রাহানের মেডেল ও জনি মুলাঘ

ছবির বাঁ দিকের মানুষটাকে চিনতে কোনোপ্রকার অসুবিধা হবার কথা নয়- ভারতের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক আজিঙ্কা রাহানে। ডানদিকের লোকটাকে না চেনাটাই স্বাভাবিক। তবে এ দু’জনের মাঝে একটা সম্পর্ক রয়েছে।

অধিনায়কোচিত নৈপুণ্য দেখিয়ে রাহানে হয়েছেন ম্যাচ সেরা। রাহানের গলায় যে মেডেলটা দেখা যাচ্ছে, তার নাম জনি মুলাঘ মেডেল। এতক্ষণে বুঝে যাবার কথা যে, ডানদিকের ব্যক্তিটির নাম জনি মুলাঘ।

জনি মুলাঘের পরিচয় জানতে ফিরে যেতে হবে ঊনবিংশ শতাব্দীতে, যখন অস্ট্রেলিয়ার কৃষ্ণাঙ্গ আদিবাসীরা শিকার হতো চরম বৈষম্যের। এমন এক সময়ে ১৮৪১ সালে হ্যারো শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার উত্তরে জন্ম নেন জনি মুলাঘ। তার জন্মগত নাম ছিলো উনারিমিন। তবে মুলাঘ স্টেশন নামের এক জায়গায় থাকতেন বলে সময়ের সাথে তার নাম হয়ে যায় জনি মুলাঘ।

কৃষিকাজ করার ফাঁকে ক্রিকেট খেলাটা রপ্ত করে ফেলেন তিনি। উপনিবেশবাসী কৃষকেরা যখন শ্রমিকদের মধ্য থেকে ক্রিকেটার নির্বাচন করছিলেন দল গঠনের জন্যে, তখন তাদের নজরে পড়েন মুলাঘ।

১৮৬৭ সালে তারা বেরিয়ে পড়েন ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে৷ উল্লেখ্য, আদিবাসী ক্রিকেটারদের এই দলটাই আন্তর্জাতিক সফরে যাওয়া প্রথম অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট দল।

কিন্তু সফরে বাধ সাধল অর্থাভাব। সিডনি পর্যন্ত যেতে না যেতেই অর্থের যোগান বন্ধ হয়ে গেলো এবং মুলাঘরা সেখানেই আটকা পড়লেন। কিন্তু, সিডনিতে দলটা নজরে পড়লো ইংরেজ ক্রিকেটার চার্লস লরেন্সের। একটা অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট দলের ইংল্যান্ড সফরের দারুণ সম্ভাবনা আঁচ কর‍তে পেরে সব বন্দোবস্ত করেন লরেন্স।

তবে ভয়ও ছিলো। ভিক্টোরিয়ার ঔপনিবেশিক সরকার তাদেরকে ইংল্যান্ড যেতে দেবে- এমনটা আশা করা ছিলো বৃথা। তাই দলটাকে এক প্রকার চুপি চুপি বের করে এনে তুলে দেয়া হয় ইংল্যান্ডগামী জাহাজে।

আদিবাসী অস্ট্রেলীয় দলটা ইংল্যান্ডে ছিলো পুরো এক বছর, খেলেছিলো মোট ৪৭ টি ম্যাচ। জনি মুলাঘ ছিলেন অসম্ভব সহনশীল ও পরিশ্রমী ক্রিকেটার, ৪৭ টি ম্যাচের মধ্যে ৪৫ টি ম্যাচে তার অংশগ্রহণ তাই প্রমাণ করে।

ঐতিহাসিক ডি জে মুলাভানির মতে, সেসময়টায় অলরাউন্ডার তকমা পাওয়ার মতো ক্রিকেটার ছিলেন না বললেই চলে। কিন্তু জনি মুলাঘ সেই সফরে ছিলেন অপ্রতিরোধ্য।

