১৯৮১ সাল। গুলিস্তান ক্লাবের হয়ে সেবার পাইওনিয়ার লিগে অভিষেক হলো ১৩ বছর বয়সী এক কিশোর ফুটবলারের। সেন্ট্রাল ডিফেন্সে খেলেও কিশোর ছেলেটি সবার মনযোগ কেড়ে নিল। মাঠের সবাই বলাবলি করতে লাগল, ‘নাহ! এই ছেলের এলেম আছে বটে, একদিন সে বড় কিছু হবে!’
এরপর আর পেছনে ফিরে তাকানো নয়। ১৯৮৩ সালে মুক্তিযোদ্ধার হয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেন মোনেম মুন্না। সেখানে টানা দুই মৌসুম খেলার পর যোগ দেন ব্রাদার্সে। ব্রাদার্সের হয়ে দুরন্ত পারফরম্যান্সের কারণে নজরে পড়ে যান আবাহনীর কর্মকর্তাদের। ফলে ১৯৮৭ সালে যোগ দেন ঢাকার ফুটবল ক্লাবের অন্যতম এক পরাশক্তি আবাহনী ক্রীড়া চক্রে।
আবাহনীতে তখন সামির শাকির, করিম মোহাম্মদ আলভি, প্রেমলাল, পাকির আলিদের সাথে মাঠ মাতাচ্ছেন শেখ মোহাম্মদ আসলাম, আশরাফ উদ্দিন চুন্নু, হেলাল, মহসিনদের মতো ফুটবলাররা। সেসব অভিজ্ঞ ফুটবলারের পাশে তরুণ মুন্না তার পারফরম্যান্সের মাধ্যমে নিজের জায়গা করে নিতে সক্ষম হন। ক্যারিয়ারে আর কখনো ক্লাব পরিবর্তন করেননি মুন্না। আবাহনী এবং মুন্না নাম দুটি হয়ে উঠেছিল একে অপরের সমার্থক। আমৃত্যু জড়িয়ে ছিলেন আবাহনীর সাথে, আবাহনীই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান।
১৯৯১ সালে আবাহনী থেকে ২০ লক্ষ টাকা পারিশ্রমিক পান যা ছিল সেসময়ে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এক অনন্য রেকর্ড। আবাহনীর হয়ে তার ফুটবল ক্যারিয়ারে দলকে পাঁচবার ঢাকা লিগ এবং তিনবার ফেডারেশন কাপের শিরোপা জেতাতে সক্ষম হন। ১৯৯০ সালে যখন আবাহনীর সব ফুটবলার বেশি দামে মুক্তিযোদ্ধায় নাম লেখায়, তখন দলের প্রতি ভালোবাসায় একাই আবাহনীতে থেকে যান মুন্না। সে বছরেই একদল তরুণ ফুটবলারদের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে দলকে লিগ শিরোপা জেতাতে সাহায্য করেন।
১৯৯১ মৌসুম শেষে মুন্না যোগ দেন ভারতের বিখ্যাত ক্লাব ইস্টবেঙ্গলে। ইস্টবেঙ্গলের হয়ে দুই মৌসুম খেলেন তিনি। কলকাতায় গিয়ে যেন আক্ষরিক অর্থে ‘এলেন, দেখলেন, জয় করলেন’। টানা দুই মৌসুমেই ইস্ট বেঙ্গলকে লিগ জেতান তিনি। এই সময় ইস্ট বেঙ্গল সমর্থক এবং ফুটবলপ্রিয় বাঙালিদের মন জয় করে নিতে সক্ষম হন তিনি। মাত্র দুই মৌসুম খেলেই ইস্ট বেঙ্গলের হল অব ফেমে জায়গা করে নেন।
আবাহনীতে মুন্না রাইটব্যাক হিসেবে খেলতেন। কিন্তু তার অনবদ্য পাসিং এবং বল পায়ে দক্ষতা দেখে ইস্টবেঙ্গল কোচ সৈয়দ নঈমুদ্দিন তাকে ডিফেন্সের মাঝে নিয়ে আসেন। লিবারো বা সুইপার পজিশনে তাকে অনেকটা ফ্রি রোল দেন কোচ নঈমুদ্দিন। ফলে প্রতিপক্ষের আক্রমণ নসাৎ করার পাশাপাশি দলের আক্রমণ শুরু করার গুরুদায়িত্ব বর্তায় মুন্নার কাঁধে। সে দায়িত্ব সফলভাবে পালন করেন তিনি। এছাড়াও দারুণ ফ্রি-কিক নিতেন তিনি।
১৯৮৬ সালে সিউল এশিয়ান গেমসে প্রথমবারের মতো জাতীয় দলে ডাক পান মুন্না। ১৯৯০ সালে বেইজিং এশিয়ান গেমসে প্রথমবারের মতো জাতীয় দলের অধিনায়ক নির্বাচিত হন তিনি। বাংলাদেশের তৎকালীন জার্মান কোচ অটো ফিস্টার বলেছিলেন, ‘He was mistakenly born in Bangladesh।’
১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ মিয়ানমারে চার জাতি প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। সেই প্রতিযোগিতায় মুন্নার নেতৃত্বেই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ কোনো শিরোপা জয় করে। সে বছরই তার নেতৃত্বে সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ দল রানার আপ হয়। টানা এগারো বছর জাতীয় দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন তিনি।
১৯৯৭ সালে ফুটবল থেকে অবসর নেয়ার পর ম্যানেজার হিসেবে প্রিয় ক্লাব আবাহনীর ফুটবল দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৯৯ সালে তিনি কিডনী রোগে আক্রান্ত হন। ২০০০ সালে কিডনী প্রতিস্থাপনের পর বেশ কিছুদিন বেঁচে ছিলেন। কিন্তু ২০০৪ সালে তার দেহে ক্ষতিকর ভাইরাস ধরা পড়ে। ২০০৫ সালের ২৬ জানুয়ারি গুরুতর অসুস্থ হয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন বাংলাদেশ ফুটবলের আইকন মোনেম মুন্না।
মুন্না আজ নেই, কিন্তু ঢাকা স্টেডিয়ামের প্রতিটি ঘাসের ডগায় রয়ে গেছে তার স্মৃতি। আজও সেই আকাশি নীল জার্সি পড়ে মাঠে নামে আবাহনী। তখনকার পরাক্রমশালী আবাহনীর আজকের এই দুরবস্থা দেখে অন্যলোক থেকে হয়তো ডুকরে কেঁদে ওঠেন মুন্না। আশা রাখেন আবারো ঘুরে দাঁড়াবে আকাশি-নীলরা, হয়তো আবারো স্টেডিয়ামপাড়া সরব হয়ে উঠবে আকাশি-নীলদের গর্জনে। ১৯৬৮ সালের আজকের এই দিনে নারায়ণগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাংলার এই ফুটবল সুপারস্টার।