‘বাচ্চা বাচ্চা ফ্লেভার’ওয়ালা

২০০৩-এ সিডনিতে সিরিজের চতুর্থ টেস্টের এক গভীর সন্ধিক্ষণে ১৮ ছুঁই ছুঁই ভারতের উইকেটরক্ষক অস্ট্রেলিয়ার সেট হয়ে যাওয়া ব্যাটসম্যান স্টিভ ওয়াহকে বলে বসেন, ‘পারলে পরের বলটাতে সুইপ মেরে দেখান তো। আমি নিশ্চিত, আপনি ওটা মিস করবেন।’ স্টিভের জবাবটা ক্রিকেটের ইতিহাসে ঢুকে গেছে, ‘বড়দের সম্মান করতে শেখ। আমি যখন প্রথম টেস্ট খেলি, তুমি তখন ডায়াপার পরতে।’ওখানেই থেমে গিয়েছিল ঘটনাটা। কিন্তু স্টিভকেও ওইটুকুতেই কিছুটা হলেও উত্তেজিত করে দিয়েছিলেন ঐ ভারতীয় খেলোয়াড়, ‘বাচ্চা-বাচ্চা ফ্লেভার’টা যার মধ্যে ছিল তখন, স্বাভাবিকভাবেই।

১৮ জানুয়ারি ২০০৪, ব্রিসবেনে ওয়ানডে ম্যাচ, ত্রিদেশীয় ভিবি সিরিজে। লক্ষ্মণ (অপরাজিত ১০৩), শচীন টেন্ডুলকার (৮৬) আর রাহুল দ্রাবিড়ের (৭৪) কল্যাণে অস্ট্রেলিয়াকে ৩০৪-এর টার্গেট দিয়েছিল ভারত সেদিন।

উত্তরে ম্যাথু হেইডেন কড়া জবাব দিতে শুরু করলেন, কিন্তু তাঁকে যোগ্য সঙ্গ দিতে পারছিলেন না কেউ। ১৪১/৪ হয়ে কোণঠাসা অস্ট্রেলিয়া মরিয়া হয়ে ঘুরে দাঁড়ালো হেইডেন আর ক্লার্কের জুটিতে। কিন্তু ২০৪/৫ হয়ে গেল তারা (পরে ২৮৪ আলআউট হয়ে ১৯ রানে হারে অস্ট্রেলিয়া), যখন হেইডেন ১০৯ রান করে ইরফানের বলে উইকেটরক্ষক রাহুলের হাতে ধরা পড়ে প্যাভিলিয়নে ফিরলেন।

তারপরেই ড্রিঙ্কস হলো। ড্রিঙ্কস নিয়ে ঢুকছিলেন তখনো ১৯ বছরের বয়স না ছোঁয়া ভারতের দ্বাদশ ব্যক্তি। প্যাভিলিয়নের সিঁড়িতে ক্রসিং হলো দুজনের। ক্রসিংয়ের সময় ‘হুস হুস’জাতীয় একটা শব্দে হেইডেনকে স্লেজ করলেন ভারতের দ্বাদশ ব্যক্তি, খুব নিচু স্বরে। তাতেই চরম ক্ষিপ্ত হেইডেন বলে উঠলেন, ‘আর একবার এটা বললে আমি তোমার মুখে ঘুঁষি মারব।’

ভারতের দ্বাদশ ব্যক্তি উত্তরে বললেন ‘দুঃখিত’ এবং দাঁড়িয়ে রইলেন সিঁড়িতে আর হেইডেন আস্তে আস্তে চলে গেলেন সেখান থেকে, প্যাভিলিয়নের ভিতরে। হেইডেনকে কিন্তু ওইটুকুতেই উত্তেজিত করে দিয়েছিলেন ওই ‘বাচ্চা-বাচ্চা ফ্লেভার’ওয়ালা ভারতীয় খেলোয়াড়।

এর আগে ২০০৩-এ সিডনিতে সিরিজের চতুর্থ টেস্টের এক গভীর সন্ধিক্ষণে ১৮ ছুঁই ছুঁই ভারতের উইকেটরক্ষক অস্ট্রেলিয়ার সেট হয়ে যাওয়া ব্যাটসম্যান স্টিভ ওয়াহকে বলে বসেন, ‘পারলে পরের বলটাতে সুইপ মেরে দেখান তো। আমি নিশ্চিত, আপনি ওটা মিস করবেন।’

স্টিভের জবাবটা ক্রিকেটের ইতিহাসে ঢুকে গেছে, ‘বড়দের সম্মান করতে শেখ। আমি যখন প্রথম টেস্ট খেলি, তুমি তখন ডায়াপার পরতে।’ওখানেই থেমে গিয়েছিল ঘটনাটা। কিন্তু স্টিভকেও ওইটুকুতেই কিছুটা হলেও উত্তেজিত করে দিয়েছিলেন ঐ ভারতীয় খেলোয়াড়, ‘বাচ্চা-বাচ্চা ফ্লেভার’টা যার মধ্যে ছিল তখন, স্বাভাবিকভাবেই।

