পেস বোলার বলতেই আমাদের মনের দৃশ্যপটে ভেসে উঠে আগ্রাসী এক ছবি। লম্বা রানআপ নিয়ে দৌড়ে বল ছুঁড়ছেন, শরীরি ভাষাতেই কাবু করছেন ব্যাটসম্যানদের, তেড়েফুঁড়ে যাচ্ছেন কিংবা স্লেজিং করছেন। সবাই বাহবা দিয়ে বলছে এই না হলে পেস বোলার!
কিন্তু তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। প্রায় ছ’ফুটের একহারা গড়ন, লম্বা চুল আর মুখে সব সময় হাসি লেগেই আছে। তার লাজুক হাসি ঢেউ তুলতো গ্যালারিতে থাকা রমণীদের হৃদয়ে। অবশ্য ব্যাটসম্যানদের ছাড় দিতেন না একবিন্দুও, বিষাক্ত সব ডেলিভারিতে নাভিশ্বাস তুলে ফেলতেন ব্যাটসম্যানদের। সদাহাস্য এই পেসারটি হলেন লক্ষ্মীপতি বালাজি, হাসিমুখের হন্তারক।
১৯৮১ সালে তামিলনাড়ুতে জন্ম লক্ষ্মীপতি বালাজির। ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি অনুরাগ ছিল তার। ২০০১ মৌসুমে তামিলনাড়ুর হয়ে রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক হয় তার। প্রথম মৌসুমেই নিজেকে আলাদা করে চেনান তিনি, ২০.৫১ গড়ে শিকার করেন ৩৭ উইকেট। ফলশ্রুতিতে ডাক পেয়ে যান ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরগামী ভারতীয় দলে।
একজন ক্রিকেটারের পরম আরাধ্য স্বপ্ন জাতীয় দলে খেলা। সে চায় অভিষেক ম্যাচটাকে যথাসম্ভব নিজের আলোয় রাঙিয়ে দিতে। কিন্তু বালাজি সম্ভবত নিজের অভিষেক ম্যাচকে দু:স্বপ্ন ভেবে কেবল ভুলেই যেতে চাইবেন। সেদিন ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যানরা বেধড়ক পিটিয়েছিল অভিষিক্ত বালাজিকে, চার ওভারে ৪৪ রান হজম করার পর তাকে আর বোলিংয়ে আনার সাহস পাননি অধিনায়ক সৌরভ।
সবাই ভেবেছিলেন বালাজি বোধহয় হারিয়ে যাবেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট তার জন্য নয়। কিন্তু লড়াকু বালাজি ঠিকই ফিরে আসেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আঙিনায়, আরও প্রস্তুত এবং ধারালো হয়ে। পরের বছর আহমেদাবাদে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হয় তার। কিন্তু বড় খেলোয়াড়রা নিজেদের চেনানোর জন্য বেছে নেন বড় মঞ্চকেই, বালাজিও তাই বোধহয় নিজের আগমন জানান দেবার জন্য বেছে নিয়েছিলেন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্থানকেই।
সেই সিরিজে ভারতের জয়ের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল বল হাতে বালাজির বিধ্বংসী ফর্ম। তবে সে সিরিজে ব্যাট হাতে দিয়েছিলন দারুণ এক মুহূর্তের জন্ম। ‘রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেস’ খ্যাত শোয়েব আখতারের এক বলে লং অনের উপর দিয়ে বিশাল এক ছয় হাঁকিয়ে সবাইকে অবাক করে দেন। যদিও পরের বলেই গতি দিয়ে বালাজির ব্যাট ভেঙে জবাব দিয়েছিলেন শোয়েব।
সবাই ভেবেছিলেন বালাজির ক্যারিয়ার বদলে যাবে এক লহমায়। কিন্তু পিঠের ইনজুরি বালাজিকে পিছিয়ে দেয় তিন বছর। এই তিন বছর ভারত জাতীয় দল তো দূরে থাক, তামিলনাড়ু হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটেও মাঠে নামতে পারেননি তিনি। ২০০৯ সালে আরও একবার জাতীয় দলে ফিরেছিলেন তিনি।
আইপিএলের প্রথম আসর থেকেই নিয়মিত মুখ ছিলেন বালাজি। আইপিএলে প্রথম হ্যাটট্রিকের মালিকও তিনি। চেন্নাইয়ের হয়ে পাঞ্জাবের বিপক্ষে টানা তিন বলে ফেরান ইরফান পাঠান, পীযুষ চাওলা এবং বিক্রম সিংকে। চেন্নাই বাদেও ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) মাঠ মাতিয়েছেন কলকাতা এবং পাঞ্জাবের হয়ে।
আইপিএলের দারুণ পারফরম্যান্সের সুবাদে ২০১২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দলেও জায়গা পান তিনি। নির্বাচকদের আস্থার ভরসা রেখে সেই বিশ্বকাপে নয় উইকেট নেন। দলের সেরা বোলার ছিলেন তিনি। ২০১৬ সালে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন বালাজি। ভারতের হয়ে আট টেস্টে ২৭ উইকেটের পাশাপাশি ৩০ টি একদিনের ম্যাচ খেলে নিয়েছেন ৩৪ উইকেট।
অবসরের সময় বয়স হয়েছিল মাত্র ৩৪ বছর। বেরসিক ইনজুরিটা না আসলে নিশ্চয়ই ক্যারিয়ারটা আরও লম্বা হত। বলা হয়, ইনজুরির জন্য নিজের সেরা সময়টা ভারতকে কখনো দিতেই পারেননি তিনি। দিলে নিশ্চয়ই আরও অনেক উঁচুতে থেকে ক্যারিয়ারটা শেষ করতে পারতেন।
অবসরের পর জড়িয়ে পড়েন ক্রিকেট কোচিংয়ের সঙ্গে। বর্তমানে চেন্নাই সুপার কিংসের বোলিং কোচ তিনি। বালাজির মাঝে সম্ভাবনা ছিল ভারতের অন্যতম সেরা পেসার হওয়ার কিন্তু ভাগ্যের মারপ্যাঁচ এবং চোট শেষ করে দিয়েছে সে সম্ভাবনা। বালাজি তাই প্রশান্তি পান ভারতের ভবিষ্যত পেসার গড়ার কাজে। কে জানে, এর ফাঁকে হয়তো একটু আক্ষেপও উঁকি দেয়!