৯ বছর বয়সী এক ক্ষুদে বালক। নর্দান ডিস্ট্রিকসের হয়ে উইকেট কিপিং করছিলেন। উচ্চতা আর গায়ের গড়ন বেশ নজর কাড়া। একদিন কোচ তাঁকে ডেকে বললেন, ‘উইকেট রক্ষক হিসেবে নিজের ক্যারিয়ার না গড়ে তুমি পেস বোলার হও। এটা তোমার জন্যই মঙ্গলজনক হবে। তুমি পেসার হিসেবে বেশ ভাল করতে পারবে।’
কোচের কথা সাদরে গ্রহন করলেন সেই বালক। এরপর গ্লাভস ছেড়ে নেমে পড়লেন বল হাতে। একই ম্যাচে উইকেট কিপিং ও বোলিং করলেন! এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। বাঁ-হাতে বল তালুবন্দি করে বুলেট ট্রেনের মত ছুঁটেছেন প্রতিপক্ষের ব্যাটারের দিকে। অগ্নিঝরা পেস আর ইয়র্কারে বনে গেছেন বিশ্ব সেরাদের একজন।
গ্লাভস ছেড়ে বল হাতে অদম্য গতিতে ছুঁটতে থাকা সেই বালকটি বর্তমান ক্রিকেটের গতির রাজা মিশেল স্টার্ক।
উইকেটের পেছনে গ্লাভস হাতে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ছোট বালকটি এখন ২২ গজ মাতাচ্ছেন নিজের পেস দাপটে। ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন বেরালা স্পোর্টস ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে। সেখান থেকে স্কুল ক্রিকেটে প্রথম গ্রেডের দলে খেলেছেন তিনি। এরপর যান নর্দান ডিস্ট্রিক্ট ক্রিকেটে। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই ১৩৫ কি.মি ঘন্টায় বল করতে পারতেন স্টার্ক। এরপর মাত্র তিন বছরের মাথায় সুযোগ পেয়ে যান প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে।
২০০৯ সালে ১৯ বছর বয়সে নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক। ঘরোয়া ক্রিকেটে একজন বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছিলেন তিনি। একই বছর লিস্ট এ ক্রিকেটে ও টি-টোয়েন্টিতে অভিষিক্ত হন তিনি। সেখানে বল হাতে গতির ঝড় তুলে বছর খানেকের মাথায় ডাক পান জাতীয় দলে।
এরপর ২০১০ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডেতে অভিষিক্ত হন তিনি। ওই সিরিজে জশ হ্যাজেলউড ও ডগ বলিঞ্জারের ইনজুরিতে টেস্টে ডাক পেলেও স্টার্কের জায়গায় পিটার জর্জকে সুযোগ দেওয়া হয়। অবশ্য পরের বছর ২০১১ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন তিনি।
ক্যারিয়ারের প্রথম বছর দুয়েক দলে আসা যাওয়ার মধ্যে থাকলেও ধীরে ধীরে নজর কাড়া পারফরম্যান্স দিয়ে বনে যান দলের নিয়মিত মুখ।
২০১২ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে অভিষেকের পর ওই বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দুর্দান্ত পারফর্ম করে জায়গা পান টিম অব দ্যা টুর্নামেন্টে। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে ভারতের বিপক্ষে সিরিজে এক টেস্টে খেলেন ৯৯ রানের আক্ষেপময় রেকর্ড গড়া ইনিংস। পজিশন অনুযায়ী ৮ বা তার পরের পজিশনে তিনি প্রথম ব্যাটার হিসেবে ১০০ বল খেলার কীর্তি গড়েন। অবশ্য মাত্র এক রানের আক্ষেপে মেইডেন সেঞ্চুরি মিস করেন স্টার্ক।