দুটো ঘটনাই পরে নিজের মুখে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন ওই ভারতীয় খেলোয়াড়,  যার নাম পার্থিব প্যাটেল। আজ ভারতের উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান পার্থিব প্যাটেলের অবসরের দিনে কোথাও যেন মনে হয়, ভাগ্যের হাতে মার (২০০৪ সালে ধোনির মানের উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান এসে যাওয়া) এবং চোট আঘাত ছাড়াও এই ‘বাচ্চা-বাচ্চা ফ্লেভার’টা হয়ত কিছুটা দায়ী ছিল, তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ার যোগ্যতা অনুযায়ী অনেক আগেই থেমে যাবার জন্য।

১৬ বছরে (২০০২-২০১৮) ২৫ টি টেস্টে ছয়টি পঞ্চাশোর্ধ্ব-সহ ৯৩৪ রান, ৬২ ক্যাচ, ১০ স্টাম্প আউট আর ৯ বছরে (২০০৩-২০১২) ৩৮ টি ওয়ানডেতে চারটি পঞ্চাশোর্ধ্ব-সহ ৭৩৬ রান, ৩০ ক্যাচ, ৯ স্টাম্প আউট এবং ২০১১ সালে ২টি টি-টোয়েন্টিতে ৩৬ রান, একটি ক্যাচে বেঁধে ফেলার মত সংক্ষিপ্ত ছিল না তাঁর প্রতিভা।

১৭ বছর ১৫৩ দিন বয়সের মাথায় টেস্টের মাধ্যমে তার আন্তর্জাতিক অভিষেক ছিল ভারতের সর্বকনিষ্ঠ উইকেটরক্ষকের অভিষেকের রেকর্ড। ২০০২, ২০০৩ এবং ২০০৪-তে চমকপ্রদ পারফরমেন্স তাঁকে ভারতীয় দলে অপ্রতিদ্বন্দী করে তোলে, যদিও ২০০৩ বিশ্বকাপে ফাইনাল একাদশে তিনি ছিলেন না, রাহুল মেকশিফ্ট উইকেটরক্ষক হয়ে যাওয়ায়।

উইকেটরক্ষকের থেকেও তিনি বেশি করে ছিলেন ব্যাটসম্যান। উইকেটরক্ষণের মান নামতে থাকলে তিনি আঁকড়ে ধরেন উন্নততর ব্যাটিংয়ের সম্ভাবনাকে। কিন্তু ধোনি আর দীনেশ, দু’দুজন উইকেটরক্ষক মঞ্চে এসে গেছেন ততক্ষণে। ২০০৪ সালের পর থেকেই ক্রমশ ফিকে হয়ে যেতে থাকেন পার্থিব প্যাটেল।

কিন্তু অধ্যবসায় আর অনুশীলন, এই দুই ‘অ’তাকে ২০০৮ সালে শ্রীলঙ্কার  অ্যাওয়ে সিরিজে তাঁকে দলে ফিরিয়ে আনে। একটিই টেস্ট খেলেন, তৃতীয় টেস্টে। রান করেন ১৩ আর ১, নেন দু’টি ক্যাচ আর করেন একটি স্ট্যাম্প। ওয়ানডেতে দলে ঢোকেন আর বেরিয়ে যান বারংবার, ২০১২ সালে অবসর নেওয়া অবধি। দু’টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেন ২০১১-তে, ওয়েস্ট ইন্ডিজে।

২০১৬ সালে আবার ফেরেন টেস্ট উইকেটরক্ষক হিসেবে মোহালিতে, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে (ততদিনে ২০১৪-তে ধোনি টেস্টে অবসর নিয়েছেন আর ঋদ্ধিমান সাহা এসে গেছেন প্রবলভাবে) এবং করেন ৪২ ও ৬৭ রান, ধরেন চারটি ক্যাচ, করেন একটি স্ট্যাম্প এবং ভারত জেতে। আর তিনি আবার বাদ যান, যেহেতু ঋদ্ধিমান সুস্থ হয়ে টিমে ফেরেন।

২০১৮ সালের জানুয়ারিতে তিনি শেষ টেস্ট খেলেন জোহানেসবার্গে এবং ভারত জেতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে। ২ ও ১৬ রানের পাশে ওই টেস্টে তিনি পাঁচটি ক্যাচও নিয়েছিলেন। তার আগের টেস্টেও খেলেছিলেন সেঞ্চুরিয়নে, করেন ১৯ ও ১৯ রান, ধরেন পাঁচটি ক্যাচ এবং ভারত হারে।

আজ অবসর নিলেন তিনি। সৌরভ-শচীন-রাহুল-শেবাগ-লক্ষ্ণণ-যুবরাজ-কাইফ-জহিরদের হাত ধরে ভারতীয় ক্রিকেটের ঘুরে দাঁড়াবার সময়টায় তাদের অংকে খাপে খাপে ফিট হয়ে যাওয়া ১৭-১৮’র তরুণ পার্থিব প্যাটেলকে খুব সহজে ভুলতে পারবে না ভারতীয় ক্রিকেট, যার ক্রিকেট জীবনে একটাও বিশ্বকাপ ম্যাচ না খেলার আফসোসটা রয়েই গেল চিরস্থায়ী হয়ে।

দ্বিতীয় ইনিংসে ভাল থাকুন ‘বাচ্চা’ ডাকনামের পার্থিব প্যাটেল, স্ত্রী অবনী আর একমাত্র মেয়ে ভেনিকা ও পরিবারের অন্যদের সঙ্গে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...