রবার্তো ফিরমিনো, নম্র হাসির দামে কেনা

এটা দারিদ্র-পীড়িত একটি পাড়া। একটি দূষিত হ্রদ এবং গরিব বস্তির মাঝে এর অবস্থান । ২০ হাজার ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন এস্তাদিও রে পেলের থেকে আসা আওয়াজ শোনা যেত বাড়িতে বসে। সেই টানে বাড়ি থেকে প্রায়ই তিনি সেখানে চলে যেতেন। ফুটবল থেকে তিনি কখনোই দূরে ছিলেন না আর থাকতেও পারেননি।

ফিরোজা পানির দিকে নতজানু হয়ে থাকা দৈত্যাকার পাম গাছ। সূর্যের আলোয় ঝলমল করা বহুতলবিশিষ্ট হোটেল এবং সমুদ্র তীরের অভিজাত রেঁস্তোরা যেখানে বিক্রি হচ্ছে লবস্টার, সাথে দামী সব পানীয়। এই বর্ণনা শুনলে যে কেও বলবে আরে এতো ক্যারিবিয়ান দীপপুঞ্জের কোন জায়গা। কিন্তু না এটা হল ব্রাজিলের আলাগোয়াস রাজ্যের রাজধানী ম্যাসিও, যাকে লোকে ব্রাজিলের ক্যারিবিয়ান বলেও চেনে।

ব্রাজিলের অন্যান্য শহরের মত এখানকার উত্তর পূর্ব দিকটা অনুন্নত। পর্যটনের উপর নির্ভরশীল এই শহরের কিছুটা ভিতরে ঢুকলে জনমুখর ছবির মত সুন্দর শহরের অন্য এক চেহারা দেখতে পাওয়া যায়। এই ম্যাসিও ব্রাজিলের সবচেয়ে সহিংস এলাকা হিসেবে নিয়মিত সংবাদের শিরোনাম হয়। 

ঝুপড়ি বাড়িঘর, নোংরা জলপথ এবং আবর্জনার কার্পেটে মোড়ানো এই শহরের রাস্তায় ভীরু এক যুবক ব্রাজিল জাতীয়দলের উদ্দেশ্যে তার যাত্রা শুরু করে। যুবকের মুখে সর্বদা লেগে থাকতো এক গাল হাসি, আলাগোস থেকে অ্যানফিল্ডে এই হাসির ঝলক দেখা গেছে সবখানে। 

ট্রাপিচে দা বারাত। ১৯৯১ সালের দুই অক্টোবর এখানেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন রবার্তো ফিরমিনো বারবোসা ডি অলিভেরা। এটা দারিদ্র-পীড়িত একটি পাড়া। একটি দূষিত হ্রদ এবং গরিব বস্তির মাঝে এর অবস্থান । ২০ হাজার ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন এস্তাদিও রে পেলের থেকে আসা আওয়াজ শোনা যেত বাড়িতে বসে। সেই টানে বাড়ি থেকে প্রায়ই তিনি সেখানে চলে যেতেন। ফুটবল থেকে তিনি কখনই দূরে ছিলেন না আর থাকতেও পারেননি।

ট্র্যাপিচে সেই বাড়িটি সম্প্রতি সংস্কার করা হয়েছে এবং একটি হটডগের দোকানে রূপান্তরিত করা হয়েছে। তবে ফিরমিনোর পরিবার থাকাকালীন সময়ে ভবনের পেছনে থাকা দেয়ালটি এখনও বিদ্যমান। দেয়াল বেয়ে কেও যাতে উঠতে না পারে তার জন্য স্থাপিত স্পাইকগুলি এখনও সেখানে রয়েছে, যদিও তাতে মরিচা পরে গেছে, কিন্তু চোরদের দূরে রাখতে তা এখনও বেশ কার্যকর। তবে এই স্পাইকগুলি স্থাপনের পেছনে আরো একটি উদ্দেশ্য ছিল, একটি দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ যুবককে ঘরের ভিতরে রাখা।

