গতি কিংবা দারিদ্র – কোনো ব্যাপারেই আপোষ করেননি তিনি

উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ জীবিকার সন্ধানে পাড়ি জমায় মধ্যপ্রাচ্যে। পরিবার-পরিজন ছেড়ে দুবাই-আবুধাবির প্রচন্ড গরমে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের বিনিময়ে নিজের ও নিজের পরিবারের দেখভাল করার দায়িত্বে অবিচল থাকে মানুষগুলো।

চার বছর আগের কথা। মার্চের এক তপ্ত দুপুরে কেরালার তেইশ বছর বয়সী যুবক কে এম আসিফ দুবাই পৌঁছালেন। থাকার বন্দোবস্ত যেখানে তৈরি হলো, সেখানে ছোট্ট একটা রুমে আসিফ ছাড়াও থাকে আরও সাতজন। তার উপর রুমে এয়ার কন্ডিশনিং নেই। এসেই বড়সড় একটা ধাক্কা খেলেন। কিন্তু এখানে থাকতে হলে এভাবে থাকা ছাড়া তো আর উপায় নেই।

ক্রিকেট ছিল আসিফের প্রথম ভালোবাসা। কিন্তু কথায় যে আছে, ‘অভাব যখন দরজায় এসে দাঁড়ায়, ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়।’ পরিস্থিতিটা আসিফের জন্যে সেরকমই ছিল। বাবা দিনমজুর, মা ঘর সামলান। ছোট ভাই বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, ছোট বোন বাড়ন্ত বয়সে মাথায় আঘাত পাওয়ার দরুন মস্তিষ্কের ক্ষতি হয়েছে৷ বয়স্ক বাবা আর কতদিন ঘর সামলাবেন? এদিকে বৃষ্টি হলেই ভাঙা চালের ছিদ্র দিয়ে পানি পড়ে ঘর ভেসে যায়।

কী করবেন আসিফ? বয়সভিত্তিক ক্রিকেট তো খেলতে পারেননি, এখন যেখানে ট্রায়াল দিচ্ছেন, সেখানেই বাদ পড়ছেন। ভালোবাসার ক্রিকেটকে ছাড়তে পারছেন না, অন্যদিকে পরিবারের দুঃখকষ্টও সহ্য করতে পারছেন না।

কেরালার ক্রিকেটপাড়ার জনপ্রিয় কোচ বিজু জর্জ আসিফকে দুবাইতে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিলেন। টিকিট ও ভিসার ব্যবস্থাও করে দিলেন জর্জই। একপ্রকার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই দুবাইয়ের ফ্লাইটে চড়লেন আসিফ।

দুবাইয়ে পৌঁছে অসহ্য গরমে কাজ, রুমে নেই এয়ার কন্ডিশনিং- আসিফ হাঁপিয়ে উঠলেন কয়েকদিনেই। প্রথম মাসের ১০ হাজার রুপি নিয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ২০১৬ এর এপ্রিলেই দেশে ফিরে আসলেন তিনি।

দেশে ফিরে আসিফ জানতে পারলেন যে, আইডিবিআই ব্যাংক সাবেক অজি পেসার জেফ থমসনের সাথে মিলে সারাদেশে একটা ফাস্ট বোলিং ট্রায়ালের আয়োজন করবে। যাদের নাম শর্টলিস্টে আসবে তারা বৃত্তি নিয়ে গ্লেন ম্যাকগ্রার অধীনে এমআরএফ পেইস ফাউন্ডেশনে অনুশীলন করতে পারবে।

ট্রায়ালে থমসনের চোখে পড়ে যান আসিফ। মিনিটখানেক তার সাথে কথাও বলেছিলেন থমসন। আসিফের প্রতি তার উপদেশ ছিল, ‘আর যাই করো, কখনো গতির সাথে আপস করবে না।’

কেরালার নির্বাচকেরা আসিফকে নিশ্চয়তা দেন যে, পরবর্তী ঘরোয়া মৌসুমের জন্য তাকে অবশ্যই বিবেচনা করা হবে।

কিন্তু যথাসময়ে নির্বাচকদের প্রতিশ্রুতি অক্ষুণ্ণ রইল না। দুবাইয়ের চাকরি ছেড়ে এসে ক্রিকেটের পেছনে এত পরিশ্রম, এত সময় ব্যয় করেও কোনো লাভ হলো না।

অগত্যা আসিফ দুবাই ফিরে গেলেন। পর্যটক ভিসা নিয়ে যাওয়ায় সময় ছিল সীমিত। তাই নতুন চাকরি খোঁজা শুরু করলেন। এর মধ্যে জানতে পারলেন যে, সংযুক্ত আরব আমিরাত জাতীয় দলে খেলার জন্য উন্মুক্ত ট্রায়াল নেয়া হচ্ছে। সাথে সাথেই রেজিস্ট্রেশন করলেন আসিফ এবং পরদিন ট্রায়ালে গিয়ে তিনঘণ্টা বোলিং করলেন।

আসার সময় তাঁদেরকে ফোন নম্বর ও ঠিকানা দিয়ে আসলেন। পরদিন সেখান থেকে ফোন করে জানানো হলো যে, আকিব জাভেদ আসিফের সাথে দেখা করতে চান। পাকিস্তানের সাবেক এই ফাস্ট বোলার তখন সংযুক্ত আরব আমিরাত দলের প্রধান কোচ।

