‘পুরো ইনিংসটি জুড়েই লারা জানতেন, তাঁর সামান্যতম কোনো ভুল করারও কোনো সুযোগ নেই। পুরোটা সময় অস্ট্রেলিয়ানরা শুধু তাঁর উইকেটটাই পেতে চেয়েছে, কিন্তু বারবারই লারা বাধ্য ছেলের মত অজিদের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে অবাধ্য হয়েছে। এর পরিবর্তে তিনি যা করেছেন যা মাস্টার পিস ব্যাটিংয়ের অনন্য এক নিদর্শন হয়ে টিকে গেছে ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায়। পুরো হাতে থাকা একটা ম্যাচ হুট করে হেরে গেছে অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভেসেছে অনাকাঙ্ক্ষিত এক বিজয়ের আনন্দে।’
– ক্রীড়া লেখক ও সাবেক ক্রিকেটার পিটার রোবাক
সময় ১৯৯৯ সালের মার্চ। সেই টেস্ট জুড়ে ছিল অস্ট্রেলিয়ার রাজত্ব। হোক বার্বাডোজে খেলা, প্রথম তিন দিন দাপট দেখায় সফরকারী অস্ট্রেলিয়া।
প্রথমে ব্যাট করতে নামা অস্ট্রেলিয়ান দলের অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ এক রানের জন্য ডাবল সেঞ্চুরি মিস করলেও দলের স্কোর চলে যায় ৪৯০ রানে। রিকি পন্টিং করেন ১০৪ রান।
জবাব দিতে নেমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৯৮ রানে ছয় উইকেট হারায়। ব্রায়ান লারা নিজেও ৮ রানের বেশি করতে পারেননি। তবে, ওপেনার শেরউইন ক্যাম্পবেল এক প্রান্ত আগলে রেখেছিলেন।
সপ্তম উইকেট জুটিতে তিনি উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান রিডলি জ্যাকবসের সাথে যোগ করেন ১৫৩ রান। শেরউইন ১০৫ ও জ্যাকবস ৬৮ রান করেন। এরপর নেহেমিয়াহ পেরি ২৪, কার্টলি অ্যামব্রোস ২৮ ও কোর্টনি ওয়ালশ ১২ রান করা উইন্ডিজের স্কোর অল আউট হওয়ার আগে ৩২৯-এ যেয়ে আটকায়।
অস্ট্রেলিয়ান পেসাররা গতির ঝড় তোলেন ক্যারিবিয়ান উইকেটে। গ্লেন ম্যাকগ্রা চারটি ও জেসন গিলেস্পি তিনটি উইকেট নেন।
তবে, এই সময় থেকে মাচে ফিরতে থাকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ১৪৬ রানে অল আউট হয় অস্ট্রেলিয়া। সর্বোচ্চ ৩২ রান আসে লোয়ার মিডল অর্ডারে নামা শেন ওয়ার্নের ব্যাট থেকে। ওয়ালশ একাই নেন পাঁচ উইকেট, দু’টি করে উইকেট নেন কার্টলি অ্যামব্রোস ও পেড্রো কলিন্স।
তারপরও, সহজ ছিল না ক্যারিবিয়ানদের জয়। লক্ষ্য ছিল ৩০৮ রানের। এবং যথারীতি ১০৫ রানের মধ্যে পাঁচ উইকেট নেই তাঁদের। সেখানে দাঁড়িয়ে ব্রায়ান লারা খেলেছিলেন ১৫৩ রানের অপরাজিত এক ইনিংস।
প্রচণ্ড নি:সঙ্গ ছিল সেই লড়াই। কেবল জিমি অ্যাডামস যা একটু সঙ্গ দিতে পেরেছিলেন। অধিনায়ক লারার সাথে ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে তিনি যোগ করেন ১৩৩ রান। জিমি ৩৮ রান করে এলবিডব্লিউয়ের ফাঁদে পড়েন, ম্যাকগ্রার বলে। দলীয় স্কোর তখন ২৩৮।
২৪৮ রানের মাথায় পরপর দুই বলে আউট হন রিডলি জ্যাকবস ও নেহেমিয়াহ পেরি। দু’জনই এলডব্লিউয়ের ফাঁদে পড়েন, ঘাতক ম্যাকগ্রা।
এই সময় থেকে বদলে যান লারা। এতক্ষণ যিনি একপ্রান্ত আগলে খেলেন এই সময়ে এসে তিনি হয়ে যান মারমুখী। হাফ সেঞ্চুরি করেন তিনি ১১৮ বলে। আর পরের ৫০ রান করেন মাত্র ৫১ বলে।
কিন্তু, সেটাও কি তখন যথেষ্ট হবে? উৎকণ্ঠা ছিল পুরো বার্বাডোজ জুড়ে। কারণ লারার বাকি দুই সঙ্গী তখন অ্যামব্রোস আর ওয়ালশ। যতই তাঁরা পেস দানব হন না কেন, পেস কিংবা স্পিন সামলানোতে মোটেও দক্ষ নন।
লারা হাল ছাড়লেন না। অ্যামব্রোসকে নিয়ে নবম উইকেট জুটিতে যোগ করলেন ৫৪ রান। অ্যামব্রোস যখন ফিরলেন ১২ রান করে, তখনও জয়ের থেকে ছয় রান দূরে উইন্ডিজ দল। যদিও, শেষ অবধি বিজয়ী হাসি হেসেই মাঠ ছেড়ে বের হয় লারা বাহিনী। গিলেস্পির বলে কাভার ড্রাইভ হাঁকিয়েই তিনি অজি কফিনে শেষ পেড়েকটা ঠুঁকে দেন।
চতুর্থ ইনিংসে নয় উইকেটে ৩১১ রান করে স্বাগতিকরা। এক উইকেটে জিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। টেস্টের ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা নায়কোচিত ব্যাটিং পারফরম্যান্স আসে সেদিন লারার ব্যাটে।
টেস্টে বরাবরই লারার ব্যাটটা চওড়া হয়। তিনিই সেই মানুষ যিনি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৫০১ রানের ইনিংস, টেস্টে ৪০০ কিংবা ৩৭৫-এর মত ম্যারাথন ইনিংস, অথবা ২৭৭ বা ২১৩’র মত অনবদ্য ইনিংস খেলেছেন। তবে, সেই সব ইনিংসের প্রতিটাই যেন মার খেয়ে যায় এই অপরাজিত ১৫৩-এর সামনে এসে।
মহাকাব্যিক ইনিংসটা স্বীকৃতও পেয়েছে। উইজডেনের বিচারে সর্বকালের সেরা টেস্ট ইনিংসের তালিকায় প্রথমেই আছে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের ২৭০ রান, যেটা তিনি ১৯৩৭ সালের অ্যাশেজে করেছিলেন। দ্বিতীয় স্থানেই আছে লারার ১৫৩!