবলবিশ্ব। বল পায়ে কারিকুরি দেখাবেন কিংবা সামনে এগিয়ে পাস বাড়াবেন এমনটা ভাবাই ছিল দুঃসাধ্য। পান থেকে চুন খসলেই ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা।

তবুও লাতিনের দুই কিপার রেনে হিগুয়েতা এবং হোসে চিলাভার্ট দর্শকদের আনন্দ দিয়েছেন তাঁদের পাগলাটে কিপিংয়ে। কখনো স্করপিয়ন কিক, জটলায় লাফিয়ে পড়েছেন আবার কখনো দারুণ হেডে সবাইকে চমকে দিয়েছেন। চিলাভার্ট-হিগুয়েতাদের পথ অনুসরণ করেই ইউরোপে ছিলেন জার্মান জেন্স লেহম্যান, যার খ্যাপাটে সব কর্মকান্ড বর্ণিল এক চরিত্র হিসেবে পরিচিতি এনে দিয়েছে ফুটবলপ্রেমীদের কাছে। 

ক্যারিয়ারে বরুশিয়া ডর্টমুন্ড, এসি মিলান, আর্সেনালের মত ক্লাবে খেলেছেন। কখনো দারুণ সব সেভে দলকে বাঁচিয়েছেন, আবার কখনো পাগলাটে সব কর্মকান্ডে কোচের চিন্তা বাড়িয়েছেন। তবে ক্যারিয়ারের শুরুটা মসৃণ ছিল না লেহম্যানের জন্য। 

শালকের একাডেমি থেকে মূল দলে সুযোগ পাওয়া লেহম্যান অভিষেক ম্যাচেই সাক্ষী হন করুণ পরিণতির। বায়ার লেভারকুসেনের বিপক্ষে ম্যাচে মাত্র সাত মিনিটের মাঝে হজম করেন তিন গোল। ফলশ্রুতিতে প্রথমার্ধেই কোচ তাঁকে তুলে নেন মাঠ থেকে। রাগে-দু:খে, অপমানিত, নি:সঙ্গ লেহম্যান সেদিন মাঠ ছেড়েছিলেন একাকি। টিম বাসেও জায়গা মেলেনি, বাড়ি ফিরেছিলেন ট্রামে চেপে। 

সবাই ভেবেছিল এই মানসিক আঘাত কাটিয়ে উঠতে পারবেন না তরুণ লেহম্যান। কিন্তু ধীরে ধীরে নিজের সামর্থ্যের জানান দিতে শুরু করেন তিনি। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন দলের এক নাম্বার গোলকিপার হিসেবে। ক্যারিয়ারের প্রথম গোলটাও পেয়ে যান পরের বছরই, ১৮৬০ মিউনিখের বিপক্ষে পেনাল্টি থেকে ঠাণ্ডা মাথায় বল জালে জড়ান। 

তবে লেহম্যান প্রথম আলোচনায় আসেন ১৯৯৭ উয়েফা সুপার কাপে। সেবারের ফাইনালে ইন্টার মিলানের বিপক্ষে টাইব্রেকারে ইভান জামোরানোর শট ফিরিয়ে দলকে শিরোপা জেতান তিনি। ১৯৯৮ মৌসুমে তাঁকে দলে ভেড়ায় ইতালিয়ান জায়ান্ট এসি মিলান। 

মিলানে আসার পরই ক্যারিয়ারে অধ:পতন শুরু হয় তাঁর। রোজ্জোনেরিদের হয়ে তৃতীয় ম্যাচেই তাঁর বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেন গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা। এর মাঝে একটা গোলে তো হাস্যকর ভুল করেন, সতীর্থের বাড়ানো ব্যাকপাস ধরতে না পেরে ঠেলে দেন প্রতিপক্ষের স্ট্রাইকারের পায়ে।

ফিওরেন্তিনার বিপক্ষে সেই ম্যাচের পর দর্শকদের রোষাণলে পড়েন তিনি। অন্যদিকে, মিলানের বেঞ্চ থেকে তখন উঠে আসেন সেবাস্তিনো রসির মতো তরুণ কিপার। ফলে খুব শীঘ্রই লেহম্যান একাদশে জায়গা হারান। 

১৯৯৯ মৌসুমের শুরুতেই লেহম্যান বুঝতে পারেন ইতালিতে তাঁর মধুচন্দ্রিমা ফুরিয়েছে। অন্যদিকে, ঘরের ক্লাব বরুশিয়া ডর্টমুন্ডও তাঁকে চাইছিল। দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে তাই লেহম্যান ইতালির পাততাড়ি গুটিয়ে চড়ে বসেন দেশের বিমানে।

দেশের ক্লাবে ফিরেই যেন পুরনো রূপে লেহম্যান, সেই শালকের দিনগুলোর মত। বরুশিয়ার রক্ষণে যেন দুর্গ গড়ে তোলেন। দারুণ সব সেভে প্রতিপক্ষকে হতভম্ভ করে দেন, আবার দলের বিপদে অতিরিক্ত সময়ে সমতাসূচক গোলও আসে তাঁর থেকে। বুন্দেসলিগার শেষ দিনে শিরোপা জিতে নেয় বরুশিয়া। ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মত লিগ শিরোপা জয়ের স্বাদ পান লেহম্যান। 