ব্রুনো বারবোসা ডস সান্তোস ফিরমিনোর শৈশবের বন্ধু। বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, ফিরমিনো ছোট বেলা থেকেই ফুটবল পাগল ছিলেন, তবে সবসময় দাঙ্গা হাঙ্গামা লেগে থাকা এই জায়গায় ছেলেকে নিরাপদ রাখতে তার মা বদ্ধপরিকর ছিলেন।

ছেলে যেন বাইরে বেরিয়ে যেতে না পাড়ে সেজন্য  তিনি দেয়ালের এই স্পাইকগুলি স্থাপন করেন। কিন্তু রাস্তায় আমাদের বন্ধুদের সাথে খেলার জন্য সে দেয়াল টপকাতো, আর এভাবেই দেয়াল টপকানোর সময় একবার সে পড়ে যায় এবং তার হাঁটুতে সেলাই দিতে হয়। তার বন্ধু আরো বলেন, ‘সেলাইয়ের সেই দাগ এখনো তার হাঁটুতে আছে।’  

ফিরমিনোর অন্যান্য বন্ধুরাও জানান যে তাঁরা তাঁর বাড়ির ছাদে পাথর ছুঁড়ে মারতেন তাকে খেলার জন্য প্রলুব্ধ করতে। তারা আরো বলেন যে ব্রাজিলিয়ান এই ফুবলারের প্রথম ক্লাব ফ্লামেনগুইনহোর কোচ তার এই খুদে তারকা খেলোয়াড় যাতে বাড়ি থেকে সহজেই লুকিয়ে বেরিয়ে যেতে পারেন তার জন্য একটি মই স্থাপন করেছিলেন। ফিরমিনো যদিও তার চেয়ে বয়সে ছয় বছরের বড় খেলোয়াড়দের সাথে খেলতেন তবু তার খেলার মান ছিল সকলের চেয়ে এক ধাপ উপরে।   

আক্রমণভাগের এই খেলোয়াড়ের আরেক পুরানো বন্ধু ডেডিউ, যিনি এখনও ট্রাপিচে থাকেন – তাঁর কাছ থেকে জানা গেল, ফিরমিনোর মা তার ছেলে সম্পর্কে উদ্ধিগ্ন ছিলেন। তিনি আরো বলেন যে তার মা মনে করতো এলাকার পরিবেশের কারণে তার ছেলে বাড়ির বাইরে বের হলে খারাপ হয়ে যাবে, যদিও রবার্তো ফিরমিনোর মাথায় ফুটবল খেলা ছাড়া অন্য কোন চিন্তা কখনোই ছিল না।

তিনি আরো জানান, লিভারপুলের আক্রমণভাগের বর্তমান এই খেলোয়াড় শান্ত এবং ভীরু স্বভাবের ছিলেন, তার মুখে সবসময় হাসি লেগেই থাকতো। ফিরমিনো ছোটবেলা থেকেই ফুটবল পাগল ছিলেন, এমনকি যখন তার কাছে কোন ফুটবল ছিল না, তিনি একটি কমলা দিয়ে ফুটবল খেলতেন। তার স্বপ্ন ছিল একজন পেশাদার খেলোয়াড় হওয়ার, কিন্তু তারা যেখানে বাস করতো সেখান থেকে এই স্বপ্ন পূরণ করা অনেক কঠিন ছিল। কিন্তু বন্ধুর রাস্তা পার হয়ে এই ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার নিজের স্বপ্ন পূরণ করেছেন তাই তাকে নিয়ে তার বাল্যকালের বন্ধুরা গর্বিত, তারা মনে করে ফুটবল দুনিয়ায় পাওয়া সমস্ত সাফল্যের দাবিদার তিনি। 

ফিরমিনো বা তাঁর বাবা-মা মারিয়ানা সিসেরা এবং হোসে কর্ডেইরোকে চেনেন এমন কারও সাথে কথা বললেই একটি বিশেষ পর্তুগিজ শব্দ বারবার উঠে আসে ‘হুমিলডে’। শব্দটির অর্থ হল নম্রতা, যা এই পরিবারের দারিদ্র মোচনে বিশাল ভুমিকা পালন করেছে।