২০১৪-১৫ মৌসুমে আন্তর্জাতিক ও ঘরোয়া ক্রিকেট দুই ক্ষেত্রেই অজিদের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি ছিলেন তিনি। ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও অজিদের হয়ে নিয়েছিলেন সর্বোচ্চ উইকেট।
২০১৫ সালটা ছিল স্টার্কের জন্য স্বপ্নের মত এক বছর। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে সেবার প্রথমবার বিশ্বকাপ শিরোপা জয় করেন তিনি! ওই বিশ্বকাপে ২২ উইকেট নিয়ে টুর্নামেন্ট সেরাও হন স্টার্ক। টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত পারফর্ম করে ওয়ানডে বোলিং র্যাঙ্কিংয়ে প্রথম বার শীর্ষে উঠে আসেন এই তারকা পেসার।
ওই বছর ৮৭ উইকেট নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি ছিলেন তিনি। একই বছর ১৫ নভেম্বর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৬০.৪ গতির বল করে টেস্টে সর্বোচ্চ গতির ডেলিভারির রেকর্ড গড়েন স্টার্ক। স্টার্কের ওই রেকর্ডগড়া ডেলিভারির সময় ব্যাট করছিলেন রস টেলর।
পরের বছর ২০১৬ সালে ভারতের বিপক্ষে ১৪ তম অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার হিসেবে ১ হাজার টেস্ট রান ও ১০০ টেস্ট উইকেটের মালিক হন স্টার্ক। একই সাথে মাত্র ৫২ ম্যাচে ১০০ উইকেট শিকার করে ওয়ানডেতে দ্রুততম ১০০ উইকেট শিকারের রেকর্ড গড়েন এই তারকা পেসার। এমনকি ওয়ানডেতে দ্রুততম ১৫০ উইকেট শিকারের মালিকও তিনি! নিজের ৭৭ তম ম্যাচে শিকার করেন ১৫০ তম উইকেট।
২০১৯ বিশ্বকাপেও অজিদের অন্যতম ভরসা ছিল এই বাঁ-হাতি পেসার। ওই বিশ্বকাপে ২৭ উইকেট শিকার করে এক বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারের রেকর্ড গড়েন এই গতি তারকা। বিশ্বকাপ ইতিহাসে সর্বোচ্চ বার পাঁচ উইকেট (৩) শিকারের কীর্তিও গড়েন তিনি।
২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া নারী ক্রিকেট দলের উইকেট রক্ষক ব্যাটার এলিসা হিলিকে বিয়ে করেন স্টার্ক। স্টার্ক ও হিলি ক্রিকেট ইতিহাসের তৃতীয় দম্পতি যারা দু’জনই নিজ দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেট খেলেছেন।
২০২০ পরবর্তী সময় থেকে ২০২১ এর মাঝামাঝি পর্যন্ত বল হাতে বেশ খারাপ সময় পার করছিলেন এই পেসার। সোশ্যাল মিডিয়া সহ লোকাল মিডিয়ায় তাঁর পারফরম্যান্স ছিল সমালোচনার কেন্দ্রে। তবে এরপরই ফিরেছেন নিজের চেনা রুপে। ২০২১ সালে ৪৩ উইকেট শিকার করে প্রথমবার ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার সর্বোচ্চ পুরস্কার অ্যালান বোর্ডার মেডেল জেতেন তিনি। একই সাথে অজিদের হয়ে বর্ষসেরা ওয়ানডের পুরষ্কারও জেতেন তিনি।
বয়সটা মাত্র ৩২! ক্যারিয়ারে যে সময়ে ক্রিকেটাররা নিজেদের সেরা ফর্মে থাকেন ওই বয়সে ইতিমধ্যেই স্টার্ক নিজের ঝুলিতে যোগ করেছেন বহু অর্জন। ডান হাতি ব্যাটারদের জন্য স্টার্কের ইনস্যুইং ইয়োর্কার যেন যমদূতের মত। স্টার্কের সামনে হাতছানি এখন নিজেকে সেরাদের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নেওয়ার। অবশ্য ফিটনেস আর পারফরম্যান্স ঠিক থাকলে এটি তাঁর জন্য খুব কষ্টসাধ্য কিছু নয়।