বরুশিয়াতে থাকাকালীন সময়েই ক্যারিয়ারের স্বর্ণালি দিনগুলো পার করেন তিনি। পারফরম্যান্স দারুণ হলেও মোটেই সুবোধ বালক হয়ে ছিলেন না, বিতর্কে জড়িয়েছেন বারবার। ফ্রেইবুর্গের বিপক্ষে এক ম্যাচে প্রতিপক্ষের স্ট্রাইকার সোমালি কুলিবালিকে লাথি মেরে নিষিদ্ধ হন। বরুশিয়ার হয়ে সবচেয়ে বেশি লাল কার্ড দেখার রেকর্ড তাঁর দখলে। এছাড়া তাঁর চেয়ে লাল কার্ড দেখেনি বুন্দেসলিগার কোনো গোলকিপারও।

২০০৪ মৌসুমে ডেভিড সিম্যানের বিদায়ের পর আর্সেনালের গোলবার সামলানোর জন্য হন্যে হয়ে কিপার খুঁজছিলেন আর্সেন ওয়েঙ্গার। অন্যদিকে, বরুশিয়ার হয়ে লেহম্যানের ফর্মটাও ছিল পড়তির মুখে। খানিকটা অভিজ্ঞতার আশায় ওয়েঙ্গার দলে ভেড়ান অভিজ্ঞ লেহম্যানকে।

লিগে বারকয়েক স্বভাবসুলভ হাস্যকর ভুল করলেও দলের জরুরি মুহূর্তে জ্বলে উঠেছেন। সেবারের মৌসুমে প্রথম দল হিসেবে অপরাজিত লিগ জেতার গৌরব অর্জন করে আর্সেনাল। যদিও চ্যাম্পিয়ন্স লিগে তাঁর ভুলেই চেলসির বিপক্ষে সমতাসূচক গোল হজম করতে হয় ওয়েঙ্গারের দলকে। 

পরের মৌসুমে আবারো ফর্ম হারালে একাদশ থেকে বাদ পড়েন। কিন্তু ম্যানুয়েল আলমুনিয়া সেই সুযোগ লুফে নিতে ব্যর্থ হলে এফএ কাপের ফাইনালে একাদশে ফেরেন লেহম্যান। বড় মঞ্চের অপেক্ষাতেই যেন ছিলেন তিনি, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে গোটা ম্যাচেই ছিলেন অনবদ্য। বারকয়েক নিশ্চিত গোল বাঁচিয়েছেন, টাইব্রেকারে পল স্কোলসের শট ঠেকিয়ে দলকে জিতিয়েছেন শিরোপা। ২০১০ সালে স্টুটগার্ডের হয়ে অবসর নিলেও আর্সেনালের হয়ে ফিরে আসেন পরের বছরেই।

মূলত ২০১১-১২ মৌসুমে ইনজুরির কারণে আর্সেনালের গোলবারে দাঁড়ানোর মত গোলকিপার ছিল না। সেবার নিয়মিত কিপার শেজনি, ফ্যাবিয়ানস্কি, ম্যানোরে সবাই ছিলেন ইনজুরিতে। ফলে দলের ডাকে অবসর ভেঙে পুনরায় প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে ফেরেন লেহম্যান। ব্ল্যাকপুলের বিপক্ষে ম্যাচে মাঠে নেমে গড়েন আর্সেনালের হয়ে সবচেয়ে বেশি বয়সে ইপিএলে মাঠে নামার রেকর্ড। সেই মৌসুমের পর চিরতরে বুটজোড়া তুলে রাখেন তিনি। 

জাতীয় দলের হয়ে ১৯৯৮ সালে অভিষেক হলেও অলিভার কানের সুবাদে নিয়মিত সুযোগ পাননি। ২০০২ বিশ্বকাপের রানার্স আপ দলের অংশ হলেও কোনো ম্যাচে মাঠে নামার সুযোগ পাননি। তবে ২০০৬ বিশ্বকাপের আগে জার্মান কোচ ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যান ঘোষণা দেন লেহম্যানই হবেন তাঁর দলের প্রথম পছন্দের কিপার।

সেবারের কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে টাইব্রেকারে আয়ালা এবং ক্যাম্বিয়াসোর শট ঠেকিয়ে দলকে সেমিতে তোলেন একা হাতে। যদিও সেমিতে ইতালির বিপক্ষে অতিরিক্ত সময়ে গোল হজম করে সেবার বাদ পড়তে হয় জার্মানিকে। জাতীয় দলের হয়ে মোট ৬১ ম্যাচে মাঠে নামেন এই কিপার। 

নিজের প্রজন্মের অন্যতম সেরা গোলকিপার বিবেচনা করা হয় তাঁকে। প্রথাগত, গোলকিপিংয়ের বাইরে গিয়ে কিপিং করতেন তিনি। ভয়ডরহীন লেহম্যান আজো হয়ে আছেন ফুটবল ইতিহাসের বর্ণিল এক চরিত্র। দলের প্রয়োজনে সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিতেও দ্বিধা করতেন না। তবে অধারাবাহিকতা ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় জুড়েই ভুগিয়েছে তাঁকে।

বুটজোড়া তুলে রাখার পর কোচিং পেশায় জড়িয়েছেন লেহম্যান। ভবিষ্যতের নয়্যার, বুফন কিংবা লেহম্যান গড়ে তোলাতেই পূর্ণ মনোযোগ তাঁর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link