জোসে রাস্তায়  ঠাণ্ডা পানির বোতল বিক্রি করতেন। সাধারণত সঙ্গীত অনুষ্ঠান এবং ফুটবল ম্যাচের বাইরে একটি শীতল বাক্সে থাকা বোতলজাত পানি তিনি বিক্রি করতেন। এটি ছিল পরিবারের আয়ের একমাত্র উৎস এবং ফিরমিনো অর্থ সংগ্রহ করে, খুচরা পয়সা গ্রাহককে ফেরত দিয়ে বাবার ব্যবসায় সাহায্য করতেন। বাবা যখন পরিবারের ক্ষুধা মেটানোর জন্য সংগ্রাম করছিলেন, তখন ছেলে বিরাট বড় এক লক্ষ্যের প্রতি মশগুল।

ব্রুনো জানান, ফিরমিনো ছোটবেলা থেকেই ভাল মানুষ ছিল, সে অন্যদের কথা ভাবত। এখনো লিভারপুলের আক্রমণভাগের খেলোয়াড়ের সাথে যোগাযোগ রাখা তার এই বাল্য বন্ধু আরো বলেন যে মাঝে মাঝে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে তারা বার্তা আদান-প্রদান করতেন। ফিরমিনো তার বন্ধুর দাদীকে স্ট্রোক হওয়ার পরে একটি হুইলচেয়ার দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘ফিরমিনোর স্বপ্ন ছিল তার মা, বাবা এবং বোনকে এই ভয়ঙ্কর এলাকা থেকে বের করে আনবেন।’ 

ফিরমিনোর শৈশবের বাসস্থানের রাস্তার মাথায় গিয়ে ডানদিকে ঘুরে এক মিনিট হাঁটলে ময়লা এবং ফেলে দেওয়া বর্জ্য দিয়ে সারিবদ্ধ একটি কংক্রিটের ফাইভ এ-সাইড পিচ দেখা যায়। এখানেই ফিরমিনো তার ফুটবলীয় দক্ষতাকে শান দিয়েছেন। তার স্টেপওভার এবং বল নিয়ন্ত্রণ করার অনুশীলন করেছেন।

ডেডিউ জানান ফিরমিনো টিভিতে রোনালদিনহো গাউচো এবং রোনালদোকে দেখেছিলেন। তাদের মতো হতে চেয়েছিলেন, লিভারপুলের আক্রমণভাগের এই খেলোয়াড় রোনালদিনহোর ফুটবলীয় সামর্থ্যের কথা সবসময় বলতেন কিন্তু তার বন্ধুরা মনে করতেন ফিরমিনোরও এই সামর্থ্য ছিল। ছোটবেলা থেকেই তিনি সবসময় বাকিদের চেয়ে অনেক ভালো খেলতেন। ডেডিউ আরো বলেন যে ফিরমিনো বুদ্ধিমান ফুটবলার ছিলেন, তিনি এতো ভালো ড্রিবল করতেন যে বাকিরা বোকা বনে যেত।

এস্টাডুয়াল প্রফেসর টারসিসিও ডি জেসুস স্কুলের প্রবেশদ্বারের পাশেই ছোট একটি মাঠ রয়েছে যে স্কুলে ফিরমিনো সাত বছর বয়সে ভর্তি হয়েছিলেন। স্কুলটির প্রধান শিক্ষকের দরজায় একটি কথা লেখা আছে, ‘যা করা প্রয়োজন তা আগে শুরু কর, তারপর যা সম্ভব তা কর, এবং হঠাৎ করে দেখবে তুমি অসম্ভবকে সম্ভব করছো।’

আরি সান্তিয়াগো, একজন সাবেক প্রশাসনিক সহায়তা এজেন্ট, তাকে স্কুলটির ফুটবল দল শুরু করার কৃতিত্ব দেওয়া হয়, যদিও তিনি তার ছাত্রদেরকে বড় স্বপ্ন দেখার জন্য বলতেন কিন্তু তিনি কখনও কল্পনাও করেননি যে তার একজন ছাত্র ব্রাজিল জাতীয় দলের হয়ে ফুটবল খেলতে সক্ষম হবে।