আসিফ আকিব জাভেদকে জানালেন যে, এখানে কাজের সন্ধানে এসেছেন। আকিব জাভেদ তাঁকে একটা চাকরি খুঁজে পেতে সাহায্য করলেন।

কিন্তু, সেখানে ঘটল আরেক বিপত্তি৷ যে কোম্পানিতে চাকরি হয়েছিল, তাঁরা আসিফের ব্যাকগ্রাউন্ড ঘাঁটতে গিয়ে একমাস পর দুবাই পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা জানতে পেরর চাকরির প্রস্তাব ফিরিয়ে নিল। এদিকে ভিসার মেয়াদও শেষ হয়ে যাচ্ছে। উপায়ান্তর হয়ে দেশে ফিরে আসলেন।

২০১৭ সালের আইপিএলের আগে বন্ধু সঞ্জু স্যামসনের সুপারিশে দিল্লি ডেয়ারডেভিলসের নেটে বোলিং করেছিলেন আসিফ৷ কোচ বিজু জর্জ সেবার কলকাতা নাইট রাইডার্সের ফিল্ডিং কোচ ছিলেন। জর্জের কথায় চেন্নাই থেকে রাতের বাস ধরে ব্যাঙ্গালুরু পৌঁছে কেকেআরের ক্যাম্পে যোগ দেন আসিফ।

অবশেষে একদিন ভারতের ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি আসর সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফিতে কেরালার হয়ে সুযোগ পেয়ে যান। ২০১৭-১৮ আসরে তাঁর টি-টোয়েন্টি অভিষেক হয় গোয়ার বিপক্ষে৷ ম্যাচটা টিভিতে দেখানো হয়েছিল এবং একটা ৪৫ সেকেন্ডের হাইলাইটস প্যাকেজ ভাইরাল হয়ে যায় যেখানে আসিফকে দেখা গিয়েছিল গতির ঝড়ে ব্যাটসম্যানদের নাস্তানাবুদ করতে।

সেই ম্যাচে ধারাভাষ্যকারদের একজন ছিলেন লক্ষ্মণ শিবারামাকৃষ্ণান (এলএস)। তিনি আসিফের গতি দেখে নিজের বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন ম্যাচের সময়।

বিজু জর্জ এলএসকে মেসেজ করে জিজ্ঞাসা করলেন যে তিনি চেন্নাই সুপার কিংসের নেট বোলার হিসেবে আসিফের নাম সুপারিশ করতে পারেন কিনা। শীঘ্রই সুরেশ রায়নাদের বিরুদ্ধে নেটে বোলিং করছিলেন তিনি।

শেষমেশ ২০১৮ মৌসুমে ৪০ লাখ রুপির বিনিময়ে আসিফকে দলে ভেড়ায় চেন্নাই সুপার কিংস৷ দীপক চাহারের চোটের সুবাদে দিল্লীর বিপক্ষে মাঠে নামার সুযোগ পেয়ে যান কেরালার এই ফাস্ট বোলার।

শেন ওয়াটসন তাঁকে বলেছিলেন, ‘শুনেছি তুমি নাকি টেনিস বলে খুব ভালো বোলিং কর৷ ধরে নাও, এটাও একটা টেনিস বলের ম্যাচ। জোরে বল কর, মার খাওয়ার ভয় পেয়ো না।’

ম্যাচের দিন তার কাঁধে হাত রেখে ধোনি বলেছিলেন, ‘চিন্তা করিস না। তুই বল কর, চার ওভারে ৪০ দিলেও কোনো সমস্যা নেই। আজ তোর দিন।’

ফ্র‍্যাঞ্চাইজিটির হয়ে দুটোর বেশি ম্যাচ খেলা হয়নি তার। কিন্তু ব্যাকআপ ফাস্ট বোলার হিসেবে এখনও দলটিতে রয়েছেন আসিফ। ২০১৯-২০ মৌসুমে কেরালার হয়ে রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক হয়েছে তাঁর। এই মৌসুমে তাদের পেস আক্রমণের নেতা সন্দ্বীপ ভারিয়ের তামিলনাড়ুতে চলে যাওয়ায় সুযোগটা ভালোভাবেই এসেছে আসিফের কাছে।

আসিফ বোলিংটাকে ভালোবাসেন। হোটেলের করিডোরে চামড়ার বলটা হাতে ধরিয়ে দিলে সেখানেও বোলিং করতে দ্বিধা নেই তার। আইপিএলে পাওয়া অর্থ দিয়ে জরাজীর্ণ বাড়ির বদলে নতুন একটা বাড়ি বানাতে পেরেছেন, ভাইবোনদের ওষুধপত্রের খরচ বহন কর‍তে পারছেন, বাবা-মায়ের দেখাশোনা করতে পারছেন।

দুবাইয়ের সেই খরতপ্ত দুপুরে হাড়ভাঙা খাটুনি থেকে চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে আইপিএলে খেলা- এ জয়টা কেবল কেরালার কে এম আসিফের একার নয়, তার দিনমজুর বাবার, তার গৃহিণী মায়ের, তার অসুস্থ ভাইবোনেরও।

_______________

ইএসপিএন ক্রিকইনফোতে শশাঙ্ক কিশোরের লেখা How Kerala’s KM Asif broke through to the IPL অবলম্বনে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link