লালা অমরনাথ, জনপ্রিয়তায় তিনি কাঁটাতারের ঊর্ধ্বে ছিলেন

ভারতের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান তিনি। স্যার ডন ব্র্যাডম্যান টেস্টে যে একবার হিট আউট হয়েছিলেন সেই হিট উইকেটের জন্ম দেওয়া বোলারও তিনি।

ভারতের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান তিনি। স্যার ডন ব্র্যাডম্যান টেস্টে যে একবার হিট আউট হয়েছিলেন সেই হিট উইকেটের জন্ম দেওয়া বোলারও তিনি। 

বলছি লালা অমরনাথের কথা। ভারতের ক্রিকেটে প্রথম সময়ের দিকের গ্রেটদের তালিকা করতে বসলে তাঁর নামটা প্রথম সারির দিকেই থাকবে। 

লালা অমরনাথের আরেকটি পরিচয়ও আছে। তিনি ১৯৮৩ বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচের নায়ক মহিন্দর অমরনাথের বাবা। তবে পুত্রের পরিচয় বাদেও, বাবা লালা অমরনাথ তাঁর ক্রিকেটার সত্ত্বা দিয়েই ভারতে পরিচিত। শুধু ভারত নয়, পাকিস্তানেও রয়েছে তাঁর সমান জনপ্রিয়তা।

পাঞ্জাবের কাপুরথালা গ্রামে লালা অমরনাথের জন্ম। সময়টা ১৯১১। তবে শৈশবটা সেখানে সেভাবে কাটানো হয়নি৷ খুব অল্প বয়সে মাকে হারানোয় তাকে দাদার কাছে লাহোরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। লাহোরে শৈশব কাটানো, সেই লাহোরেই ক্রিকেটের শুরু। 

লালা অমরনাথের ক্রিকেট প্রতিভা প্রথম নজরে আসে রানা ফ্যামিলি’র তাওয়াক্কাল মজিদের চোখে। তখন আবার লাহোরের সবচেয়ে বড় ক্রিকেট ক্লাব চলে রানা ফ্যামিলি’ তত্ত্বাবধানে। তাওয়াক্কাল মজিদ লালা অমরনাথকে সেই ক্লাবে খেলার পরামর্শ দেন। লালাও সানন্দে সে ক্লাবের হয়ে খেলা শুরু করে। 

এরপর লালা অমরনাথের ক্রিকেটীয় দক্ষতা আস্তে আস্তে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া শুরু করে। ফ্রাঙ্ক ট্যারেন্ট নামের অস্ট্রেলিয়ান কোচ তখন মহারাজা অফ পাটালিয়া অর্থাৎ ভূপেন্দর সিংয়ের ক্লাবে কোচিং করান। সেই ফ্রাঙ্ক ট্যারেন্টের নজরেও আসলেন লালা অমরনাথ। লালা অমরনাথকে তিনি মহারাজার দলে খেলার প্রস্তাব দিলেন। লালাও সেই প্রস্তাবে সম্মতি জানালেন। এরপর থেকে মহারাজার দলের হয়ে খেলা শুরু করেন তিনি। এ কারণে আবারও ভারতে ফিরলেন তিনি। 

মূলত মহারাজার দলে খেলার বদৌলতেই লালা অমরানথের ক্রিকেট টেকনিক আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী হতে শুরু করে। কারণ মহারাজা ভূপেন্দর সিং তখন দলে প্রচুর ইংলিশ ক্রিকেটার নিয়ে আসতেন। লালা অমরনাথ সেসব ক্রিকেটারদের অনুসরন করতেন।

তাদের নেট প্র্যাক্টিস দেখে নিজেও রপ্ত করতেন। আর তিনি খুব সূক্ষ্মভাবে তাদের পায়ের কাজ দেখতেন। তারা কোন বল কিভাবে পা রেখে খেলছে, এটা দেখতেন এবং নিজেও অনুশীলন করতেন। এভাবে লালা অমরনাথ তাঁর ব্যাটিং টেকনিক আরও বেশি সলিড আর শক্ত করতেন। 

এরপর ১৯৩৩ সালে লালা অমরনাথের টেস্ট অভিষেক হয়। ইংল্যান্ডের সাথে বোম্বের জিম খানায় ম্যাচ। ভারত ম্যাচটি হেরে যায়। কিন্তু ভারতের দুই ইনিংসেই সর্বোচ্চ রান করায় অনেকের নজরে পড়েন লালা অমরনাথ। এমনকি মাঠে উপস্থিত থাকা এক ইংলিশ মিলিয়নিয়ার অমরনাথের খেলা দেখে এতই অভিভূত হয়েছিলেন যে, তিনি অমরনাথ কে ৮০০ পাউন্ড সমমান রূপি উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন৷ আরেকজন আবার অমরনাথকে একটি গাড়ি উপহার করেছিলেন।

১৯৩৬ সাল। এ বছরেই লালা অমরনাথ বেশ বাজে একটা সময় পার করেন। এ বছরেই তাকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য একটি সফর থেকে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। 