 আরি সান্তিয়াগো জানান, একবার এক বছরের ছুটি কাটিয়ে স্কুলে ফিরে এসে তিনি জানতে পারেন যে তিনজন ছাত্র মারা গেছে। সে সময় অত্র এলাকাটা অনেক সহিংস ছিল এবং সেই মৃত্যু তাকে অনেক কষ্ট দেয়। তিনি ভেবেছিলেন যে তার স্কুলের এই শিশুদের এই সহিংসতা ছাড়াও অন্য কিছু দেখাতে হবে কারণ না হলে ভবিষ্যতে তারাও এতে জড়িয়ে যেতে পারে।

ফুটবল দলটি স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে ভাল আচরণের বিকাশই ঘটায় যারা ধরা পরবে বলে সকলে উদ্বিগ্ন ছিল। একই সাথে এটি সান্তিয়াগোকে স্কুলের সেরা খেলোয়াড় হিসাবে স্বীকৃত ১৪ বছর বয়সী প্রতিভাবান খেলোয়াড়টির সাথেও কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছিল। ফিরমিনো ইতিমধ্যেই শক্তিশালী আঞ্চলিক ক্লাব ডি রেগাটাস ব্রাসিলের (সিআরবি) যুব দলের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন তাই স্কুল দলের হয়ে প্রতিযোগিতামূলকভাবে ম্যাচ খেলার সুযোগ তার ছিল না। তবে তাকে দলটির সাথে প্রশিক্ষণ করার এবং প্রীতি ম্যাচে খেলার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। 

সান্তিয়াগো বলেন যে সে খুবই শান্ত ও ধিরস্থির স্বভাবের ছেলে ছিল। কিন্তু সবসময় বল তাঁর কাছে দিতে বলতো। সান্তিয়াগো বলেন, ‘বলগুলো শুধুমাত্র নির্দিষ্ট সময়ে বাচ্চাদের কাছে দেওয়া হত, কিন্তু ফিরমিনো মুখে হাসি নিয়ে তার হাত দিয়ে ইশারা করত বল তাকে দেওয়ার জন্য। কখনও কখনও দিয়েছি, কখনও দেইনি। আসলে, ফিরমিনোর হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে না বলা সান্তিয়াগোর জন্য অনেক কঠিন কাজ ছিল।’

স্থানীয় চ্যাম্পিয়নশিপের কোয়ার্টার-ফাইনালে স্কুলটি সিআরবির সম্মুখীন হয়। ফিরমিনোকে তখন তার শিক্ষক একটি ব্যাগ আনতে পরামর্শ দিয়েছিলেন যাতে সে তাদের বিরুদ্ধে যে গোলগুলি করবেন তা যেন তিনি বাড়িতে নিয়ে যেতে পারেন। ফিরমিনো তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন। ম্যাচে তিনি গোল করেন। দল জেতে ৮-০ গোলে। 

পরের দিন ব্রাজিলের আক্রমণভাগের এই খেলোয়াড় যখন আসেন তখন সান্তিয়াগো তার অফিসে ছিলেন, ফিরমিনো হাসতে হাসতে তার পাশ দিয়ে চলে যান কিছু না বলেই। ফিরমিনো একটু পর ফিরে এসে আরো বড় একটা হাসি দিলেন। আবার চলে গেলেন। সান্তিয়াগোর ভাষায়, হাসির মধ্য দিয়েই ব্রাজিলিয়ান আক্রমণভাগের এই খেলোয়াড় নিজেকে প্রকাশ করতেন। 

