ডেড বলের প্রাণ সঞ্চারক

রিয়ালের কোনো একটা ম্যাচে ওজিলের একটা টার্নের পর ধারাভাষ্যকার বলে উঠলেন, ওজিল জাস্ট ডিড এ ক্রুইফ টার্ন। কথাটা আসলে ভুল কারণ টার্নটা ওজিলই করেছে, আবার ঠিকও – কারণ এটা এমন একটা গিফট যেটা ক্রুইফ আমাদের দিয়েছে এবং কাজটা অনেকেই প্রায় কাছাকাছি করে থাকতে পারেন, কিন্তু সেটার প্যাটেন্ট শুধুমাত্র একজন জিনিয়াসের হাতেই থাকতে পারে। একই রকম ভাবে পানেনকা পেনাল্টির প্যাটেন্টও ওই একজনের কাছেই আছে– এরপর সেভাবে যত জনই গোল করুক না কেন।

জুনিনহো পার্নাম্বুকানো এরকম একজন, পার্থক্য একটাই – ওর ফ্রি কিক কপি করা এতটাই কঠিন যেটা অনেক চেষ্টা করেও নকল করা সম্ভব হয় না।

ক্রুইফ কিংবা পানেনকা ফুটবলে যোগ করেছিল নতুন কিছু, জুনিনহোর ফ্রি কিক ফুটবলকে আরো গভীরভাবে পাল্টে ফেলতে সক্ষম হয়। বলা ভাল, পাল্টে যায় খোদ ফুটবলই। এটা নিশ্চিত, জুনিনহো যেভাবে গোলরক্ষকদের বার বার বোকা বানাতেন, তাতে বল প্রস্তুতকারী কোম্পানি বলে অতিরিক্ত পরিবর্তন আনত যাতে বল বাতাসে থাকা অবস্থায় অনিয়মিত বাঁক নেয়, আর মাঠের খেলায় আরও বেশি গোল দেখা যায়।

অলিম্পিক লিঁওর হয়ে তাঁর ১০০ গোলের ৪৪ টিই ছিল ফ্রি কিক থেকে এবং দলের অন্যান্য অনেক গোলের উৎসই ছিল ওর ফ্রি কিক। প্রতিপক্ষ দলের খেলোয়াড়রা লিঁও’র কাউকে ‘জুনিনহোর ফ্রি কিক টেরিটরি’-তে ফাউল করতে ভয় পেত যেটা লিঁওকে স্বাচ্ছন্দ্যে খেলতে দিত।

জুনিনহোর ফ্রিকিকের রেঞ্জ এবং টেকনিক এর পর্যায় ছিল এমন যেটার কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নাই বললেও চলে। সে ২৫ মিটার দূর থেকে যেমন নিচু শটে গোলে বল আঁচড়ে ফেলতে পারত,তেমনি কার্ল করে বলে জালে জড়াতে পারত খুব কম দুরত্বের ফ্রি-কিক থেকে।

একই ম্যাচে করা আরেকটা গোল আছে আরো দূর থেকে – কিক নিলেন কিছুটা বিভ্রান্তিকর রান আপ নিয়ে এবং বলটা ফেললেন গোলকিপারের একটু সামনে যেটা যথেষ্ট ছিল গোলিকে বোকা বানাতে । তবে এর চেয়েও যাদুকরী এবং বার বার দেখার মত গোল আছে – যেমন আছে বার্সেলোনার বিপক্ষে ২০০৯ এ করা একটা গোল । সূক্ষ্ম কোণ থেকে প্রায় ২৫ মিটার দূর হতে নেয়া কিকের পর বলটি বাতাসে ভাসতে থাকে এমনভাবে, মনে হচ্ছিল কচুর পাতার পানির মত বলটা টলমল করছে – একটু নাড়া দিলেই ওদিকে সরে যাবে। বলটা পৃথিবীর কোন গোলিরই আয়ত্বের মধ্যে ছিল না।

২০০৫ সালে ওয়েডার ব্রেমেনের বিপক্ষে করা গোলটা ছিল যেন অন্য গ্রহ থেকে আগত কোন রকেট। সিদানের বিপক্ষে ৩৭ মিটার দূর থেকে করা গোলটা যে কাউকেই সম্মোহিত করে ফেলতে পারে কিছুক্ষনের জন্য – যেটাতে বল ডিফেন্স দেয়ালের উপর দিয়ে উড়তে থাকে, এরপর হঠাৎ ভয়ংকরভাবে নিচের দিকে নামতে থাকে যেটা পরে ‘নাকেলবল’ নামে পরিচিতি পায়।

২০০৬ এ আজাচিও এর বিপক্ষে করা গোলটা ছিল আরও দূর থেকে – মাঝ মাঠের একটু সামনে । অবাস্তব একটা গোল। বাতাসে থাকা অবস্থায় বলটা গতি আর্জন করছিল – গোলরক্ষক ঠিক জায়গা বরাবর ছিল যেটা তাকে সত্যিকার অর্থে দিগভ্রান্ত করে– এরপর বল হঠাত দিক পরিবর্তন করে এবং গোলরক্ষক ভাল করে বুঝে ওঠার আগেই যা ক্ষতি হবার হয়ে যায়। অনেকটা আপনাকে সম্মহিত করে আপনার চোখের সামনেই আপনার মানিব্যাগ হাতিয়ে নেয়ার মত ব্যাপার।

