সপ্তাহে মাত্র ২০ ইউরো পারিশ্রমিকে খেলতে থাকা এক কিশোর পৌঁছে গেছেন বিশ্ব নন্দিত, ফ্রান্স ফুটবল কর্তৃক আয়োজিত ব্যালন ডি’অর পুরস্কারের সেরা তিনে। ফুটবলার হিসেবে ব্যক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের এক মানদণ্ডে পরিণত হওয়া এই ব্যালন ডি’অরের আভিজাত্য এখন ছেলে-বুড়ো সকলেরই জানা।
ভাগ্য অন্বেষণে ব্রাজিল থেকে ইতালিতে পাড়ি জমানো খেলোয়াড় লড়েছেন তৎকালীন ফুটবলের জাদুকর লিওনেল মেসির সাথে। হয়েছেন তৃতীয়। নিশ্চয়ই বুঝে গিয়েছেন গল্পটা কার। হ্যাঁ! গল্পটা ইতালির জাতীয় দলের ফুটবলার জর্জিনহোর।
২০২০/২১ মৌসুমটা স্বপ্নের মতো কেটেছে তাঁর। প্রথমে ইতালির জার্সি গায়ে জিতলেন ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশীপ। তারপর ইংলিশ ক্লাব চেলসির হয়ে জিতেছেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। ব্যালন ডি’অরে তৃতীয় হবার আগে জিতেছেন ইউরোপিয়ান বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের খেতাব। কি এক অদ্ভুতরকম ভাললাগার বছর তাঁর জন্যে!
প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রেই পেয়েছেন সাফল্য। হোক সেটা ব্যক্তিগত কিংবা দলগত। তবে ঠিক কতখানি কাঠখড় পুড়িয়ে একজন জর্জিনহো হওয়া যায়, তা জানেন খোদ জর্জিনহো ও তাঁর সাবেক হেলাস ভেরোনা সতীর্থ রাফায়েল। মাত্র ১৫ বছর বয়সে জর্জিনহো এসেছিলেন ইতালিতে ব্রাজিলিয়ান এক ফুটবল ক্যাম্পে অবহেলার শিকার হওয়া ছোট্ট ছেলেটি।
বাবার দিকের পূর্বপুরুষদের কল্যাণে তিনি পেয়েছিলেন ইতালির নাগরিকত্ব। সেখানেও অবহেলার শিকার হতে হয়েছিল জর্জিনহোকে। তিনি তাঁর ক্লাব ভেনোরা থেকে কেবল মাত্র ২০ ইউরো পেতেন সপ্তাহের পারিশ্রমিক হিসেবে।
এটা ফুটবলার কিংবা একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেও অতি নগন্য। তাঁর সতীর্থ রাফায়েল জানতে পারেন জর্জিনহোর এমন দশা সম্পর্কে। তারপর রাফায়েল স্বপ্রণোদিত হয়ে ক্লাবকে জানান জর্জিনহোর বিষয়ে।
তখন জানা যায় ক্লাব ও জর্জিনহোর বোঝাপড়ায় দূরত্বের দেয়াল তুলে রেখেছিলেন জর্জিনহোর এজেন্ট। ভুল ভাঙ্গলো। ক্লাবের সাথে আনুষ্ঠানিক পদযাত্রা। সেখান থেকেই শুরু জর্জিনহোর আজকের অর্জনে ঠাসা জর্জিনহো হয়ে ওঠার। তারপর জর্জিনহো ইতালির শীর্ষস্থানিয় ক্লাব নাপোলির হয়ে খেললেন পাঁচ বছর। মিডফিল্ডার জর্জিনহো পাঁচ মৌসুমে ইতালিয়ান ক্লাবটির হয়ে মোট ১৬০ ম্যাচে অংশ নিয়ে করেছিলেন ছয় গোল।
কিন্তু গোল দিয়ে জর্জিনহোকে বিচার করা দুষ্কর এবং তা যুক্তিযুক্তও নয়। তিনি মিডফিল্ডের একজন ভার্সেটাইল খেলোয়াড়। যার রয়েছে অমানবিক কষ্ট করবার দক্ষতা। তাছাড়া সে নিজের মধ্যে খেলার পরিস্থিতি বুঝে প্রতিপক্ষের পরিকল্পনা দুমড়ে-মুচড়ে দেওয়ার ক্ষমতা ধারণ করেন। সাধারণত সেন্ট্রাল মিডফিল্ড পজিশনে খেলেই নিজের সেরাটা নিঙড়ে দিতে পারেন তিনি।
মাঠে পজিশন সম্পর্কে ধারণা, ট্যাকটিকাল বুদ্ধিমত্তা ও সার্বিক পরিস্থিতি পঠনের দারুণ দক্ষতায় তিনি একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবেও খেলতে সমানতালে পারদর্শী। তাছাড়া একজন প্লে-মেকার হিসেবেও তিনি কম যান না। তাঁর অভাবনীয় দূরদর্শী দৃষ্টি তাঁকে একজন ভাল মানের প্লে-মেকার হিসেবেও বিবেচনা করতে বাধ্য করে। সেই গুণের পাশাপাশি বলের দখল নিজের কাছে রাখা এবং ছুটে গেলে পুনঃরায় তা পুনঃরুদ্ধার করাতেও পটু জর্জিনহো।
নাপোলির হয়ে কোপা ইতালিয়া ও সুপারকোপা জেতা জর্জিনহোর ক্যারিয়ার আরো বেশি বিকশিত হওয়া শুরু করে ইতালিতে যোগ দেওয়ার পর থেকেই। তিনি ২০১৮/১৯ মৌসুমে যোগ দিয়েছিলেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব চেলসিতে। এখন পর্যন্ত চেলসির হয়ে ৪৪৮ ম্যাচ খেলেছেন। মাত্র চতুর্থ মৌসুমেই প্রায় সাড়ে চারশ ম্যাচে অংশ নেওয়াই প্রমাণ করে যে জর্জিনহো ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ একজন খেলোয়াড়। তিনি যুক্ত হওয়ার পর থেকে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের সেরা চারের মধ্যেই ছিল চেলসি।
চলতি মৌসুমে তো চেলসি রয়েছে রীতিমত অপ্রতিরোধ্য। এনগোলো কান্তে ও জর্জিনহোর মিড জুঁটি চেলসিকে রেখেছে দারুণ ছন্দে। গতবারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ী চেলসি এবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও রয়েছে নিজেদের সেরা ছন্দেই। সেখানেও গ্রুপ পর্বের শীর্ষস্থানে রয়েছে। এই মৌসুমে জর্জিনহো গোল পেয়েছেও চারটি ১৮ ম্যাচে।
সেই ২০ ইউরো পারশ্রমিক থেকে এখন বিশ্বের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার হবার যাত্রা মসৃণ ছিলনা। জীবনটা আসলেও মসৃণ নয়। তবে রাফায়েলের মত একজন সত্যিকারের বন্ধুদের সহযোগিতায় পথ চলতে হয় সুবিধা। বছর দশেক বড় রাফায়েল জর্জিনহোর বন্ধু বেশে ভাইয়ের মতো করে দিয়েছেন পথ নির্দেশনা। সঠিক নির্দেশনায় জর্জিনহোরা হারিয়ে যায় না সময়ের অতল গভীরে। বরং বনে যায় পৃথিবী বিখ্যাত।