সেই বছরের শুরুর দিকে যখন ফিরমিনো সিআরবি-তে তার ট্রায়ালে অংশ নিয়েছিলেন, তখন তার মা তার সাথে এসেছিলেন, নিজের ছেলের ফুটবলীয় দক্ষতা নিয়ে প্রতিবেশীদের আস্থায় কৌতূহলী হয়েছিলেন তিনি। প্রতিবেশীরা বিশ্বাস করতো যে তার ছেলের ফুটবল দক্ষতা ট্রাপিচে থেকে পরিবারের উত্তরণের টিকিট হতে পারে। ক্লাবের যুব কোচ গুইলহার্মে ফারিয়াস মাত্র কয়েক মিনিট সময় নিয়েছিলেন জীর্ণ-শীর্ণ বুট পরা বাচ্চাটিকে যুবদলের চুক্তি দেওয়া হবে তা নিশ্চিত করতে।

গুইলহার্মে ফারিয়াসের বসার ঘরটি বিভিন্ন ট্রফি এবং তিনবারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জয়ী পেপে সহ সাবেক বহু খেলোয়াড়দের স্বাক্ষরিত জার্সিতে ভরপুর। তিনি জানান, তাৎক্ষণিকভাবে যা তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল তা হল ফিরমিনোর খেলার গুণমান, তিনি বলেন রবার্তো চুপচাপ ছিল কিন্তু যেভাবে সে বল মারল তা ছিল ব্যতিক্রমী। তিনি তাকে মাঠে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং তিনটি প্লের পর তাকে তিনি থামিয়ে দেন এবং বলেন, ‘তোমার কাগজপত্র রেডি করে নাও, তুমি আমাদের হয়ে খেলতে আসবে।’

ফিরমিনোর আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। কিন্তু ফারিয়াস এবং ক্লাবের দন্ত-চিকিৎসক মার্সেলাস পোর্টেলার সহায়তায়, ফিরমিনো দুই বছর ধরে ব্রাজিলের উত্তর-পূর্বে ভ্রমণ করেছেন একজন ডিপ লাইয়িং ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসাবে জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপ খেলেছেন, প্রায়ই ভবিষ্যতের রিয়াল সোসিয়েদাদের স্ট্রাইকার উইলিয়ান জোসের সাথে একই দলে খেলতেন তিনি।

এক পর্যায়ে, তিনি একটি জাতীয় টুর্নামেন্টের জন্য সাও পাওলোতে বাসে ১২০ ঘণ্টার রাউন্ড ট্রিপে যাত্রা করেন; তার পা ও পায়ের পাতা ফুলে যাচ্ছিলো কিন্তু তার উদ্যম কখনই কমেনি। ফারিয়াস আরও বলেন যে তিনি অনেক প্রতিভাবান ছেলেকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন কিন্তু কেউই ফিরমিনোর মতো এতোটা নিষ্ঠা দেখায়নি।

পোর্টেলা, যিনি পরবর্তীতে ফিরমিনোর উপদেষ্টা এবং এজেন্ট হয়েছিলেন, বলেন যে ব্রাজিলিয়ান আক্রমণভাগের এই খেলোয়াড় সবসময় ইতিবাচক এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। তিনি তার মতো অন্য খেলোয়াড়কে দেখেননি। তিনি বলেন যে তিনি বলতেন একদিন, এই ফিরমিনোকে ব্রাজিল দলে খেলবে সবাই তখন সবাই তাকে বলে যে তিনি পাগল হয়ে গেছেন। কিন্ত আজ সে সেখানে পৌঁছেছে এবং অনেকের মুখে তালা লেগে গেছে। 

ফিরমিনোর ১৬ তম জন্মদিনের কিছুদিন পরে, পোর্টেলা সিআরবি যুব কোচ টোনিনহো আলমেদাকে লুসিয়ানো ‘বিলু’ লোপেজের সাথে যোগাযোগ করান। লুসিয়ানো লোপেস আলাগোসের একজন মাঝ মাঠের খেলোয়াড় ছিলেন যিনি ব্রাজিলের দক্ষিণ-পূর্বে খেলে তার ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘটাচ্ছিলেন। আলমেদা তার কাছে থাকা মূল্যবান একটি হাইলাইট রিলের ডিভিডি পাঠিয়েছিলেন এবং বিলু ফিরমিনোর গতিশীলতা ও দক্ষতা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি সাও পাওলোতে একটি ট্রায়াল সংগঠিত করতে সাহায্য করেছিলেন, তৎকালীন রাজত্বকারী টপ-ফ্লাইট চ্যাম্পিয়ন, এবং সেইসাথে তার প্রাক্তন ক্লাব, ফিগুইরেন্সেও।

