তাঁর বয়সের বেশিরভাগ ফুটবলারই ইউরোপিয়ান ফুটবলে পায়ের নিচে তলা খুঁজে পায়নি। প্রতিভাবান তকমা নিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করলেও হারিয়ে যাবার সংখ্যাটাও নেহায়েৎ কম নয়। তবে তিনি সেসবের ধার মাড়াননি, দুর্দম্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যেই বিশ্বকাপ জেতা হয়ে গেছে, দলকে ফাইনালে তুলেছেন আরও একবার। তিনি কিলিয়ান এমবাপ্পে, জিদান-অরিদের রেখে যাওয়া ফ্রান্সের ভবিষ্যতের স্বপ্নসারথি।
ফ্রান্সের ফুটবলে অভিবাসী ফুটবলারের তালিকাটা বেশ বড়। জিনেদিন জিদান, থিয়েরি অরি, লিলিয়ান থুরামরা অন্য দেশে জন্ম নিলেও ফুটবলটা খেলেছেন ফ্রান্সের জার্সিতেই। এমবাপ্পের সামনে তাই অনুসরণের পথটা খোলাই ছিল, সেই পথ বেয়ে তিনি উপরে দিকে উঠেছেন দারুণ গতিতে।
ক্যামেরুনিয়ান বাবা এবং আলজেরিয়ান মায়ের ঘরে জন্ম নেয়া এমবাপ্পে বেড়ে উঠেছেন ক্রীড়াপ্রেমী এক পরিবারে। মা ফাইজা লামার ছিলেন প্রথম বিভাগের হ্যান্ডবল তারকা। নব্বইয়ের দশকে চুটিয়ে খেলেছেন ফরাসি লিগগুলোতে। বাবা উইলফ্রেড অবশ্য ফুটবল খেলতেন।
বড় পর্যায়ে খেলতে না পারলেও ফ্রান্সের ছোট শহর বন্ডির দলে তিনি ছিলেন নিয়মিত মুখ। ছেলেরা নাকি মায়ের ন্যাওটা হয়, ছোট্ট এমবাপ্পেও তাই। সবাই ভেবেছিলেন মায়ের পথই অনুসরণ করবে সবার আদরের পাত্র। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাত্র তিন বছর বয়সেই এমবাপ্পের আগ্রহ জন্মায় ফুটবলে।
বাবার ক্লাব এফসি বন্ডির একাডেমিতেই ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু তাঁর। ছোটবেলাতেই রীতিমত হইচই ফেলে দিয়েছিলেন ফরাসি ফুটবলে। স্বয়ং আর্সেন ওয়েঙ্গার তাঁকে আখ্যা দিয়েছিলেন থিয়েরি অরির উত্তরসূরি হিসেবে। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই তাঁকে দলে ভেড়াতে উঠেপড়ে লেগেছিল রিয়াল মাদ্রিদ, লিভারপুলের মত ক্লাবগুলো। কিন্তু পরিবারের কাছে থাকতে পারবেন বিধায় মোনাকোর হয়েই ক্যারিয়ার সামনে এগোনোর সিদ্ধান্ত নেন এমবাপ্পে।
বয়সভিত্তিক ফুটবলে গোলের বন্যা বইয়ে দেন এই ক্ষুদে তারকা। মাত্র ১৬ বছর বয়সে অরির রেকর্ড ভেঙে মোনাকোর মূল দলে অভিষেক ঘটে তাঁর। এমনকি সবচেয়ে কম বয়সে গোলের রেকর্ডও তাঁর দখলেই। বড় ক্লাবগুলোর নজর থাকলেও লিওনার্দো জার্দিম এবং লুইস কাম্পোসের পরামর্শে থেকে যান মোনাকোতেই।