সেসময় যেসব উইকেটে খেলা হতো, সেগুলোকে বিপজ্জনক বললেও বোধহয় কম বলা হবে। মুলাঘ বিশের আশেপাশে গড় নিয়ে সেই সফরে করেছিলেন ১৬৯৮ রান। সফরে আর কেউই তার চেয়ে বেশি রান করতে পারেননি, এমনকি চার্লস লরেন্সও নন। বল হাতে দশ গড়ে নিয়েছিলেন ২৪৫ উইকেট, সফরে যা ছিলো দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

জানা গেছে, এমনকি উইকেটের পেছনেও কয়েকবার দাঁড়িয়েছিলেন তিনি, করেছেন চারটা স্ট্যাম্পিংও। তবে অস্ট্রেলিয়ায় এতো প্রশংসার পরও নিজ দেশে নিরাপদ ছিলেন না এই আদিবাসী ক্রিকেটারেরা। কিং কোল নামে এক ক্রিকেটার সেই সফরেই মারা যান। যারা ফিরতে পেরেছিলেন, তাদের জীবনযাপন করতে হতো সবার অলক্ষ্যে। ঔপনিবেশিক সরকার তাদের জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলেছিলো ততদিনে।

কিন্তু নিজেদের অধিকার নিয়ে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন মুলাঘ। সরকার নিয়ন্ত্রিত আবাসস্থলে থাকতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছেন সবসময়। মুলাঘ তার প্রায় পুরো ক্যারিয়ারেই খেলেছেন হ্যারো শহরের হয়ে৷ একটা ম্যাচই কেবল খেলেছিলেন অ্যাপস্লের হয়ে। সেখানে ঘটা একটা ঘটনাই বলে দেয় নিজের অবস্থানে কতটা অটল ছিলেন মুলাঘ।

মধ্যাহ্নবিরতিতে অ্যাপস্লে দলের ক্রিকেটাররা যখন দুপুরের খাবার খেতে সমবেত হচ্ছিলেন, তখন একজন শ্বেতাঙ্গ ক্রিকেটার বললেন, ‘What about that nigger?’

জনি মুলাঘকে উদ্দেশ্য করেই বলা হয়েছিলো কথাটা। দলের অধিনায়ক বললেন, ‘ও রান্নাঘরে খাবে, এখানে নয়।’

কিন্তু রান্নাঘরে বসে খেতে রাজি হন নি মুলাঘ। সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘যারা আমার সঙ্গে বসে খেতে পারবেনা, তাদের সাথে ক্রিকেট খেলার প্রশ্নই আসে না।’

নিজেদের সম্মান ও স্বাধীনতা আমৃত্যু বজায় রেখেছিলেন তিনি। শেষ দিনগুলো কেটেছিলো একটা খুপড়ি ঘরের মধ্যে। অবশেষে নিজের ৫০তম জন্মদিনের একদিন বাদেই মারা যান অস্ট্রেলিয়ার প্রথম আন্তর্জাতিক সফরের তারকা ক্রিকেটার জনি মুলাঘ। দ্য হ্যামিল্টন স্পেকটেটর মুলাঘের অবিচুয়ারিতে তাকে আখ্যায়িত করেছিলো ‘The WG Grace of aboriginal cricketers’ নামে। হ্যারো সিমেট্রিতে তার সমাধিফলকে লেখা আছে ‘Jony Mullagh, World Famed Cricketer’।

তার সম্মানার্থে ভিক্টোরিয়ার হ্যারো শহরে নির্মিত হয়েছে একটি স্মৃতিসৌধ, স্থানীয় ক্রিকেট মাঠের নাম রাখা হয়েছে জনি মুলাঘ ওভাল। চলতি মাসে প্রথম আদিবাসী ক্রিকেটার হিসেবে তার জায়গা হয়েছে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের হল অব ফেইমে।

তার প্রতি সম্মানস্বরূপ অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত বক্সিং ডে টেস্টের ম্যাচ সেরাকে এখন থেকে দেয়া হবে জনি মুলাঘ মেডেল। যার প্রথমটা উঠলো আজিঙ্কা রাহানের গলায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link