সাও পাওলোতে কাটানো দুই সপ্তাহে ফিরমিনো বলের দেখা পাননি বললেই চলে এবং ক্লাবটি তাকে কোনো চুক্তির প্রস্তাবও দেয়নি। তিনি হতাশাগ্রস্ত এবং অপ্রস্তুত অবস্থায় দক্ষিণে সান্তা ক্যাটারিনা রাজ্যে ভ্রমণ করেন। এই সময়, ফিগুইরেন্স কোচদের মধ্যে যদিও তার নীরবতার কারণে অনিশ্চয়তার প্রশ্ন উঠেছিল কিন্তু তিনি তার ফুটবলীয় দক্ষতা দিয়ে তার জবাব দেন।

তৎকালীন ফিগুইরেন্স অনূর্ধ্ব ১৭ দলের কোচ হেমারসন মারিয়া জানান, ২০০৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে ফিরমিনো রবার্তো ট্রায়ালের জন্য এসেছিলেন। সাধারণত ট্রায়ালগুলি সর্বাধিক এক মাসের জন্য হয়ে, তবে খেলোয়াড়ের উপর নির্ভর করে সময় কমানো হতে পারে যেমন দুই সপ্তাহ, ১০ দিন ইত্যাদি।

 ফিরমিনোর ট্রায়াল মাত্র ৩০ মিনিট স্থায়ী হয়েছিল কারণ তিনি ব্যতিক্রমী ছিলেন। তিনি কার্যত কোন ভুল করেননি, প্রচুর কারিগরি গুণমান দেখিয়েছেন এবং দুইটি গোল করেছিলেন বাইসাইকেল কিকের মাধ্যমে। এরপর সবাই তার সম্পর্কে কথা বলছিল এবং মারিয়া বুঝতে পেরেছিলেন যে তাদের হাতে খুব বিশেষ একজন খেলোয়াড় এসেছে।

মারিয়া অবিলম্বে মাঠে ফিরমিনোর অবস্থান পরিবর্তন করেন, তাকে আক্রমণভাগের কাছাকাছি নিয়ে যান। হোমসিক কিন্তু তার সুযোগের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করতে আগ্রহী এই তরুণ ফুটবলার ।সামাজিক যোগাযোগের সাইট অর্কুট এবং এমএসএন মেসেঞ্জারের মাধ্যমে ম্যাসিওতে থাকা বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রাখেন। তাদেরকে তিনি বলেন যে সফল না হয়ে তিনি ফিরবেন না। যদিও তার ভীরুতা উদ্বেগের বিষয় ছিল। মারিয়া দুই সপ্তাহ ধরে তাকে ‘আলবার্তো’ বলে ডাকেন। ফিরমিনো তাকে সংশোধনও করেননি। 

বিলু, যিনি ফিরমিনোর বিয়েতে বেস্ট ম্যানের দায়িত্ব পালন করেন, তিনি বলেন যে ফিরমিনোকে ফিগুইরেন্সে নিয়ে যাওয়ার পরপরই, আমি বেস কো-অর্ডিনেটরের কাছ থেকে একটি ডাক পেয়েছিলাম এবং তিনি জিজ্ঞেস করছিলেন যে সে বাক্শক্তিহীন কিনা, কারণ সে খুব শান্ত ছিল এবং কথা বলতো না। বিলু ফিরমিনোকে ডেকে বলেন যে তাকে কথা বলতে হবে, সতীর্থদের কাছে বল চাইতে হবে, ক্লাবের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। ফিরমিনো না বলে শুধু হেসেছিলেন।