সেবার ইংল্যান্ড সফরে গিয়েছিল ভারত। ভারতের তখন অধিনায়ক ভিজ্জি। মূলত তাঁর কারণেই ইংল্যান্ড সফর থেকে ফিরে আসতে হয় অমরনাথকে। মূল ঘটনাটা ছিল, ম্যাচ চলাকালীন লালা অমরনাথ কিছুটা ইনজুরিগ্রস্থ ছিল। তার সামান্য বিশ্রামের দরকার ছিল। কিন্তু অধিনায়ক ভিজ্জি তাকে প্যাড আপ করে বসে থাকতে বলে।

অথচ, অমরনাথের আগেই তিনি অন্য ব্যাটারদের উইকেটে পাঠিয়ে দিচ্ছিলেন। এ কারণে একটা সময় পর ড্রেসিংরুমে এসে রাগ ঝেড়েছিলেন লালা অমরনাথ। ঠিক এর পরেই দলের ম্যানেজার জ্যাক ব্রিটেন অমরনাথকে সফর থেকে বাতিল করে ভারতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। লালা অমরনাথ এরপর ভারতে চলে আসেন। 

তবে এই ইস্যুতে পরবর্তী তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্তে অমরনাথের বিরুদ্ধে তেমন কোনো শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ প্রমাণিত হয় নি। অবশেষে দলের অধিনায়ক ও ম্যানেজারের শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগের খড়গ থেকে মুক্তি পান লালা অমরনাথ। 

লালা অমরনাথ তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা সময় কাটিয়েছিলেন ১৯৪৭/৪৮ মৌসুমে। অস্ট্রেলিয়া সফরে সেবার ৫৮.১১ গড়ে তিনি ১১৬২ রান করেছিলেন। এর মধ্যে মেলবোর্নে খেলা তাঁর অপরাজিত ২২৮ রানের ইনিংসটি দেখে ডন ব্র্যাডম্যান এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে বলেছিলেন,  ‘অমরনাথের এই ইনিংসটি ছিল আমার দেখা মেলবোর্নের মাঠের সেরা ইনিংসগুলোর মধ্যে অন্যতম।’ 

লালা অমরনাথ তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট সিরিজ খেলেছিলেন ১৯৫২ সালে। পাকিস্তানের বিপক্ষে সে সিরিজটি ২-১ এ জিতেছিল ভারত। 

এক সেঞ্চুরি আর চার হাফ-সেঞ্চুরিতে ২৪ টেস্টে ৮৭৮ রান করা লালা অমরনাথের ক্যারিয়ারটা সাদামাটা হলেও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তাঁর ক্যারিয়ার বেশ সমৃদ্ধ। ৩১ সেঞ্চুরিতে রান করেছেন দশ হাজারেরও বেশি। পাশাপাশি বল হাতে নিয়েছেন ৪৬৩ টি উইকেট। 

ক্রিকেট থেকে অবসরের পরে লালা অমরনাথকে দেখা গিয়েছে বিভিন্ন ভূমিকায়। স্বাধীনতার পর ভারতের প্রথম ম্যানেজার ছিলেন তিনি। ১৯৫৫ সালে ভারতের সিলেকশন কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ ছাড়া নব্বই দশকে ক্রিকেট এক্সপার্ট হিসেবেও তাঁর সুখ্যাতি ছিল। কমেন্ট্রি বক্সেও দেখা গেছে তাঁর দেখা মিলেছে অনেক বার। 

লালা অমরনাথের জনপ্রিয়তা সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানেও ছিল। কাঁটা তারের মাঝে বৈরিতায় আটকে থাকা দুই দেশের মাঝেও তার জনপ্রিয়তা ছিল বেশ। কোনো এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যদি কখনও পাকিস্তানে নির্বাচন করি, আমার ধারণা আমি জিতব। এখানকার মানুষ আমাকে খুবই ভালবাসে। আমি তাদের জন্য গর্বিত।’

২০০০ সালের পাঁচ আগস্টে লালা অমরনাথ পরলোকগমন করেন। তার মৃত্যুর পর পাকিস্তানের কিংবদন্তি ক্রিকেটার হানিফ মোহাম্মদ বলেছিলেন, ‘আমি, আমার বড় দুই ভাই ওয়াসির, রাইস- সবাই তাকে শৈশবকাল থেকে অনুসরন করতাম। আমার বেড়ে ওঠার দিনে তিনি ছিলেন অনুকরণীয় এক ব্যক্তিত্ব।’ 

পাকিস্তানের আরেক গ্রেট জহির আব্বাস বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান আর ভারতের লালা অমরনাথ স্মরণে প্রতিবছর অন্তত একটি সিরিজ আয়োজন করা উচিত। যে ট্রফিটির নাম হবে লালা অমরনাথ ট্রফি।

ভারতের ক্রিকেট আকাশে যুগে যুগে বহু গ্রেট ক্রিকেটার এসেছে। কিন্তু খুব কম জনই সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পেরেছেন। লালা অমরনাম সেই নগণ্য সংখ্যার মাঝে একজন, যিনি দুটো মানচিত্রের মাঝে মিশে ছিলেন। সীমান্তের ঊর্ধ্বে চলে যাওয়া বুঝি একেই বলে।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link