২০১৬-১৭ মৌসুমে প্রথম বারের মত গোটা বিশ্ব প্রত্যক্ষদর্শী হয় এমবাপ্পের পায়ের জাদুর। ২৯ ম্যাচে মাঠে নেমে ১৫ গোলের পাশাপাশি অ্যাসিস্ট করেন ১১ গোলে। পিএসজির আধিপত্য ভেঙে সেবার মোনাকোকে শিরোপা জেতানোর পাশাপাশি নিয়ে যান চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালেও। যদিও জুভেন্টাসের কাছে হেরে সেবার ইউরোপ সেরার খেতাব জেতা হয়নি।
পরের মৌসুমেই তাঁকে দলে ভেড়াতে উঠেপড়ে লাগে ইউরোপের বড় দলগুলো। সবাইকে টেক্কা দিয়ে ১৮০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে তাঁকে দলে টানে আরেক ফরাসি জায়ান্ট পিএসজি। ক্যারিয়ারে এরপর বারবার রিয়াল মাদ্রিদে যাবার গুঞ্জন থাকলেও এমবাপ্পে রয়ে গেছেন প্যারিসের দলটাতেও।
পিএসজিও যথার্থ সম্মান দিয়েছে তাঁদের আদরের রাজপুত্রকে, মেসি-নেইমার থাকলেও দলে তাঁদের মূল তারকা এমবাপ্পেও। এমনকি গত মৌসুমে যখন এমবাপ্পের মাদ্রিদে যাওয়া নিশ্চিত বলেই ধরে নিয়েছে সবাই, সেই সময়টাতে ফরাসি প্রেসিডেন্ট স্বয়ং ইমানুয়ের ম্যাখো অনুরোধ জানিয়েছিলেন তাঁকে। ফ্রান্সে সবাই এতটাই কদর করে এমবাপ্পের।
জাতীয় দলের প্রশ্নে অবশ্য শুরুতে খানিকটা দোটানায় ভুগছিলেন এমবাপ্পে। ক্যামেরুন এবং আলজেরিইয়ার হয়েও খেলার পথ খোলা ছিল তাঁর সামনে। কিন্তু বহু চিন্তাভাবনার পর এমবাপ্পে বেছে নেন ফ্রান্সকেই, ২০১৬ সালে অনুর্ধব-১৯ ইউরো জেতান দলকে।
এরপর আসে স্বপ্নের ২০১৮ বিশ্বকাপ। রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত সেই বিশ্বকাপে দুই যুগের অপেক্ষার প্রহর ফুরিয়ে ফ্রান্সকে জেতান বিশ্বসেরার খেতাব। পেলের পর মাত্র দ্বিতীয় টিনেজার হিসেবে বিশ্বকাপ জেতার কৃতিত্ব গড়েন, এমনকি ফাইনালেও গোল ছিল তাঁর। ২০২২ বিশ্বকাপেও ধরে রেখেছিলেন পুরনো ফর্ম, আট গোল করে জেতেন গোল্ডেন বুটের খেতাব।
ফাইনালে হ্যাটট্রিক করে নাম লেখান কিংবদন্তি জিওফ হার্স্টের পাশে। যদিও শেষ রক্ষা হয়নি, আর্জেন্টিনার কাছে টাইব্রেকারে হেরে ট্র্যাজিক হিরোতে পরিণত হন এমবাপ্পে। মাত্র ২৪ বছর বয়সেই বিশ্বকাপে ১২ গোল হয়ে গেছে তাঁর। মিরোস্লাভ ক্লোসার ১৬ গোলের রেকর্ডটা তাই হুমকির মুখে। ইনজুরিমুক্ত আরেকটি বিশ্বকাপ কাটাতে পারলে রেকর্ডটা নিজের করে নেবেন এমবাপ্পে এ ব্যাপারে দ্বিমত করবেন না কেউই।
জাতীয় দলের গোলমেশিন তিনি, পিএসজিতেও তাঁর সেই একই চরিত্র। এমবাপ্পে যদি নিজের ফর্মটা ধরে রাখতে পারেন, তবে আগামী কয়েক বছরে রেকর্ডবুকটা আরও কয়েক দফা নতুন করে লিখতে হবে সেটা বলাই বাহুল্য।