যদিও তাঁর কণ্ঠ ছিল নিরব, তাঁকে ঘিরে উত্তেজনা বাড়ছিল। ২০০৯ সালে, ফিগুইরেন্স প্রথম দলের হয়ে খেলার অনেক আগেই, তাকে মার্সেইতে একটি ট্রায়ালের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ফ্রান্সের দক্ষিণে তার এই যাত্রায় স্পেনে একটি যাত্রা বিরতি নিয়ে যেতে হয় এবং এখানেই সবকিছু দ্রুত বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। যদিও ফিরমিনো শুধুমাত্র ফ্লাইট পরিবর্তন করছিলেন। মাদ্রিদ-বরাজাস বিমানবন্দরের অভিবাসন তাকে পূর্বপ্রস্তুত কাগজপত্র ছাড়াই দেশে প্রবেশ করার চেষ্টা করার জন্য অভিযুক্ত করে এবং তাকে নির্বাসিত করা হয়। এতে কান্নায় ভেঙ্গে পরেন তিনি।

ব্রাজিলে ফেরত আসার পর মারিয়ার তার সাথে দেখা করেন এবং ১৭ বছর বয়সীর মনোবল চাঙ্গা করতে তিনি তাকে স্মরণ করিয়ে দেন, যে কাফু তার ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে ব্রাজিলকে বিশ্বকাপের গৌরব অর্জন করার অনেক আগেই একই রকম হতাশার সম্মুখীন হয়েছিল।  

এক মাস পরে, তিনি আবার মার্সেই ভ্রমণ করেন ।এবার সরাসরি ফ্লাইটে কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফরাসি ক্লাবটি তার ১ মিলিয়ন ইউরো রিলিজ ক্লজ প্রদানের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেয়। মার্সেইয়ের প্রাক্তন কর্মী প্রধান জিন-ফিলিপ ডুরান্ড ২০১৮ সালে বলেন যে এরপর ফিরমিনো যা অর্জন করেছেন তার পরিপ্রেক্ষিতে, এটিকে তাদের পক্ষ থেকে নেওয়া একটি ভুল সিধান্ত মনে করেন তিনি।

ফিরমিনোর ১৮ তম জন্মদিনের তিন সপ্তাহ পর, তিনি ফিগুইরেন্সের ১৬ নম্বর জার্সি পরিধান করে নিজের অভিষেক ম্যাচটি খেলেন। তের মাস পর, নিজ ক্লাবকে শীর্ষ পর্যায়ে পদোন্নতি জিততে সাহায্য করার জন্য ব্রাজিলিয়ান সিরি ‘বি’র সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল খেলোয়াড় হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি। ২০১০ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে, আর্সেনাল এবং পিএসভি আইন্দহোভেনের স্কাউটদের নজর কাড়া সত্ত্বেও, ৪ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে জার্মান ক্লাব হফেনহেইমের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন তিনি।

সান্তা ক্যাটারিনার সম্পূর্ণ বিপরীত ধাঁচের আবহাওয়া দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানির বরফের মধ্যে মানিয়ে নেওয়া তার জন্য একটি চ্যালেঞ্জ ছিল, কিন্তু তার কোচরা সবসময় বলেছিল, ফিরমিনোর কঠোর পরিশ্রম তাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে। কয়েক বছর মানিয়ে নেওয়ার পর, তিনি বুন্দেসলিগার ব্রেকথ্রু প্লেয়ার অফ দ্য সিজন নির্বাচিত হন।  

২০১৫ সালের গ্রীষ্মকালীন দলবদলের বাজারে লিভারপুল তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এবং ম্যানচেস্টার সিটি কে পরাজিত করে তৎকালীন ২৯ মিলিয়ন পাউন্ডে তাকে দলে ভেড়ায়। হফেনহেইমের ফুটবল ডিরেক্টর আলেকজান্ডার রোজেন ২০১৮ সালে ওয়ার্ল্ড সকারকে বলেছিলেন যে ফিরমিনোর প্রস্থান তাদের এক চোখ হাসিয়েছে এবং অন্যটিকে অশ্রুসিক্ত করেছে।