জুনিনহোর ফ্রি কিকের সিক্রেট বের করার ঘোরে এত বেশী আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম যে প্রতিটা সচেতন চিন্তাতেই ব্যাপারটা মাথায় ঘুরত আমার।’ – ইতালির আন্দ্রে পিরলো তার আত্মজীবনী ‘আই থিঙ্ক, দেয়ারফোর আই প্লে’-তে কথাটা বলেন। তিসি আরও বলেন, ‘লিঁওতে থাকতে ও ছিল অসাধারণ। সে বলটা মাটিতে রাখত, তারপর অদ্ভুতভাবে শরীরটাকে টুইস্ট করত , রানাআপ নিত – তারপর গোল করত। ও কখনোই ভুল ছিল না, কখনোই না। আমি ওর পরিসংখ্যান দেখেছি। ও ছিল অর্কেস্ট্রার কন্ডাকটর যে কিনা পায়ের বাটনে (হাতের না) তার কাজ করে যেত। আমি একাগ্রতার সাথে তাকে নিয়ে পড়াশোনা করেছি , ডিভিডি সংগ্রহ করেছি, এমনকি তার খেলা ম্যাচগুলার ছবি যোগাড় করেছি।’

পিরলো বিশ্বাস করেন যে, তিনি রহস্য উদ্ঘাটন করেছেন, ‘ব্যাপারটা সে (জুনিনহো) কিভাবে বলে আঘাত করে – তার উপর নির্ভরশীল, কোথা থেকে কিক নিচ্ছেন তার উপর না; তার পায়ের পাতার শুধুমাত্র তিনটা পয়েন্ট বলের কনটাক্টে আসত – পুরা পা না যেমনটা সবাই আশা করে। (কিকের সময়) পা যতটুক সম্ভব সোজা রাখতে হবে এবং এরপর ছেড়ে দিতে হবে (বাতাসে) মারাত্মকভাবে মাটিতে পড়ার জন্য। এভাবে শট নিলে বল বাতাসে ঘোরে না, কিন্তু যখনই সেটা জাস্ট ঘুরতে শুরু করে তখন দ্রুত বেগে গোলের দিকে পড়তে থাকে। যখন এটা গোলির এক্সপেক্টেশনের পথ থেকে সরে যায় তখনে সেটাকে থামানো আর সম্ভব হয় না। আমার লাইফের সেরা ফিলিংটা আসে যখন দেখি বলটা ডিফেন্ডারদের মাথার উপর দিয়ে কয়েক সেকেন্ড ভাসার পর জালের মধ্যে গিয়ে পড়ে। তারা বলটা প্রায় ছুঁতে সক্ষম – কিন্তু পুরোপুরি না। তারা বলের নাম পড়তে পারে – কিন্তু সেটাকে থামাতে পারে না।’

জুনিনহোর পরিসংখ্যান ঘেটে তার সেরা ফ্রি-কিক গোলটা বের করাটা কঠিন – কারণ ফ্রি কিকে কমপক্ষে ৭৫টা গোল করেছেন ক্লাব এবং দেশের হয়ে। প্রতিটা গোলেরই নিজস্ব সৌন্দর্য আছে – অনেকগুলো আবার করেছেন গুরুত্বপুর্ণ ম্যাচে – গুরুত্বপুর্ণ সময়ে। সেটা মাথায় রেখে – জুনিনহোর নিজেরও ব্যাক্তিগত ফেবারিট ২০০৩-০৪ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ গ্রুপ পর্যায়ে বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে এলিয়েঞ্জ অ্যারেনাতে করা ফ্রি-কিক মাস্টারপিস।

এই গোলটাকেই তার সেরা গোল হিসেবে ধরা হয় । কারণ গোলটা ছিল শক্তিশালী দলের বিপক্ষে, যেটা আবার ২-১ এর জয় এনে দেয় দলকে। আরেকটা সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর হচ্ছে – গোলপোস্টের নিচে ছিলেন ইতিহাস সেরা গোলকিপার গ্রেট অলিভার কান যাকে কিনা গোলপোস্টের উপর আঁচড়ে ফেলে ৩৫ মিটার দূর থেকে জুনিনহোর করা লফটেড কার্লারকে আঁটকাতে যাওয়ার কারণে যেটা শেষ পর্যন্ত রাইট টপ কর্ণারের বারে আঘাত করে ভেতরে প্রবেশ করে।

গোলটাকে সেরা বলার আরেকটা কারনও যোগ করা যেতে পারে। জুনিনহো যখন বলটা বাতাসে ছেড়ে দেন তখন গোলের পেছনে থাকা একটা বলবয় বলটা ধরার উদ্দেশ্যে বলের পথ ধরে তার বাম দিকে সরে যাচ্ছিল, কারণ সে হয়ত ভাবছিল বলটা বার মিস করবে কিন্তু তাকে থেমে যেতে হয় কারণ বলটা বারে আঘাত করে জালে প্রবেশ করছিল।

‘ইট ওয়াজ ফানি’, বলেন খোদ জুনিনহো, একজন শিল্পি যিনি ডেড বলে প্রাণ সঞ্চার করেছেন অতুলনীয় উপায়ে, অতুলনীয় বার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link