বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে প্রেমে বুদ কোন প্রেমিকা যদি তার প্রেমিককে জিজ্ঞেস করতেন – ‘সখী, ভালোবাসা কারে কয়!’ – এর উত্তর পাওয়ার হয়তো বা কোনো নিশ্চয়তা নেই। বরং, ফিল্ডিংয়ের সংজ্ঞা জানাটা বেশি সহজ। যেকোনো ক্রিকেট প্রেমিকই এই উত্তর জানেন। উত্তরে নিশ্চয়ই জন্টি রোডসেরই কথা আসবে। অন্তত আমার কাছে উত্তরটা কিছুটা এমনই, ফিল্ডিং মানেইতো জন্টি রোডস। ফিল্ডিং কত প্রকার ও কি কি – নব্বই দশকে এই প্রশ্নের জবার উদাহরণ সহ দিয়ে গেছেন তিনি।
বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে মহাকালের যাত্রায় অনেক খেলোয়াড়ই তাঁদের কীর্তি লিখে গেছেন সবুজের গালিচার বুকে বাইশ গজের উইকেটে। স্যার ডন ব্র্যাডম্যান, শচীন টেন্ডুলকার, ব্রায়ান লারা থেকে শুরু করে হালের কোহলি, কেন উইলিয়ামসন, স্মিথরা জগতখ্যাতি কুঁড়িয়েছেন ব্যাট হাতে মহাকাব্য রচনা করে।
বল হাতে ছড়ি ঘুরিয়ে ভুবনজুড়ে বিখ্যাত হয়ে আছেন ম্যালকম মার্শাল, সিডনি বার্নস, ডেনিস লিলি, মাইকেল হোল্ডিংরা কিংবা স্পিন কিংবদন্তি ওয়ার্ন-মুরালি। কিন্তু ব্যাট বলের খেলা ক্রিকেটে ব্যাট-বল দুই সত্ত্বাকে ছাপিয়ে শুধুমাত্র ফিল্ডিং দিয়েও বিখ্যাত হওয়া যায় এই কথা কি কেউ ভেবেছিলেন কখনো? উত্তরটা হয়তোবা, না।
ক্রিকেটে রেকর্ডতো কেবল ব্যাটে আর বলে। ব্যাট বলের খেলায় ব্যাটে বলে কীর্তি গড়তে না পারলে কে কাকে মনে রাখে! কিন্তু এইখানেই ব্যতিক্রম প্রোটিয়া কিংবদন্তি জন্টি রোডস। ক্রিকেটের সব সত্ত্বাকে ছাপিয়ে তিনি অখ্যাত ক্ষেত্রকে করেছেন বিখ্যাত, ক্রিকেটের আকাশের বুকে লিখে রেখে গেছেন তার উর্বার, দীপ্যমান ইতিহাস, ভুবনব্যাপিয়া তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন একজন গ্রেট ফিল্ডার হিসেবে। তাইতো আজো তাঁকে মনে করা হয় ক্রিকেটের আধুনিক ফিল্ডিংয়ের জনক হিসেবে।
বিশ্বসেরা হওয়ার কোন আপেক্ষিক সূত্র নেই, নেই কোন মানদণ্ডও। তাইতো সেরা ব্যাটসম্যান, বোলার কিংবা অলরাউন্ডার বাছাই করা নিয়ে বিতর্ক তাই জগতের একটি সহজ ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু একটা জায়গায় আপনাকে একমত হতেই হবে। যদি বিশ্বসেরা ফিল্ডারের প্রসঙ্গ আসে আর আপনি জন্টি রোডসের কথা না বলে তবে যে আপনার উত্তরটা অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।
পয়েন্ট, ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট কিংবা গালি অঞ্চলে দাঁড়িয়ে বাজপাখির মতো ক্ষিপ্ত গতিতে ঝাপিয়ে পড়ে তার একেকটা বল লুফে নেয়ার চিত্র যেন শুধু ক্রিকেটই নয়, জগতের সবচেয়ে সুন্দর, মায়াময়, মোহময় ও বর্ণিল ছবিগুলোর এক দৃশ্য। তার একেকটি ক্যাচ, একেকটি ডাইভ কিংবা ক্ষ্যাপাটে থ্রোতে স্ট্যাম্প ভাঙার দৃশ্য যেন চাইলেই ফ্রেমে বাধিয়ে রাখা যায়, উল্টেপাল্টে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়। চাইলে এগুলো নিয়ে লেখা হতে পারে ক্রিকেট জগতের একেকটি কাব্য, মহাকাব্য। তার মাথার উপর দিয়ে কিংবা দুপাশে শূণ্যে ভাসিয়ে বল পাঠানোর আগে বেশ কয়েকবার চিন্তা করতে হতো ব্যাটসম্যানদের। তার সামনে বল ফেলে দৌঁড়ে রান নেয়ার সাহস দেখিয়েছেন বিশ্ব ক্রিকেটে হাতে গোনা কয়েক জন।
এই মর্তে প্রতিনিয়ত শত সহস্র রেকর্ড তৈরি হয় ভাঙার জন্য। অনেক রেকর্ড ভাঙছে, ভাঙবে। অনেক তারকা, মহাতারকার আগমন ঘটবে। জন্টির আগে-পরে ফিল্ডিং দিয়ে অনেকেই প্রশংসা কুড়িয়েছেন। কিন্তু ফিল্ডিংয়ে জন্টি যেন নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায়। ফিল্ডিংয়ে জন্টি রোডস যেন এক শিল্পের নাম। বিশ্ব ক্রিকেটে দ্বিতীয় কোন জন্টির আগমন হয়তো ঘটবেনা কখনোই, হয়তোবা রেকর্ড বুকে জন্টির কীর্তি থেকে যাবে অনি:শেষ।
এতো গেলো কেবল ফিল্ডিং শৈলীর কথা। কিন্তু ব্যাটসম্যান হিসেবেও নেহায়েৎ মন্দ ছিলেন না জন্টি রোডস। দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে ১৯৯২ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত চারটি বিশ্বকাপে খেলা জন্টি ২৪৫ টি একদিনের ম্যাচ খেলে রান করেছেন ছয় হাজার ছুঁইছুঁই। সাদা পোশাকের ক্রিকেটে ৫২ ম্যাচ খেলে ব্যাট হাতে তুলেছেন আড়াই হাজার রান। ১৯৯৯ সালে ক্রিকেটের বাইবেল খ্যাত উইজডেন তাকে প্রদান করে বর্ষসেরা ক্রিকেটারের পুরস্কার।
দেড় যুগ হলো ক্রিকেট ছাড়লেও, জন্টি জড়িয়ে আছেন ক্রিকেটের সঙ্গেই। দক্ষিণ আফ্রিকা জাতীয় দলের ফিল্ডিং কোচের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কাজ করেছেন আইপিএলের দল মুম্বাই ইন্ডিয়ানস ও কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের হয়ে। এখন সুইডেন দলের কোচের ভূমিকায় আছেন। হয়তো, এখানেও গড়বেন নতুন কোনো কীর্তি।