লিভারপুলে যোগদানের পর থেকে ফিরমিনোর ক্যারিয়ারের গতিপথ কেবল শক্ত হয়েছে। তিনি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, কোপা আমেরিক, এফএ কাপ, প্রিমিয়ার লিগ সহ আর অনেক শিরোপা জিতেছেন। প্রথম ব্রাজিলিয়ান হিসেবে ইংলিশ টপ ফ্লাইটে ৫০ গোল করেন তিনি। ক্লাব বিশ্বকাপের ফাইনালে তার করা গোলে লিভারপুল দক্ষিণ আমেরিকান চ্যাম্পিয়ন ফ্ল্যামেঙ্গোকে হারায়।

ফিরমিনো তার ক্যারিয়ার শুরুর বছরগুলিতে অন্যের উদারতা থেকে উপকৃত হয়েছিলেন তা তিনি মনে রেখেছেন সবসময়, ভুলে যাননি নিজের শিকড়কে। জুলাই ২০১৮ তে আলাগোস থেকে মাত্র তৃতীয় পুরুষ ফুটবলার হিসেবে বিশ্বকাপে খেলার জন্য নির্বাচিত হওয়ার কিছুক্ষণ পরে, তিনি ট্রাপিচে তার প্রাক্তন স্কুলে ফিরে আসেন, স্থানীয় পরিবারের জন্য ৫০০ ঝুড়ি খাবার, সেইসাথে খেলনা এবং শিশুদের জন্য একটি ট্রামপোলিন নিয়ে যান। 

এটি একটি পরিবারের চিকিৎসা বিল পরিশোধের জন্য ৬০০০০ পাউন্ড দান করা হোক কিংবা সান্তা ক্যাটারিনার একটি হাসপাতালে মাসিক আর্থিক অনুদান দেওয়া হোক বা তার প্রিয় ম্যাসিও রেস্তোরাঁয় ২০০ জন অপরিচিত লোকের জন্য এক রাউন্ড পানীয় কেনা হোক, তাকে যারাই চেনে সবাই তার সম্পর্কে বলতে গেলে বড় হৃদয়ের ব্যাপারে উল্লেখ করে। 

তবুও এটা অনুভুত হয় যে ফিরমিনো তার জন্মভূমিতে পুরোপুরি প্রশংসা পাননি। তার বন্ধুরা এবং প্রাক্তন কোচরা এর কারণ হিসেবে বলেন তিনি কখনও সাও পাওলো বা রিও ডি জেনিরোর মত ঐতিহ্যবাহী পাওয়ার হাউসগুলির একটিতে খেলেননি। এমনকি এস্তাদিও রে পেলের মিউজিয়াম অফ স্পোর্টস-এ, আলাগোয়ান নায়ক মারিও জাগালো এবং দিদার ব্রোঞ্জ মূর্তিগুলির মধ্যে, সেই সুপারস্টারকে স্মরণ করার মতো কিছুই নেই ,যিনি আক্ষরিক অর্থেই এই রাস্তার পাশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।  

এই ধরনের অনুভূতি অবশ্য ম্যাসিওর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এখানে, দৈত্যাকার পাম গাছ এবং উঁচু হোটেলের মধ্যেই হোক বা দূষণ এবং প্লাস্টিক বর্জ্যেই হোক, ফিরমিনো তাদের নম্র, অনির্বাচিত নায়ক হিসেবেই রয়ে গেছেন।

পন্টা ভার্দে সমুদ্র সৈকতের কাছে বিশ্রাম নিতে থাকা একজন মোবাইল ফোন টেকনিশিয়ান সার্জিও আরাউজোর বিবিসিকে বলেন যে রবার্তো এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড়,৷ সে কখনোই বলবে না, তবে আমি বলব নেইমার তার বুটে ফিট দেওয়ার জন্য উপযুক্ত নয়। তার এই বক্তব্যই বলে দেয় এখানকার মানুষের কাছে ফিরমিনো নামের কি অর্থ! 

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...